জন্ম: ৩ মে ১৯২৯, 
মা: সৈয়দা হামিদা বেগম,
বাবা: আবদুল আলী,
মৃত্যু: ২৬ জুন ১৯৯৪,
মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যিনি আমৃত্যু লড়াই করেছেন, যিনি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতা বিরোধীদের বিচারের দাবীতে গড়ে তুলেছিলেন ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’, তিনি শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। ত্রিশ ও চল্লিশ দশকের রক্ষণশীল বাঙালি মুসলমান পরিবার বলতে যা বোঝায়, সে রকম একটি পরিবার জাহানারা ইমামের। ১৯২৯ সালের ৩ মে অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামের এক রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন তিনি। জাহানারা ইমামের ডাক নাম জুড়ু। পিতা আবদুল আলী ও মা সৈয়দা হামিদা বেগম।
ছোটবেলা থেকে রবীন্দ্রনাথ এবং শান্তিনিকেতন বিষয়ে জাহানারা ইমাম প্রবলভাবে আগ্রহী করে তুলেছিলেন এক গৃহশিক্ষক। জাহানারা ইমামের স্বপ্ন ছিলো- বড় হয়ে শান্তিনিকেতনে পড়তে যাবেন। তার বাবা রাজিও ছিলেন। ডাকযোগে শান্তিনিকেতনে ভর্তির প্রসপেকটাসও এসে পড়েছিলো। কিন্তু তাঁর সে স্বপ্ন সফল হয়নি। ১৯৪১ সালের ৯ আগস্ট পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর খবর পড়ে তাঁর শান্তিনিকেতন যাবার স্বপ্নের মৃত্যু হয়। বয়ঃসন্ধিকালে জাহানারা ইমামের প্রধান আশ্রয় ছিলো বই। নভেল। ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট বাবার কল্যাণে বাড়িতে নিয়মিত আসতো পত্রপত্রিকা। জাহানারা ইমামের পাঠতৃষ্ণাকে উসকে দিয়েছিল দৈনিক আনন্দবাজার, অমৃতবাজার, আজাদ, ষ্টেটসম্যান, সাপ্তাহিক শনিবারের চিঠি, ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া, মাসিক ভারতবর্ষ, প্রবাসী, বসুমতি আর মোহাম্মদী। আর পড়াশোনার পাশাপাশি অবসর জীবনে বিনোদন বলতে শুধু কলের গান। তাঁর বাবা হিজ মাস্টারস ভয়েস-এর একটা গ্রামোফোন ও রেকর্ড কিনে আনবার পর আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, হরিমতী, কৃষ্ণচন্দ্র দে, কমলা ঝরিয়া, আব্বাসউদ্দিন আহমদ, কনক দাস, শাহানা দেবী, যুথিকা রায়ের গান হয়ে ওঠে তার বিনোদনের সঙ্গী।
বাংলা সাহিত্য এবং বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন একজন গৃহশিক্ষক। জাহানারা যখন ক্লাস সেভেনের ছাত্রী গৃহশিক্ষকের কল্যাণেই সেই সময়ে টলস্টয়, দস্তয়েভস্কি, ভিকটর হুগো, সেলমা লেগারলফ, শেক্সপীয়র, বার্নাড শ, ন্যুট হামসুন-এর অনেক বইয়ের বাংলা অনুবাদ পড়েছিলেন। জাহানারা ইমামের শৈশবকালে মুসলিম পরিবারের মেয়েদের নিকট আধুনিক শিক্ষালাভের দ্বার উন্মুক্ত ছিল না। তবে তিনি তাঁর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পিতা আবদুল আলীর তত্ত্বাবধানে রক্ষণশীলতার বাইরে এসে আধুনিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন। পিতার চাকরিসূত্রে জাহানারা ইমাম বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন। মেট্রিক পাস করেন ১৯৪২ সালে। ১৯৪৪ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে আইএ পাস করে, ১৯৪৫ সালে ভর্তি হন কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজে। লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে বি.এ পাস করেন ১৯৪৭ সালে। এরমাঝে ১৯৪৮ সালের ৯ আগস্ট সিভিল ইঞ্জিনিয়ার শরীফুল আলম ইমাম আহমদের সঙ্গে  জাহানারা ইমাম এর বিয়ে হয়। স্বামীর চাকরি ঢাকায় হওয়ার বিয়ের পর তিনিও ঢাকায় চলে আসেন। বাবার মতো বিবাহিত জীবনে লেখাপড়ায় তিনি প্রকৌশলী স্বামী শরীফ ইমামের দিক থেকেও উৎসাহ ও আনুকূল্য পেয়েছিলেন।
১৯৫১ সালের ২৯ মার্চ জাহানারা ইমামের কোল জুড়ে আসে বড় ছেলে শাফী ইমাম রুমী। আর ১৯৫৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর জন্ম হয় ছোট ছেলে সাইফ ইমাম জামীর। ১৯৬০ সালে বি. এড ডিগ্রি অর্জন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬৪ সালে। ১৯৬৫ সালে তিনি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম এ করেন।
