জহিরুল ইসলাম শিবলু, লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি :: ইলিশের প্রজনন মৌসুম ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত এ ২২ দিন লক্ষ্মীপুরের রামগতি থেকে চাঁদপুরের ষাটনল পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার এলাকায় মেঘনা নদীতে সকল ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এ সময় মাছ শিকার, পরিবহন, মজুদ ও বাজারজাতকরণ অথবা বিক্রি নিষিদ্ধ। এ আইন আমান্য করলে ১ থেকে ২ বছরের জেল অথবা জরিমানা এবং উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে।
ইতি মধ্যে আইন অমান্য করে নদীতে মাছ শিকার করার দায়ে ১০ জেলেকে ২ বছর কারাদন্ড, এক জেলেকে ১০ হাজার টাকা, এক নৌকার মালিকে ৪ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এছাড়া পৃথক ঘটনায় ১৫ হাজার মিটার জাল জব্দ করা হয়।
প্রজনন মৌসুমে সরকার জেলেদের নদীতে মাছ ধরা থেকে বিরত রাখার জন্য প্রতি জেলেকে ২০ কেজি করে চাউল সহায়তা প্রদান করবে। তবে জেলেদের অভিযোগ স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা জেলেদের নাম নিবন্ধনের সময় প্রকৃত জেলেদের নাম নিবন্ধন না করে ৪-৫‘শত টাকার বিনিময়ে জেলে কার্ড তাদের আত্মীয়-স্বজনদেরকে প্রদান করায়, এখন নিষিদ্ধ সময়ে প্রকৃত জেলেরা সরকারী সহায়তা না পেয়ে বাধ্য হয়ে নদীতে মাছ শিকারে করতে যাচ্ছেন।
আবার এ সময়ে জেলেদের পুণর্বাসনে সরকারীভাবে ২০ কেজি করে চাল দেওয়া হলেও মহাজন ও এনজিওর ঋণের কিস্তি টাকা পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় বাধ্য হয়ে নদীতে মাছ শিকারে নামছে জেলেরা। জেলেদের দাবী, এ সময় সরকার যে চাল দেয় তা পাওয়া নিয়েও শঙ্কিত তারা।
স্থানীয়রা জানান প্রকৃত জেলেদের সরকারী সহায়তা দিলে ও মা ইলিশ রক্ষা অভিযানের ২২ দিন ঋণের কিস্তি আদায় বন্ধ রাখা হলে সরকারী নিষেধাজ্ঞা মানতে সহজ হবে এ অঞ্চলের জেলেদের জন্য। বাস্তবায়ন হবে মা ইলিশ কর্মসূচী।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মীপুরে জেলে সংখ্যা ৫৪১২৫ জন, তার মধ্যে জেলে কার্ড দেওয়া হয়েছে ৩৭৩২৬ জনকে। ইলিশের প্রজনন মৌসুম চলাকালে ২২ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধের সময়ে নিবন্ধিত জেলেদের একবার ২০ কেজি করে চাউল সহায়তা দেওয়া হবে। হিসেব মতে ১৬৭৯৯ জন জেলে চাউল পাওয়া থেকে বাদ থাকবে। তবে জেলেদের দাবী এ সংখ্যা আরো অনেক বেশী।
বৃহস্পতিবার সরেজমিনে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মেঘনা নদীর মজুচৌধুরীর হাট ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, নদীর এক পাশে জাল ও নৌকা তুলে রাখছেন জেলেরা। তাদের কাছে এগিয়ে গেলে ছুটে এসে চর রমনীমোহন ইউনিয়নের মধ্য চর রমনীমোহন গ্রামের জেলে আবুল বাসার, আবদুল মন্নান বেপারী, মনির হোসেন, হানিফ মিয়া, মোহাম্মদ মাঝি ও ইদ্রিস আলী অভিযোগ করে বলেন, তারা দীর্ঘদিন থেকে মেঘনা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। বিভিন্ন সময়ে সরকারী সহায়তা পাওয়ার জন্য স্থানীয় চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের কাছে গেলে তাদেরকে সরকারী সহায়তার বিনিময়ে টাকা দাবী করে তারা। টাকা দিতে না পারায় চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা টাকার বিনিময়ে প্রকৃত জেলেদের বাদ দিয়ে অন্য পেশার লোকদেরকে জেলে কার্ডের জন্য নাম নিবন্ধিত করে দেয়। তাই সরকারী সহায়তা না পেয়ে নিষিদ্ধ সময়ে পেটের দায়ে নদীতে মাছ শিকার করতে বাধ্য হচ্ছেন তার।
জেলে আবদুল মান্নান বেপারী জানান, নিষিদ্ধ সময়ের আগে মাছ ধরে কিছু টাকা সঞ্চয় করলেও ৪-৫ দিন পর এই টাকা শেষ হয়ে যাবে। আমাদের কাজ মাছ ধরা আমরা অন্য কোন কাজ করতে পারিনা তাই সরকারী সহায়তা না পেলে হয় আমাদের চুরি করতে হবে, না হয় নদীতে মাছ ধরতে হবে।
নিবন্ধিত জেলে সিরাজ আহম্মদ রারী জানান, একজন জেলে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৮-১০ জন। সরকারী এ ২০ কেজি চাউলের সহায়তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। আবার মাছ ধরা বন্ধ শুরু হলেও তারা এখনো চাউল পান নাই। এতে করে জেল-জরিমানা যত কিছুই হোক, পরিবারের জন্য খাবার জোগাড় করতে বাধ্য হয়ে নদীতে যেতে হবে।
মজু চৌধুরীর হাট মাছ ঘাটের আড়ৎদার মোঃ ইউসুফ জানান, প্রকৃত জেলেদের বেশীর ভাগই কার্ড পায়নি। এখন যারা কার্ড পেয়েছে তার মধ্যে ৮০ ভাগ অন্য পেশার, ২০ ভাগ জেলে।
রায়পুর উপজেলার চরবংশী এলাকার জেলে নেয়ামত আলী ও খাসের হাট এলাকার আনোয়ার মাঝিসহ কয়েকজন জেলে জানান, নদীতে মাছ শিকারই হচ্ছে তাদের একমাত্র পেশা। তাই জেলেরা স্থানীয় মহাজন ও বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া, জাল ও নৌকা তৈরি করে। নিষিদ্ধ সময়ে মাছ শিকার করতে না পারলে ঋণের কিন্তি পরিশোধ করা কঠিন হয়। তাই অনেকই ঋণ পরিশোধের দুশ্চিন্তায় বাধ্য হয়েই নদীতে মাছ শিকার করে।
চর রমনীমোহন ইউপি চেয়ারম্যান আবু ইউছুফ টাকার বিনিময়ে কার্ড দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমরা জেলেদের যে তালিকা অফিসে জমা দিয়েছি তার থেকে অফিস কিছু জেলেকে বাদ দিয়েছে। আমরা জেলেদের তালিকা অনুযায়ী কার্ড পৌঁছে দিয়েছি। আগামী সপ্তাহের মধ্যে কার্ড পাওয়া জেলেদের মাঝে ২০ কেজি করে চাউল বিতরন করা হবে।
জেলা মৎস্য অফিসার এস এম মহিব উল্যা জানান, প্রজনন মৌসুমে আগে কোন সরকারী সহায়তা দেওয়া হতো না। এবারই প্রথম প্রজনন মৌসুমে কার্ড পাওয়া প্রতি জেলে পরিবারকে ২০ কেজি করে ভিজিএফের চাউল দেয়া হবে।