আজ ২৫ বৈশাখ তাই স্মৃতিধন্য জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির কথা মনে পড়ে গেলো। শ্রদ্ধায় স্বরণে হেঁটে যাই জোড়াসাঁকোর মেছো কলোনির বর্তমান বিখ্যাত ৬ নম্বর দ্বারকানাথ লেন, যা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। প্রথমবার যখন কলকাতায় যাই সেটা ছিলো অক্টোবরে। দূর্গা পুজো’র অষ্টমীতে। সারা কলকাতা তখন উৎসবে মোড়া। আলোক সজ্জা, অলিতে গলিতে প্রতিমা, সেই কি অবস্থা। পারিবারিক বন্ধু বড় ভাই কবি জয়ন্ত বাগচি দাদা, আমাদের জন্য হোটেল রেডি করে রেখেছিলেন আগেই। কারন উৎসবের সময়গুলোতে কলকাতায় হোটেলে জায়গা পাওয়াটা বেশ সমস্যার। এই সময়গুলোতে শুধু বাংলাদেশ নয়, অন্য দেশ ও ভারতের বিভিন্ন এলাকাগুলো থেকেও মানুষ বেড়াতে আসেন কলকাতার পূজো দেখতে, ফলে নিউমার্কেট, পার্ক স্ট্রিট, মার্কুইস স্ট্রিট, সদর স্ট্রিট, মির্জাগালিব স্ট্রিট,রফি আহমেদ রোডের হোটেলগুলো হয়ে যায় সোনার হরিণ। সাধারন অবস্থা থেকে ভাড়াও অনেক বেশী থাকে। যেহেতু আমরা বিদেশি, তাই সব হোটেলে থাকাও সম্ভব নয়। যেসব হোটেলে বিদেশি রাখার অনুমতি নেয়া আছে সেখানেই থাকা যাবে। কলকাতার সবচেয়ে বেশি হোটেল বা গেস্ট হাউজ পার্ক স্ট্রিট এলাকায় ও নিউমার্কেট চত্বরের আশপাশের রাস্তাগুলিতে। সেবার আমরা উঠেছিলাম সদর স্ট্রিটের হোটেল পার্ক এ। এই হোটেলের একটি ঐতিহ্য আছে। এখানে কবিগুরু এসে থাকতেন তখন এটা হোটেল ছিলো না। জয়ন্ত’দা হোটেল রিসিপশনে অপেক্ষা করছেন সেই সন্ধ্যা থেকেই। আমরা ঢাকা থেকে জেট এয়ারে উড়াল দিয়ে ইমেগ্রেশন শেষ করে হোটেলে পৌঁছলাম সাড়ে আট’টায়। এসে রুমে গিয়ে লাগেজ রাখতেই দাদা তাড়া দিলেন তাড়াতাড়ি কর, প্রতিমা দেখতে বের হবো। আমার ছেলে অর্পণ সহ আমরা বের হলাম। নিউ মার্কেটের রাস্তা ধরে হেঁটে এসপ্ল্যানেড থেকে মেট্রোরেলে করে কালীঘাট নামলাম। কালীঘাট বলতে গেলে পূর্ণার্থীদের তীর্থক্ষেত্র। প্রায় লক্ষ লোকের সমারোহে সারা রাত কালীঘাট ও তার আসে পাশে জেগে থাকে। ঢাকের শব্দ আরতিতে মুখরিত পুরো শহর। প্রায় গলিতে প্রতিমা, মূল উৎসব কালীঘাট মন্দিরকে কেন্দ্র করে। ঐ রাতে জয়ন্ত’দা প্রায় পঞ্চাশটার মতো প্রতিমা দেখালো। আমার ছেলে অর্পণের তখন ক্লান্তিতে টলমল অবস্থা। আমরা ফিরলাম আবার মেট্রোতেই তখন মধ্যরাত , সে সময়টি বোধ করি মেট্রো সারা রাত যাত্রি পরিসেবা দেয়। পরের দিনগুলিতে পারিবারিক প্রয়োজনের ফাঁকে ফাঁকে আমরা দর্শনীয় অনেকগুলো স্থানই ঘুরে বেড়িয়েছি। বাংলা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বিস্ময়কর স্থাপত্যগুলির সাথে গল্প কবিতায় উপন্যাসে হয়তো পরিচিত ছিলাম। মানসপটে একটি প্রাথমিক স্কেচ টানা ছিলো। তার পূর্ণতা পেলো বলতে গেলে রঙিন হলো তা স্বচক্ষে দেখে। বাংলাদেশের একদম পাশের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, তার রাজধানী কলকাতা। এই কলকাতা সম্পর্কে প্রচুর উপমা উপকথা উদাহরন পুস্তকে মানুষের মুখে শুনেছি। বাস্তবের