শিরিন ফেরদাউস

শিরিন ফেরদাউস :: পলির মাথায় জলপট্টি। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।মোটা কাঁথা মুড়িয়ে রেখেছে গায়ে। তবুও হুহু করে সে কেঁপে উঠছে। পাশে বসে তার মা মুখে কাপড় চেপে নিরবে কাঁদছে।বাবা অসাড় হয়ে একপাশে বসে আছে। মুখে কোনো কথা নেই।

বাবা মা পলিকে নিয়ে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। হসপিটালে যাবার মতো সামর্থ্য থাকলে ও তার বাবা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। হসপিটাল তাদের বাড়ি থেকে দুইকিলোমিটার দূরে। যাতায়াতের একমাত্র বাহক ভ্যান।

রাস্তাঘাটের অবস্থা ও তেমন ভালো নয়। বর্ষাকাল চলছে। বড় বড় খাদ রাস্তার মাঝখানে।হাঁটু সমান কাদা। কোনো কোনো জায়গায় পুকুর এবং খালের পানি রাস্তার উপর সীমায় উঠে যাওয়ায় সেসব জায়গায়গুলো দিয়ে ভ্যান টেনে নেওয়া চরম মুশকিল।কিন্তু পলির জীবনের এই মর্মান্তিক সময় হসপিটাল যাবার সিদ্ধান্তহীনতা কি শুধুই রাস্তার কাদাজল নাকি অন্যকিছু?

পলির ছোট ভাই পলাশ উঠে ঘরের দরজা খুলে দিয়ে দাওয়ায় রাখা ছোট্ট পিঁড়িটায় মুখ ভার করে বসে আছে।কদিন থেকে তাদের ঘরের দরজা বন্ধ।পলি বুবুর কি জেনো হয়েছে।সবাই ফিস ফিস করছে।তাকে কেউ কিছু বলছে না বাইরে যেতে ও দিচ্ছে না।কি হয়েছে পলি বু য়ের?

ইশ সে আর পলি বু কতই না মজা করতো।প্রতিদিন দুপুরবেলায় ভাত খেয়ে তারা চলে যায় উত্তর ডাঙার জঙ্গলে।ওখানে কত রং বেরংয়ের গাছগাছালি। নাম না জানা কত ফুল আর ফল।একটা ছোট জামগাছের ডালে বুবু আর সে কচিবাঁশ কেটে মাচা বেঁধেছে।মাঝে মাঝে বুনোবাতাসে তাদের মাচাটা যখন নড়বড় করে ক্যাচাং শব্দে ভেঙ্গে পড়ে বুবু আর সে খিলখিলিয়ে হাসে।তাদের হাসি যেন নির্জন ঐ বনবাদাড়ের নিস্তব্ধতাকে ছাড়িয়ে দূরের পাহাড়ে গিয়ে ফিরে ফিরে আসে।

একদিন রাতে মা তাদের খুব বকেছিলো।তাই দুজনে পরদিন অভিমান করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়ে ঐ উঁচু মাচায় সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি ছিল।দুপুরবেলায় যখন খুব ক্ষিদে পায় তারা জঙ্গলের আরও ভেতরে গিয়ে কিছু বুনো ফল সংগ্রহ করে লবন মরিচ দিয়ে খেয়ে ক্ষুধা মেটায়।অবশেষে সন্ধ্যার কাছাকাছি সময়ে যখন অন্ধকার নেমে আসে তখন ভয়ে তারা বাড়ি ফিরে আসে।ফিরে আসার পর মায়ের সে কি কান্না।কারণ মা নাকি সারাদিন তাদের দুজনকে পুরো গ্রামজুড়ে খুঁজেছে।ওদের খুঁজে না পেয়ে মা ভয় পেয়ে গেছে।ভেবেছে হারিয়ে গিয়েছে।

উত্তর ডাঙ্গার ঐ মাচাটা তাদের খুব গোপন জায়গা।ওখানে লুকানো আছে তাদের ছোট ছোট হাঁড়িপাতিল এমনকি হাতে বানানো পুতুল এবং বৈশাখী মেলা থেকে কিনে নেওয়া পুতুলের ঘর আলমারী আর খাট।এই সবকিছু মিলে ঐ মাচাটা যেনো একটি কল্পনার জগৎ।সেসব অতি প্রিয় গোপন কাল্পনিক পৃথিবী ছেড়ে আজ ছয়দিন বুবু জ্বরে বিছানায় পড়ে আছে।তাই পলাশ ও একা আটকে আছে বাড়িতে।ওদিকে বাবা মা ও কেনোজানি বুবু অসুস্থ হবার পর থেকে বাড়ির সামনের রাস্তায় ও যেতে দিচ্ছে না তাকে।

