ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডেস্ক ::
মোহাম্মদপুর, জেনেভা ক্যাম্প। যেখানে বিহারীদের বসবাস। তাদের নেই তেমন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, চারিদেকে মাদকের ছড়াছড়ি। অভাবের তাড়নায় শিশু বয়সেই বইয়ের বদলে কাঁধে নিচ্ছে পরিবারের দায়িত্ব। পরিবারে ঝগড়া-বিচ্ছেদ যেন নিত্যদিনের ঘটনা। এমন হাজারো প্রতিকূল পরিবেশ থেকে বাচ্চাদের মাঝে শিক্ষার আলো পৌছে দিতে সরকার উদ্দ্যেগ গ্রহণ করেছে। আর সরকারের পাশে রয়েছে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও এনজিও সংস্থা। এই এনজিও সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘ঘাসফুল’। কথাগুলো বলছিলেন ঘাসফুলের ‘শিখন কেন্দ্রের’ শিক্ষিকা আজমিম আজাদ মীম, নুসরাত জাহান লিজা ও ফাতেমা আক্তার। শিক্ষক দিবসে সম-সাময়িক শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কথা হয় তাদের সাথে। তাদের কথাগুলো লেখায় ফুটিয়ে তুলছেন মোসাম্মৎ ছালেহা বেগম ও মামুনূর রহমান হৃদয় ।
শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে পথচলা শুরু কিভাবে?
প্রথমে শিক্ষকতা পেশায় আসার ইচ্ছা ছিল না, তবে প্রথম যখন চাকরির জন্য কর্পোরেট সেক্টরে আবেদন শুরু করি তখন ঘাসফুল থেকে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেখতে পাই। তখন ভাবলাম শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে। তাদেরকে যখন কোন কিছু শেখাতে যাবো তখন আমার ভেতরে থাকা জড়তাও এক সময় কেটে পাবে। নিজেকে যাচাই করার উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে শিক্ষকতা।
নারী হিসেবে শিক্ষকতা পেশা কতটুকু উপভোগ্য ও কতটা চ্যালেঞ্জিং?
অবশ্যই শিক্ষকতা পেশাটা চ্যালেঞ্জিং। কারণ, আপনার সামনে অনেক ক্যাটাগরির শিক্ষার্থী থাকবে । কেউ বোকা, চতুর, সবল, দুর্বল, কেউ ভিতু কেউবা সাহসী । তাই সবাইকে বুঝতে পারার বিষয়টা একটু চ্যালেঞ্জিং। আর নারী হিসেবে শিক্ষকতা পেশা সম্পর্কে বলব যে মায়ের পর যদি কেউ থেকে থাকে তাহলে তিনি শিক্ষক। মা আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা দেন, কিন্তু শিক্ষকের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অক্ষর জ্ঞানের হাতেখড়ি। শিক্ষকতা করে মা না হয়েও মা হওয়া যায়।
জীবনের প্রথম ধাপ প্রাইমারি স্কুল। এই ধাপে কাজ করে ভয়। শিক্ষার্থীদের এই ভয় জয় করে স্কুলে পাঠানোর কৌশল কি?
যখন বাচ্চারা স্কুলে আসতে চায় না তখন বাচ্চাদের ভয়ভীতি দেখানো যাবে না। তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করতে হবে। আদর করে, বুঝিয়ে স্কুলে আনতে হবে। শিশুরা তাদের আশেপাশে যে সকল বাচ্চাদের সাথে মিশতে পছন্দ করে তাদেরকেও স্কুলে পাঠাতে হবে তাহলেই বাচ্চাদের ভেতরের ভয়ভীতি অনেকটা কেটে যায়।
শিক্ষার্থীদের এই প্রাথমিক ধাপ কতটা গুরুত্বপূর্ণ ?
সমাজকে পরিবর্তন করার জন্য তাদের এই প্রাথমিক ধাপ বেশ গুরুত্বপূর্ণ । শিক্ষার্থীরা দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। তারাই দেশকে ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দেবে। তাই দেশের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে শিক্ষার্থীদের এই প্রাথমিক ধাপে গুরুত্ব আরোপ জরুরি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জনশুমারি ও গৃহগণনা, ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে আমাদের দেশে এ মুহূর্তে স্বাক্ষরতার গড় হার প্রায় ৭৫। এখনো কিন্তু ২৫ ভাগ পূর্ণ হয়নি। তাই শিক্ষার্থীরা যদি পড়াশোনার প্রাথমিক সূচনা করে তাহলে এক পর্যায়ে তারাও তাদের বাবা-মাকে অন্তত নিজের সাক্ষর করা শেখাতে পারবে। বিদ্যালয় থেকে শিখে আসা আদব-কায়দা, প্রাথমিক জ্ঞান সম্পর্কে পরিবারের সবাইকে অনুধাবন করাতে পারবে।
শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের কিভাবে ক্লাসে সার্বিক পরিস্থিতি বজায় রাখেন?