কলকাতা একটু অন্যরকম। শহুরে আধুনিক ছেলে মেয়েদের পোষাকে আচরনে একটি ওয়েস্টান কালচার লক্ষনীয়। তবে অত্যন্ত শালীন শিষ্টাচার সমৃদ্ধ। তারা নাগরিক সংস্কৃতি পুরো মাত্রায় মেনে চলে। কলকাতা আধুনিকতার ছোঁয়ায় মেট্রোরেলের গতিতে এগিয়েছে নিঃসন্দেহে কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির বাঙালিয়ানা। কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি, টানা রিক্সায়, পায়ে হেটে, মেট্টোতে, ট্রামে, লোকাল ট্রেনে, টেক্সিতে, অটোতে, প্রাইভেট কারে শহরে প্রচুর রাস্তা। ট্রাফিক সিস্টেমও ভালো। সবচেয়ে বড় কথা আইনকে মান্য করার প্রবনতা অধিক। তবে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলা, তারা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বাংলা বললেও সর্বত্রই হিন্দির দাপট। তরুন তরুনীদের আবার হিন্দী আর ইংরেজী মিক্সিং ভাষার ব্যবহার লক্ষনীয়। সর্বপরি আমার কাছে মনে হয়েছে হিন্দি এবং ইংলিশ বলতে পারাটা একটা ষ্টাইল একটু আধুনিকতা। মানুষের ভিতর গতি ও সততা আমাকে মুগ্ধ করেছে। মেট্রো জার্নি তো অসাধারন অনুভূতি।
অল্প টাকায় দ্রুত আরামদায় ভ্রমন।বাস ভাড়া নিয়েও নেই কোন প্রতারনা। সুলভে হলুদ টেক্সিতে সবসময় শহরের যে কোন জায়গায় যাতায়ত করা যায়। অটো যেগুলোকে আমাদের দেশে সিএনজি বলি সেগুলোতে নেই ড্রাইভারদের বাড়াবাড়ি রকমের কিছু। সব কিছু যেন চলছে একটা নির্ধারিত নিয়মে। কোথায় কোন বিশৃঙ্খলা নেই মানুষের মাঝে মারামারি ধরাধরি নেই, গলাকাটা দাম নেই। মানুষের প্রতি মানুষের একটি সৌজন্য ভাব সর্বত্র বিদ্যমান। স্ট্রিটফুডের দোকান আছে, মানুষ খাচ্ছে যে যার কাজ করছে। হোটেল রেস্টুরেন্টে আটার সাদা রুটি থেকে ভাত মাছ মুরগী শাক সব্জি ডাল সবই পাবেন।
দাম অসম্ভব রকমের সস্তা। কিছু কিছু মুসলিম হোটেলে গরুর গোস্ত পাবেন কয়েক আইটেমে। আমাদের ঢাকায় একপ্লেট গরুর মাংস বিক্রি হয় ১৫০ টাকায় আর কলকাতায় তারচেয়ে টাটকা পরিমানে বেশী একপ্লেট মাংস মাত্র ৩৫ টাকায়। কয়েক আইটেম দিয়ে উদরপুর্তি করে খেয়েও আপনি বিল দিতে গেলে মনে হয় দোকানদার ভুল করে হয়তো আপনার কাছ থেকে এতো কম বিল নিচ্ছেন। তবে কিছু অভিজাত রেস্টুরেস্ট আছে সেখানে আবার প্রচুর দাম। আমরা সব রকমের রেস্টুরেন্টেই খেয়েছি। আছে শহরের অলিগলিতে চা দোকানের ন্যায় মদের দোকান কিন্তু কোন উচ্চবাচ্চতা নেই। কোন ছেলে মেয়েকে রাস্তায় মাতলামি করতে দেখিনি। তবে তরুন তরুনীদের খোলামেলা মেলামেশার প্রবনতা খুব বেশী, রাস্তায় রেস্টুরেস্টে, মেট্রোতে, পার্কে তাদের আপত্তিকর আচরন লক্ষনীয়। বয়স্করা যে বিব্রত হচ্ছেন তা টের পাওয়া যায়। বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের দেখেছি ওপেন সিগারেট খেতে, যা ঢাকাতে নেই। রাস্তায় বের হয়ে মাঝে মাঝে মনে হয়েছে আধুনিক যুগে কিছু আদিম মানুষ দেখছি। উঠতি বয়সী মেয়েদের পোশাকে উৎকট আধুনিকতা লক্ষনীয়। যুবতী মেয়েরা আটসাট পোশাক