আচ্ছা বুবুর কি হয়েছে?কেনো এত জ্বর?একদিন বুবু বলেছিলো ভুতের বাতাস লাগলে নাকি জ্বর হয়।মাঝে মাঝে যখন বাতাসে তাদের মাচা ভেঙ্গে যেত বুবু বলতো জানিস পলাশ জঙ্গলের এই বুনো বাতাসে ভুতের আসর থাকে।এসব বলতে বলতে একদিন তারা ঐ একাকী নির্জন জঙ্গলে খুব ভয় পেয়ে ছুটতে ছুটতে বাড়িতে এসে পৌঁছলো।যখন তারা দৌড়াচ্ছিলো কেনোজানি প্রচন্ড বাতাস শুরু হয় এবং ঐ বাতাস যেনো তাদের পিছু নিয়েছিলো।তারা যত দৌড়াচ্ছে বাতাস ও আরও জোরেশোরে আসছে।জঙ্গলের সমস্ত গাছগুলো যেনো ঐদিন বাতাসে আচড়ে ওদের গায়ে পড়ছিলো।মনে হলো তাদের চলার গতি থামিয়ে বাতাসের তীব্রতা তাদের আটকে রাখতে চায়।তারা দু ভাইবোন প্রাণপন ছুটে দৌড়ে বাড়িতে চলে আসে।

তারপর কিছুদিন তারা ওদিকে আর যায়নি।পলি বুবুর ধারনা ঘন জঙ্গলের সেই বুনো বাতাসটার মাঝে সত্যি কোনো পরী বা জ্বীনের শক্তি ছিলো।হয়তোবা তাদেরকে বাতাসে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো কোনো এক পরীর দেশে।ভাগ্যিস তারা ছুটে চলে আসতে পেরেছিলো।

এসব ভাবতে ভাবতে যখন পলাশ মগ্ন এমন সময় ঘরের ভেতর থেকে মায়ের তীব্র কান্নার শব্দে ছুটে গেলো ঘরের ভেতরে।সে দেখলো তাদের চৌকির মাঝখানটায় যেখানে বুবু শুয়ে আছে তার গায়ের কাঁথা এবং চৌকিতে রক্তে ভেসে আছে।বুবু কিছুক্ষণ পর পর হেঁচকি তুলছে আর মা চিৎকার দিয়ে বাবার হাত পা ধরে অনুনয় করে বলছে ও পলির বাপ তোমার পায়ে পড়ি আমার মাইয়াডারে বাঁচাও।এহন আর মান-সম্মান নিয়ে ভাবার সময় নাই।আগে আমার মাইয়ার জীবন বাঁচাও।তোমার দোহাই লাগে একডা ভ্যান ডাহো।

আমার মাইয়াতো কোনো দোষ করে নাই।তয় আমার মাইয়া ক্যান শাস্তি পাইতাছে?অন্যায়তো করছে তোমার ভাই।চাচা হইয়া নিজ ভাতিজীরে ছি ছি ছি বলে মা মুখে কাপড় গুঁজে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।এমন সময় পলি পলাশের দিকে হাত বাড়িয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল পলাশ ও পলাশ যাবি উত্তর ডাঙায়!যাবি উত্তর ডাঙায়!বলতে বলতে তার কথা থেমে গেলো। পলির মা এগিয়ে মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে দেখলো তার মেয়ের শরীর কেমন নিস্তব্ধ স্থির হয়ে পড়লো।পলাশ দেখলো মা আরও দ্বিগুন চিৎকার দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল ও পলির বাপ!আমার মাইয়াতো আর…

কথাটা শেষ না করতেই প্রচন্ড বাতাসের ধাক্কায় তাদের ঘরের জানালাটা দুঁ’ফাক হয়ে দুদিকে চলে গেলো।পলাশ আঁতকে উঠলো মনে হলো যেনো সেদিনের সেই বুনো বাতাসে লুকিয়ে থাকা পরীটি আজ তাদের ঘরে এসে আচড়ে পড়লো।

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here