ছাইফুল ইসলাম মাছুম :: স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর সর্বপ্রথম যে গ্রাম থেকে বঙ্গবন্ধু ‘দেশ গড়ার ডাক’ দিতে গেলেন সে গ্রামের নাম চর পোড়াগাছা। লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে সেই গ্রামে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক শেখের কিল্লা স্থানটিকে ঘিরে মানুষের কত আবেগ, কত স্মৃতি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী এক সমাবেশে এখানে এসেছিলেন শেখ মুজিব। মাটি কেটে সমাবেশের মঞ্চ তৈরি করেছিলেন নেতাকর্মীরা। মাটির তৈরি ওই মঞ্চে দাঁড়িয়ে মুজিব দেশ পূনর্গঠন ও অর্থনৈতিক মুক্তির ঘোষনা দিয়েছিলেন। সেই থেকে ওই স্থানটির নাম লোকমুখে শেখের কিল্লা নামে পরিচিতি পেয়েছে।
শেখের কিল্লার ওই সমাবেশের প্রত্যক্ষদর্শী তৎকালীন রামগতি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান মুক্তিযোদ্ধা শফিক কমান্ডার। তিনি স্মৃতিচারন করলেন। ইতিহাসের সাক্ষী এই নেতা শুনালেন বঙ্গবন্ধুর ওই দিনের বক্তব্যের সার সংক্ষেপ। শেখের কিল্লায় দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু সমাবেত কৃষক শ্রমিক জনতার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘দেশ আমাদেরকেই গড়তে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে। স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে দেশ গড়া ও অর্থনৈতিক মুক্তি আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হবে’। সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শেষে কোদাল হাতে নিয়ে স্বহস্তে মাটি কেটে ঝুড়িতে দিলেন। সফরসঙ্গি নেতৃবৃন্দও একে একে সবাই একইভাবে মাটি কেটে রাস্তা নির্মাণের কাজ শুরু করেন। এই স্বেচ্ছাশ্রমের কাজ উদ্বোধন করলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গণমানুষের অংশগ্রহনে স্বেচ্ছাশ্রমে ওই দিন নির্মান হয়েছিল দুই কিলোমিটার মাটির রাস্তা, যা এখন নোয়াখালীর সোনাপুর টু রামগতির আলেকজান্ডারের গুরুত্বপূর্ন সড়ক । শফিক কমান্ডার বলেন, ‘শেখের কিল্লায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এই স্মৃতি ধরে রাখতে কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কোন স্মৃতি স্মারক গড়ে না তুললে, তরুণ প্রজন্ম কিভাবে জানবে এখানে শেখ মুজিবের পদধূলি জমে আছে।’
স্থানীরা জানিয়েছেন, শেখের কিল্লায় বঙ্গবন্ধুর আগমনের ৪৮ বছর পেরিয়ে গেলেও, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত স্থানটির স্মৃতি ধরে রাখার উদ্যোগ নেয়নি কেউ। বরং এই স্মৃতি মুছে দিয়ে ইতিহাস বিকৃতিতে তৎপর হয়েছে অনেকে।
শেখের কিল্লার স্মরণীয় স্থানটি চিহিৃত করতে ২০১৩ সালে নামফলক স্থাপন করেছেন বেসরকারী সংস্থা ডরপ। ইতিহাস ধরে রাখতে ‘বঙ্গবন্ধু শেখের কিল্লা স্মৃতি ইতিহাস রক্ষা কমিটি’ গড়েছেন স্থানীয় গ্রামবাসী। সংগঠনের আহবায়ক হাজী মোহাম্মদ উল্লাহ সওদাগর, শেখের কিল্লায় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি অবিস্মরণীয় করে রাখতে ওই স্থানে একটি মুজিব স্মৃতিস্তম্ভ সম্বলিত, ’বঙ্গবন্ধু শেখের কিল্লা স্বপ্ন কমপ্লেক্স’ তৈরির দাবি জানিয়েছেন।
তবে আশার খবর সম্প্রতি শেখের কিল্লা নামক স্থানটি পরিদর্শন করে সেখানে ‘বঙ্গবন্ধু শেখের কিল্লা স্মৃতি স্তম্ভ’ নির্মানের ঘোষনা দিয়েছেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। কিন্তু গ্রামবাসী জানিয়েছেন এই ঘোষনার এখনো দৃশ্যত কোন অগ্রগতি নেই। তবে একটি পক্ষ অন্যত্র শেখের কিল্লা স্তম্ভ নির্মানের জন্য বিভিন্ন মহলে তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। এমন অভিযোগে সামনে এনে মানববন্ধনও করেছে শেখের কিল্লা স্মৃতি ইতিহাস রক্ষা কমিটি। তাদের অভিযোগ, বঙ্গবন্ধু ১৯৭২সালের ২০ ফেব্রুয়ারি যেখানে এসে ওড়া-কোদাল হাতে মাটি কেটে স্বেচ্ছাশ্রমে নিজ হাতে মাটি কেটেছেন, সেখানে বঙ্গবন্ধু স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ না করে অন্য একটি স্থানে স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করার জন্য ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে রামগতি থানা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির প্রতিষ্ঠাতা এবং বঙ্গবন্ধুর সেদিনের জনসভার অন্যতম নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণকারী এএইচএম নোমান বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বেচ্ছাশ্রম, উৎপাদন ও গ্রামোন্নয়ন ঢাক ফলে রামগতিতে সয়াবিন, বাদাম ও আলু উৎপাদন এলাকা হিসাবে পরিচিতি, যা এখন ‘সয়াবিন জেলা লক্ষ্মীপুর’। একইভাবে গ্রামোন্নয়ন মডেল হিসেবে এ রামগতিতেই বিশ্বগ্রাম (১৯৭২-৭৩) গুচ্ছগ্রাম (১৯৮৫-৮৬) সালে প্রতিষ্ঠা হয়। জাতির পিতার সেই উন্নয়ন ধারা তার সুযোগ্য কণ্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ডিজিটাল বাংলাদেশ রুপান্তরে আমরাও একাত্ত্ব হয়ে কাজ করে যাচ্ছি। অপার সম্ভাবনার মধ্যেও আমরা হতাশ যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত শেখের কিল্লার স্মৃতি রক্ষায় ৪৮ বছর পার হয়ে গেলেও প্রকৃত কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।
তিনি আরো বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত রামগতির শেখের কিল্লার স্থান নিয়ে গত ৪৮ বছরে কোন মতনৈক্য ছিল না। ভূমি মন্ত্রণালয় তথা গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প যখন প্রশ্নবোধক কাজ শুরু করলো, সেই থেকেই বিভেদ বীজ রোপন হয়। খাস জমি সংকুলান নেই- এরকম ঠুংকু অজুহাতে জাতির জনকের স্মৃতি চিহ্নিকে বিকৃত করা- প্রশাসনের হয়ত উদ্দেশ্যমূলক চিন্তারই বহিপ্রকাশ। ইতোমধ্যে স্থানীয়রা স্তম্ভ নির্মানের জন্য ১৬৩ শতাংশ যায়গা সরকারকে দেয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন। এখানে ’বঙ্গবন্ধু শেখের কিল্লা স্বপ্ন কমপ্লেক্স’ নির্মিত হলে সঠিক ইতিহাস জানাসহ স্থানটির গুরুত্ব তৈরী হবে এবং মেঘনা নদীসহ রামগতি উপজেলা একটি পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে উঠবে।