পরছে, ওড়নার ব্যবহার নেই বললেই চলে। যাক তবুও কলকাতা এগুচ্ছে তার নিজস্ব গতিতে। মধ্যবিত্ত বাংলাদেশীদের জন্য কলকাতা বলতে গেলে গরীবের সিঙ্গাপুর বলা যেতে পারে। প্রচুর আধুনিক শপিংমল হচ্ছে মেয়েদের কসমেটিক, অলংকার, পোশাকের বহুমাত্রিক আয়োজনে ছুটে যাচ্ছে সবাই শপিং করতে কলকাতায়। চিকিৎসা ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নে উন্নত চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের মানুষ ছুটছে কলকাতায়। সব মিলিয়ে কলকাতাকে বাংলাদেশের মানুষ গ্রহন করছে আপন মর্যাদায়।
যাক, ধান ভানতে শীবের গীত গাওয়া হলো অনেক।
আজ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী। কবিগুরুর জন্মভিটা জোড়াসাঁকো নিয়েই মূলতঃ লিখার ইচ্ছেয় উপরিক্ত অবতারনা। জয়ন্তদাকে ফোন দিয়ে জেনে নিলাম আমাদের হোটেল থেকে কিভাবে ঠাকুরবাড়ী যাওয়া যায়। তার নির্দেশনায়, আমরা বের হলাম নিউমার্কেট ধরে এসপ্ল্যানেড মেট্রো স্টেশনে পাঁচ টাকা করে টিকেট কেটে নেমে গেলাম গিরীশ পার্ক। মেট্রোতে গিরীশ পার্ক মানেই হলো সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ। রাস্তার পাশের দোকানদারকে জিগ্যাস করে বউসহ বাপ বেটা এ গলি ও গলি ধরে হেঁটেই চলে আসলাম দ্বারকানাথ স্ট্রিটে। কিন্তু বিধিবাম, পূজোর কারনে ঠাকুর বাড়ী ঢুকতে পারলাম না প্রথম দিন। ফিরে আসতে হলো।
আমরা চলে গেলাম মুর্শিদাবাদে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার নবাবীতে। মুর্শিদাবাদ ঘুরে এসে আবারও আসলাম জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ীতে।
লাল ইটের বিশাল প্রাসাদ এই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ী। ঠাকুরবাড়ি বর্তমানে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষাপ্রাঙ্গন। আজকের বিশাল আয়তনের জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি একদিনে তৈরি হয়নি। বেশ কয়েক প্রজন্ম ধরে একটু একটু করে বেড়ে উঠেছে, আবার ভেঙেও ফেলা হয়েছে অনেক অংশ। বর্তমানে যে চেহারা আমরা দেখতে পাই তা মূলত তিনটি ভবন। তার মধ্যে গঠন শৈলীর বিচারে পূর্ব দিকের ‘রাম ভবন’ প্রাচীনতম। পশ্চিম দিকের ‘মহর্ষি ভবন’ প্রাচীন হলেও তুলনায় পরে হয়েছে বলেই সাক্ষ্য দেয় তার স্থাপত্য বৈশিষ্ট। মাঝে বিশাল উঠোন এবং তার উত্তর দিকে ঠাকুর দালান। এবং এর ঠিক উল্টো দিকে, অর্থাৎ, দক্ষিণ দিকে ঐতিহাসিক নাট্যমঞ্চ। যেটাকে জোড়াসাঁকো নাট্যমঞ্চ বলা হয়ে থাকে। এই নাট্যমঞ্চে বাড়ির মহিলারা রাম ভবন, মহর্ষি ভবনের বারান্দায় বসে অভিনয় দেখতে পেতেন৷ ঠাকুর বাড়ির আধুনিক প্রজন্মের মেয়েরা অংশগ্রহণ করছেন বিভিন্ন নাটকে ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে৷ যেমন অনেকের মধ্যে একটি নাটকের কথা খুব উল্লেখযোগ্য সেটা হচ্ছে বাল্মীকি প্রতিভা৷ যেখানে ঠাকুর বাড়ির মেয়েরা এবং রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে সব ব্যক্তিত্বরা এখানে