এ বার কংগ্রেস নেতৃত্ব বুঝিয়ে দিলেন, জাতীয় স্তরে তৃণমূল যেমন কংগ্রেসের সমালোচনা করতে পারে, রাজ্যে তেমনই কংগ্রেসেরও সেই সুযোগ থাকা উচিত। দিল্লিতে আজ দলীয় সূত্রে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, মমতার সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতা করলেও রাজ্য স্তরে কংগ্রেস যে হেতু একটি পৃথক শরিক দল, তাই তারা নিজেদের কথা বলতেই পারে। সমালোচনার এই রাজনৈতিক পরিসর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিতে হবে। দলের রাজ্য নেতা-নেত্রীরা যে তৃণমূল সম্পর্কে ধীরে ধীরে সমালোচনামূলক অবস্থান নিচ্ছেন, তাতে কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের প্রচ্ছন্ন সমর্থনই রয়েছে। খবর : আনন্দবাজার
কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির এক শীর্ষ সদস্যের মন্তব্য, “মহাজনের কাছে ধার চাইতে গেলেও হাতে হিরের আংটি পরে যেতে হয়।” পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস সম্পর্কে কংগ্রেসের মনোভাব ঠিক এই রকমই। দলীয় মুখপাত্র মণীশ তিওয়ারি বলেছেন, “জোটের রাজনীতিতে এটা কোনও নতুন ঘটনা নয়। শরিক দল হিসেবে জাতীয় স্তরে যেমন কংগ্রেস সম্পর্কে তৃণমূলের সমালোচনার জায়গা থাকতে পারে, তেমনই রাজ্য স্তরে ছোট শরিক দল কংগ্রেসেরও নিজস্ব বক্তব্য থাকতে পারে। কিন্তু তার মানে এই নয়, সিপিএম বিরোধিতার প্রশ্নে কংগ্রেস কোনও ভাবেই আপস করবে। বরং আমরা মনে করি, ৩৪ বছরের সিপিএমের অপশাসনের অবসান ঘটানো সম্ভব হয়েছে মমতার নেতৃত্বে। এ ব্যাপারে কংগ্রেস তাঁর নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করেছে।”