শিক্ষার্থীদের খেলার ছলে শেখাই। তাদের চকলেট দিয়ে পুরষ্কৃত করে মনযোগ ধরে রাখার চেষ্টা করি। যখন দেখি শিক্ষার্থীরা উদাসীন তখন তাদের কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে, ছড়া, গানের মাধ্যমে আবারও মনযোগী করার চেষ্টা করি।
শিক্ষকতা পেশায় কোন প্রতিবন্ধকতা আছে কি না? যদি থেকে থাকে তাহলে সেটা কিভাবে মোকাবিলা করছেন?
অবশ্যই প্রতিবন্ধকতা আছে। আমাদের শিখন কেন্দ্রটা কিন্তু মোহাম্মদপুর,জেনেভা ক্যাম্পের ভেতরে। এখানে অধিকাংশ নিরক্ষর ও মাদকের সাথে জড়িত। বাবা-মায়ের সচেতনতার অভাবে শিশু-কিশোররা পড়াশোনা বিমুখ ও মাদকের ভয়াল থাবায় পা দিচ্ছে। আমরা চাচ্ছি তাদের এই অন্ধকার জগৎ থেকে ফিরিয়ে আনতে। আমাদের শিখন কেন্দ্রের পাশাপাশি কয়েকটি সংস্থা তাদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছে । যারা এই সকল বাচ্চার মা-বাবাদের প্রতিনিয়ত শিক্ষার গুরুত্ব ও মাদকের কুফল সম্পর্কে বোঝানোর চেষ্টা করছে। বাবা-মায়ের সাবধানতা, সমাজ ও শিক্ষকদের যৌথ উদ্দ্যেগ পারে শিক্ষার্থীদের এর থেকে বের করে নিয়ে আসতে।
যেসকল শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে শিক্ষকতা পেশায় আসতে চায় তাদের উদ্দেশ্য কি বলবেন?
পরিবারে অভিভাবক যেমন সন্তানের কোনো সমস্যা দেখলে চুপ থাকতে পারে না তেমনই শিক্ষার্থীদের যথাসময়ে সুশিক্ষা ও সব সমস্যায় পাশে থাকা শিক্ষকের দায়িত্ব। কোনো শিক্ষক যখন দায়িত্বকে তোয়াক্কা না করে শিক্ষকতার সংজ্ঞা ভুলে গিয়ে এটি পেশা হিসেবে বেছে নেয় তখন সে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। এর ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করে শিক্ষার্থীরা। তাই আমি বলব যারা ভবিষ্যতে শিক্ষকতা পেশায় আসতে চায় তারা যেন অবশ্যই শিক্ষাবান্ধব শিক্ষক হয়।
ঘাসফুল সম্পর্কে আপনার মতবাদ কি?
আমি ঘাসফুলকে সাধুবাদ জানাই। এটি অবশ্যই সরকারের ভালো উদ্দ্যেগ । আপাতত ঘাসফুলের ২০টি শিখন কেন্দ্রে দুইটি শিফটে বাচ্চাদের পড়ানো হচ্ছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস উপলক্ষে সমাজসেবা অধিদপ্তর,চট্টগ্রামের পক্ষ থেকে শিক্ষা প্রসারে অনবদ্য অবদানের জন্য ঘাসফুলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব আফতাবুর রহমান জাফরী সম্মাননা পদকে ভূষিত হন যা আমাদের জন্য খুবই গর্বের। ভবিষ্যতে ঘাসফুলের পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে এই সকল অবহেলিত শিক্ষার্থীদের মাঝ থেকে সুপ্ত প্রতিভা বের হয়ে আসবে। দোয়া করি শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে যেন তাদের সুপ্ত প্রতিভা দেশের কল্যাণের কাজে ব্যবহার করতে পারে। আমি চাই ঘাসফুল আরও বড় বড় উদ্দ্যেগ গ্রহণ করুক এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের তুলে ধরুক।
শিক্ষক দিবসে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কি প্রত্যাশা?
শিক্ষক দিবস উপলক্ষে অবশ্যই চাইব শিক্ষা ব্যবস্থার আরো প্রসার হোক। ‘র্যাট রেস’ বন্ধ করে বাচ্চাদের খেলার ছলে শেথাতে হবে, কারোর সথেে তুলনা করা যাবে না। কোচিং এর শিট বা গাইডের উপর নির্ভরশীল না হয়ে পাঠ্যবই থেকে শেখার চেষ্টা করতে হবে। তাই শিক্ষক দিবসে একটাই প্রত্যাশা, ‘মুখস্হ বিদ্যার অবসান হোক, শিক্ষা হোকউপভোগ্য, শিক্ষণীয় ও কর্মমুখী।’
উল্লেখ্য যে, ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব ব্যাপী পালিত হয়ে থাকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এই দিবসটি শিক্ষকদের অবদানকে স্মরণ করার জন্য পালন করা হয়। ইউনেস্কোর মতে, বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পালন করা হয়। বিশ্বের ১০০টি দেশে এই দিবসটি পালিত হয়ে থাকে।
মোসাম্মৎ ছালেহা বেগম ও মামুনূর রহমান হৃদয় (গণমাধ্যমকর্মী)