অভিনয় করেছেন৷বোধ করি সেসময়ে ঠাকুর পরিবারই শিক্ষাদীক্ষায় ঐতিহ্য সাংস্কৃতিতে একক নেতৃত্বে ছিলো। ঠাকুর পরিবারের ইতিহাস থেকে থেকে জানা যায়, পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে যশোহর জেলার চেঙিগুটিয়ার জমিদার দক্ষিণানাথ রায়চৌধুরীর চার পুত্রের (কামদেব, জয়দেব, রতিদেব ও শুকদেব) প্রথম দুজন মুসলিম সাধক পীর আওলিয়ারদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। অপর দুই ভাই, রতিদেব ও শুকদেব হিন্দু ধর্মে থেকে গেলেও সেই সময়কার সমাজনীতি অনুসারে তাঁরা সমাজচ্যুত হয়ে (পীরালি) পিরালি-ব্রাহ্মণ হিসেবে পরিচিত হলেন। এদিকে, সমাজচ্যুত হওয়ায় অন্য ব্রাহ্মণ পরিবারের সঙ্গে তাঁদের বিবাহ ইত্যাদি বন্ধ হয়ে গেল, ফলে তাঁরা পুত্র-কন্যাদের বিয়ে দিতে কিছু কৌশল অবলম্বন করলেন। কনিষ্ঠ শুকদেব রায়চৌধুরী পিঠাভোগের জমিদার জগন্নাথ কুশারী নামে এক উচ্চ শ্রেণির ব্রাহ্মণের সঙ্গে তাঁর কন্যার বিয়ে দিলেন।
জমিদার হলেও পিরালির মেয়েকে বিবাহের অপরাধে জগন্নাথ সমাজ পরিত্যক্ত হলেন। তিনি শ্বশুর শুকদেবের সহায়তায় বারোপাড়া গ্রামে বসতি স্থাপন করলেন। এই জগন্নাথ কুশারীই ঠাকুর বংশের আদিপুরুষ। জোব চার্নকের কলকাতা আগমনের সমসাময়িক কালে অর্থাৎ সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে জগন্নাথেরই এক উত্তর-পুরুষ পঞ্চানন এবং তাঁর কাকা শুকদেব ভাগ্যান্বেষণে কলকাতা অঞ্চলে আসেন। কলকাতা তখন শুধুমাত্র একটি পরগনা, কিন্তু পর্তুগিজ, ডাচ বণিকদের দৌলতে
ব্যবসা-বাণিজ্যের একটা বড় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। হাটখোলা-সুতানুটি অঞ্চল ছিল তার অন্যতম ঘাঁটি। কাকা-ভাইপো কলকাতায় এসে বিদেশি বণিকদের জাহাজে মালপত্র সরবরাহের কাজ আরম্ভ করলেন। তারপর কলকাতা গ্রামের দক্ষিণে গোবিন্দপুর অঞ্চলে জমি কিনে বসতবাড়ি তৈরি করলেন। বর্ণে ব্রাহ্মণ বলে গ্রামবাসীরা তাঁদের ঠাকুরমশাই বলে সম্বোধন করত, সেই দেখে সাহেবরাও তাঁদের ওই ‘ঠাকুর’ বলেই ডাকতো, কালক্রমে সেই ঠাকুর সাহেবি উচ্চারণে ‘ট্যাগোর’-এ রূপান্তরিত হল। পলাশির যুদ্ধের পর ইংরেজরা গোবিন্দপুর অঞ্চলে নতুন কেল্লা তৈরির সময়ে ওই অঞ্চলের আরও অনেক পরিবারের সঙ্গে ঠাকুরদেরও উঠে যেতে হতে হল। ক্ষতিপূরণের টাকায় পঞ্চাননের নাতি নীলমণি পাথুরিয়াঘাটায় জমি কিনে বাড়ি তৈরি করলেন। সূচনা হল পাথুরিয়াঘাটা-ঠাকুর পরিবারের। কিছুকাল পরে, সম্পত্তি নিয়ে ভাই দর্পনারায়ণের সঙ্গে মতান্তর হলে, নীলমণি কুশারী গৃহদেবতা লক্ষ্মী-জনার্দনকে নিয়ে সপরিবারে পাথুরিয়াঘাটা ত্যাগ করে জোড়াসাঁকো অঞ্চলে ১৭৮৪-সালের জুন মাসে লক্ষ্মী-জনার্দনের নামে বৈষ্ণবচরণ শেঠের দেওয়া এক বিঘা জমির উপর বাড়ি তৈরি করলেন। প্রতিষ্ঠা হল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির। নীলমণির নাতি দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময় থেকেই এই পরিবারের স্বর্ণযুগের সূচনা। রামমোহন রায়ের প্রভাবে তারা একেশ্বরবাদী ঐশ্বরিক ধর্মে বিশ্বাসী হতে আরম্ভ করেন। দেবেন্দ্রনাথ প্রথম জীবনে পিতার আদর্শে একেশ্বরবাদী ভাবধারায় প্রভাবিত হয়েছিলেন।