কই কারণে জয়রাম রমেশও একটি ভারসাম্যের রাজনীতি দেখিয়েছেন। এক দিকে, তিনি যেমন জঙ্গলমহলে গিয়ে উন্নয়নের প্রশ্নে মমতা-সরকারকে সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন, অন্য দিকে আবার ‘রাজ্যে কংগ্রেস ভিআরএস নেয়নি’ বলে বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন। আজ কলকাতায় পঞ্চায়েতিরাজ সম্মেলনেও প্রণব মুখোপাধ্যায় থেকে জয়রাম রমেশ, সকলে একই রাজনৈতিক পথ অনুসরণ করেছেন। এই সম্মেলনের কিছু দিন আগেই রাহুল গাঁধীর সঙ্গে দেখা করেন রাজ্য কংগ্রেস নেতারা। রাজ্যে, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে কংগ্রেস কর্মীদের নিহত হওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে তাঁরা শরিক দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান। রাহুল কিন্তু তখনই মিছিল করার বিষয়ে রাজ্য কংগ্রেসকে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছিলেন। যার ফল শুক্রবারের মিছিল। যাতে যোগ দেন মৌসম বেনজির নূর, দীপা দাশমুন্সি, প্রদেশ সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। এবং যার পরে ধীরে ধীরে সুর চড়াতে শুরু করেন তাঁরা, সঙ্গে অধীর চৌধুরীও।
হাইকম্যান্ডের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছাড়া রাজ্য কংগ্রেস নেতারা যে এমন করতে পারেন না, তা ষোলো আনার উপর আঠারো আনা বোঝেন মমতা। তবু কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের কাছেই রাজ্য কংগ্রেস সম্পর্কে অভিযোগ জানিয়ে চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন তিনি। বিশেষত ২২ নভেম্বর সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরু হচ্ছে। তার আগে জাতীয় স্তরে মমতাকে চটাতেও চান না সনিয়া গাঁধী-মনমোহন সিংহ। তা হলে? কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস ও তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে যদি পারস্পরিক সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করেন, তবেই সব থেকে ভাল।
এই পরিপ্রেক্ষিতে রায়গঞ্জের সাংসদ দীপা দাশমুন্সি বলেছেন, “রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি রাজ্য স্তরে একটি সমন্বয় কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি হয়নি।” তাঁর বক্তব্য, কমিটি যদি না-ও হয়, তা হলেও আলোচনার মাধ্যমে দু’দলের শীর্ষ নেতৃত্বের একটি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছনো উচিত। সেটা হচ্ছে, সিপিএম থেকে আসা সমাজবিরোধীদের কেউই আশ্রয় দেবে না। সিপিএম ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় তাদের আশ্রিত সমাজবিরোধীরা এখন শাসক দলে যোগদান করতে চাইবে। সেটাই স্বাভাবিক। তাই এখনই কড়া ব্যবস্থা না নিলে ’৭২ সালের রাজনীতির পুনরাবৃত্তি হতে পারে বলে দীপার আশঙ্কা। তাঁর প্রশ্ন, ভবিষ্যতে যে এমন সমস্যা হবে না, সেটা কে বলতে পারে! কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতারা আর একটি প্রস্তাব দিচ্ছেন। সেটি হল, রাজ্যে কংগ্রেসের যেমন তৃণমূল সম্পর্কে কটূ মন্তব্য করাটা ঠিক নয়, তেমনি তৃণমূলও যদি প্রকাশ্য বিবৃতি দেওয়া থেকে সরে এসে তাদের অভিযোগ হাইকম্যান্ডকে সরাসরি জানায়, তাতে রাজ্যেরই মঙ্গল। না হলে কংগ্রেস-তৃণমূল বিভেদে সব থেকে খুশি হবে সিপিএম।
এই পরিস্থিতি তৃণমূল ও কংগ্রেসের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটিই সব থেকে বড় প্রশ্ন। মমতা যেমন অদূর ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে থেকে সমর্থন জানাতে পারেন, তেমনি রাজ্যেও কংগ্রেস একই পথে হাঁটতে পারে। সম্প্রতি মানস ভুঁইয়া দিল্লি এসে এ বিষয়ে একটি প্রস্তাবও দিয়ে গিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, কংগ্রেসের মন্ত্রীদের কোনও কিছুই জানানো হয় না। সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় সামিলও করা হয় না। এই অবস্থায় কংগ্রেসের মন্ত্রিসভায় থাকা না থাকা সমান। তৃণমূল নেতৃত্ব জানেন, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস যদি মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে যায়, তাদের কিছু এসে যাবে না। কংগ্রেসের মধ্যেই অভিযোগ, বামফ্রন্ট জমানায় ফরোয়ার্ড ব্লক, আরএসপি, সিপিআইয়ের যা গুরুত্ব ছিল, কংগ্রেসের সেটুকু আছে বলে মনে করেন না তৃণমূলের অনেক নেতা। তাঁদের কথা থেকেই সেটা স্পষ্ট হয়ে যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে তৃণমূল নেতা মুকুল রায়ের বক্তব্য, “বিগত নির্বাচনী ফলাফলগুলি দেখলেই বোঝা যায় কংগ্রেসের সাংগঠনিক শক্তি কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। কংগ্রেসের একাংশ সিপিএম সম্পর্কে নরম মনোভাব নেওয়ায় তাদের সাংগঠনিক শক্তি আরও ক্ষয় হয়েছে। তা সত্ত্বেও আমরা কিন্তু কোনও ভাবেই জোট ভাঙতে চাই না। কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়েই চলতে চাই।”
আবার কংগ্রেস হাইকম্যান্ড মনে করছেন, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে পর্যন্ত যা পরিস্থিতি, তাতে জাতীয় স্তরে কংগ্রেস দুর্বল হলেও তৃণমূলের পক্ষে এখনই জয়ললিতার মতো এনডিএ-র পাশে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। আর সিপিএম পরিচালিত তৃতীয় ফ্রন্টে যোগ দেওয়া তো সম্ভব নয়ই। তাই মমতা যতই হুঁশিয়ারি দিন, তৃণমূল এ বার আবেগতাড়িত হয়ে সমর্থন প্রত্যাহার করবে না। তা ছাড়া রাজ্যের অর্থনৈতিক সঙ্কট ও মাওবাদী সমস্যা মেটাতে কেন্দ্রের সাহায্য বিশেষ ভাবে প্রয়োজন মমতার। আবার মমতা এ-ও বোঝেন, তাঁরা সমর্থন তুললে কেউ এগিয়ে এসে কেন্দ্রের সরকারকে বাঁচিয়ে দেবে। বস্তুত, কয়েক দিন আগে তিনি বলেওছেন, তৃণমূল সমর্থন প্রত্যাহার করলে মুলায়মরা সমর্থন দিয়ে সরকারকে বাঁচিয়ে দেবে।
এই যখন ‘সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলির’ পরিস্থিতি, তখন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় কিন্তু মমতার সঙ্গে সম্পর্ক ঠিকঠাক রাখারই পক্ষে। শুক্রবার মৌসম-দীপাদের মিছিলের পরে মমতা প্রথম ফোনটা করেছিলেন প্রণববাবুকেই। প্রণববাবু অবশ্য তখন মন্ত্রিগোষ্ঠীর বৈঠকে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু তার পর তিনি প্রদীপ ভট্টাচার্যকে ফোন করে বলেন, দক্ষিণ কলকাতায় নির্বাচনের আগে এই ধরনের মিছিল না করলেই ভাল হত। গত কালই রাজ্যের আর্থিক সাহায্যের দাবিতে মমতার একটি চিঠি পান প্রণববাবু। ইংরাজিতে লেখা চিঠির একেবারে শেষে বাংলায় মমতা লিখেছেন, ‘রাজ্যের জন্য এটা আপনাকে করতেই হবে।’ এই ব্যক্তিগত স্পর্শে খুশি হয়েছেন তিনি। চিঠির উপরে ‘সর্ব্বোচ্চ অগ্রাধিকার’ লিখে অবিলম্বে সেটিকে কার্যকর করার নির্দেশ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী।

ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/আন্তজাতিক ডেস্ক

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here