পুরনো ঐতিহ্যবাহী বাড়িগুলির মধ্যে নীলমণির তৈরি করা আদি বাড়িটি (এখন সেটি ‘মহর্ষি ভবন’ নামে পরিচিত) ছাড়াও এই চত্ত্বরে এখন রয়েছে ‘রাম ভবন’, ‘বিচিত্রা ভবন’, ‘বকুলতলা ভবন’-এর একাংশ এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৈরি করা নামহীন বাড়িটি।
১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ, সোমবার, রাত্রি ২টো ২৮ মিনিটে (ইংরেজি মতে ৭ মে ১৮৬১)জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহন করেন। তার আশি বছর পরে, ২২শে শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে (৭ আগস্ট, ১৯৪১) তাঁর প্রয়াণও হয় সেই বাড়িতেই। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ছিল ঠাকুর পরিবারের সদস্যদের দখলেই। জীর্ণ সেই বাড়িতে পরিবারের কেউ কেউ বাস করতেন আর বাকি অংশে ভাড়া ছিল নানা দোকান, গুদামঘর হিসাবে।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকীতে পশ্চিম বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বাড়িটি রবীন্দ্রভারতী সোসাইটির কাছ থেকে অধিগ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালের ৮ই মে পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু ৩৫ হাজার বর্গ মিটারের এই বাড়িতে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন রবীন্দ্র ভারতী মিউজিয়াম। এবং একটি মিউজিয়াম গড়ে তোলা হয়। সত্তরের দশকে বিটি রোডে এই ঠাকুর পরিবারেই আর এক শাখা পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুর পরিবারের যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের ‘মরকত কুঞ্জ’-এ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস তৈরি হলে বিভিন্ন বিভাগ সেখানে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে জোড়াসাঁকোর বাড়িটি পুরোটাই রবীন্দ্র-প্রদর্শশালা হিসাবে ব্যবহৃত হতে থাকে (শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রভবনেও রয়েছে আরও একটি রবীন্দ্র-প্রদর্শশালা)। ঐতিহ্যবাহী এই বাড়ির প্রতিটা ইঁট, কাঠ, পাথরের মধ্যেই ছড়িয়ে আছে শিল্প এবং ঐতিহ্য। ‘হেরিটেজ প্রিজারভেশন’ নামের এই সংস্কার প্রকল্পটিতে পুরো ঠাকুরবাড়ি চত্ত্বরের হারিয়ে যাওয়া স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে।
৪টি ভবনের ১৮টি গ্যালারি জুড়ে রবীন্দ্রভারতী মিউজিয়াম। মূল বাড়িটি আয়তাকার। দোতলায় উঠেই হাতের বাদিকে যে ঘরটি পড়ে সেটি ছিলো রবীন্দ্রনাথের খাবার ঘর, তার সাথেই লাগোয়া মৃণালিনীর হেঁসেল। পাশে সঙ্গীতের ঘর, এরপর মহাপ্রয়াণের ঘর। ১৯৪১ এর ৩০শে জুলাই এ ঘরেই কবিগুরু তাঁর শেষ কবিতা, ‘তোমার সৃষ্টির পথ’ এর ডিক্টেসন দিয়েছিলেন। এর মাত্র সাতদিন পর তিনি পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।
দু’টি আর্ট গ্যালারিও রয়েছে এই ভবনে, একটি প্রাচ্য আর একটি পাশ্চাত্যের ধারার। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যামিনীরায়, নন্দলাল বসুসহ আরও অনেক নাম করা শিল্পীর আঁকা ছবি আছে এখানে। বাংলাদেশি কারো আঁকা ছবি থাকলে খুশি হতাম। নোবেল পুরষ্কারের গ্যালারিটিও চমকপ্রদ। গীতাঞ্জলি ও নোবেল পুরষ্কারের টুকরা টাকরা গল্প ছাড়াও নাইটহুড বর্জনের কারণ বর্ণনা করে ইংরেজ সরকারকে লেখা পত্রের কপিটিও আছে এখানে।
জাপান ও চীন সরকারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত গ্যালারি দু’টিও মনে রাখার মত। মূল ভবনের পাশের ভবনটির নাম বিচিত্রা। ১৯৬০ সালের আগ পর্যন্ত এই ভবনটি ছিলো বিশ্ব ভারতীর অংশ। বিচিত্রার দো’তলায় ভিক্টোরিয়া হল, আর মৃণালিনী দেবীর ঘরটা ভালো লেগেছে। ভিক্টোরিয়া হলে শিলাইদহ কুঠিবাড়ির কিছু ছবি। রবীন্দ্রনাথ যে বোটে করে ঘুরে বেড়াতেন পদ্মায় সেই বোটের একটি চমৎকার প্রতিকৃতিও আছে এখানে, বাংলাদেশ সরকারের উপহার হিসাবে। তিন তলায় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ আর সারদা দেবীর ঘর সংসার। সারদা দেবী ছিলেন আমাদের যশোরের মেয়ে। ৮ বছর বয়সে তিনি ঠাকুরবাড়ি এসেছিলেন বউ হয়ে। ঠাকুর বাড়ির দু’জন দুঃখী মানুষের একজন সারদা আর অন্য জন মৃণালিনী। সারদা তো তবু নিজের নামটা নিয়ে বেঁচেছিলেন, মৃণালিনীর নামটিও বদলে দিয়েছিলো ঠাকুর বাড়ি। খুলনার ফুলতলার বেনীমাধব রায় চৌধুরির মেয়ে ভবতারিনী দেবী দশ বছর বয়সে যেদিন এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিলো ২২। আটপৌরে ভবতারিণী নাম ঠাকুর বাড়িতে মানাবে কেন? রবীন্দ্রনাথের বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের পছন্দে তাঁর নতুন নাম হলো মৃণালিনী। এরপর যে ১৯ বছর তিনি বেঁচে ছিলেন, সেখানে তাঁর নিজস্ব ভূমিকার কথা খুব একটা জানা যায়না। সারদা দেবীর জীবন তাও মৃণালিনীর চেয়ে একটু ভালো ছিলো, কর্তার দেখা খুব একটা না পেলেও সংসারের কর্তৃত্ব ছিলো তাঁর।
রবীন্দ্র ভারতী মিউজিয়ামের লাইব্রেরিটিও সমৃদ্ধ নানান দুষ্প্রাপ্য বইয়ে। দেশ বিদেশের বিভিন্ন জার্নাল এখানে নিয়মিত আসে। এখানে সানজিদা খাতুনের বই দেখে ভালো লাগলো। উপরে যেহেতু ছবি তোলা নিষেধ, ছবি তোলার জন্যে এলাম নীচ তলার অন্দর মহলে। এখানে ছবি তুলতেও কুপন সংগ্রহ করতে হয়।আয়তাকার উঠোনের একদিকে স্থায়ী মঞ্চ আর একদিকে পুজোর ঘর,পরবর্তীতে এখানেই হত ব্রাহ্ম সমাজের সভা। মূল বাড়ির বাইরের দিকের একটি ভবনে আছে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত একটি গাড়ি। গাড়িটির নম্বর WGF 91 সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই মিউজিয়ামের বিভিন্ন নিদর্শনের বর্ণনার জন্যে ব্যবহৃত হয়েছে, ঠাকুর পরিবারেরই কারোনা কারোর লেখা বা কবিতার অংশ। পাঁচটায় বন্ধ হয়ে যায় ঠাকুর বাড়ির দরজা। তাই আমরা আর দেরী না করেই চলে আসলাম জোড়াসাঁকো মোহমায়া থেকে।