শিক্ষক হিসেবে তার কর্মময় জীবন শুরু হয় বিয়ের আগেই। ময়মনসিংহ শহরের বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসাবে ১৯৪৮ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি কর্মরত ছিলেন। এরপর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত। এরপর বুলবুল একাডেমি কিন্ডার গার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে কর্মরত থাকেন ১৯৬২ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত। ১৯৬৬ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬৮-র দিকে সে চাকরি ছেড়ে দেন। তিনি কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবেও কাজ করেন।
বড় ছেলে রুমীর বয়স তখন ১৯ বছর। রুমী  ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন দুঃসাহসী গেরিলার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করে শাহাদৎ বরণ করেন। যুদ্ধের শেষ দিকে রুমী ধরা পড়েন এবং পাকবাহিনীর নির্মম অত্যাচারে শহীদ হন। অন্যদিকে স্বামী শরীফ ইমামকেও পাকিস্তানী হানাদাররা নির্মম নির্যাতন করে আহত অবস্থায় মুক্তি দেয়। নিজের অসুস্থ শরীর তার উপর রুমীর এমন চলে যাওয়া সইতে পারেন নি শরীফ ইমাম।
বিজয়ের মাত্র তিনদিন আগে ১৩ ডিসেম্বর শরীফ ইমাম হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। সেদিনই তিনি হাসপাতালে মারা যান। বিজয়ের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে শরিফ ইমামের চলে যাওয়া যুদ্ধ বিজয়ের আনন্দটুকু জাহানারা ইমামের বিষাদে ছেয়ে যায়। বিজয় লাভের পর রুমীর বন্ধুরা রুমীর মা জাহানারা ইমামকে সকল মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে বরণ করে নেন। তখন থেকেই তিনি ‘শহীদ জননী’র মর্যাদায় ভূষিত। স্বাধীনতার পর শহীদ রুমী বীরবিক্রম (মরণোত্তর) উপাধিতে ভূষিত হন।
কলেজে পড়ার সময় জাহানারা ইমাম সহপাঠী অঞ্জলির মাধ্যমেই কমিউনিজমের পাঠ নেন। অঞ্জলি তাকে এ সংক্রান্ত বইপত্র পড়তে দিতেন। কিন্তু বাবা যথেষ্ট উদার হলেও কমিউনিস্টদের পত্রিকা ‘জনযুদ্ধ’ দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ভর্ৎসনা করেছিলেন। মেয়ে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকুক এটা তিনি চাননি। স্বামী শরীফও চাননি। তাই তখন জাহানারা ইমামকে রাজনীতির পথ ত্যাগ করতে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে জাহানারা ইমামের নাম ছড়িয়ে পরে তাঁর সামাজিক-রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য। অতীতে তিনি রাজনীতি সচেতন হলেও রাজনীতিবিদ ছিলেন না, স্বামী ও বড় সন্তানের শহীদ হওয়া, যুদ্ধের ভয়াবহতা  তাঁকে রাজনীতির অঙ্গনে নিয়ে আসে।
যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবিতে নব্বইয়ের দশকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমীর ঘোষণা করলে বাংলাদেশে জনবিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। বিক্ষোভের অংশ হিসেবে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয় জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে। তাঁকেই এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয়। এই কমিটি ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ ‘গণআদালত’-এর মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের ঐতিহাসিক বিচার অনুষ্ঠিত করে।
১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে গণআদালতের প্রথম বার্ষিকীতে জাহানারা ইমামের নেত্রত্বে গণতদন্ত কমিটি ঘোষিত হয় এবং আটজন যুদ্ধাপরাধীর নাম ঘোষণা করা হয়। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট গোলাম আযমসহ ’৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবির আন্দেলনকে সমর্থন দেয়। জাহানারা ইমাম গণআদালতের রায় কার্যকর করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। এই গণআদালতের সদস্য ছিলেনঃ এডভোকেট গাজিউল হক, ডঃ আহমদ শরীফ, মাজহারুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, সুফিয়া কামাল, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফী, শওকত ওসমান, লেঃ কর্ণেল (অবঃ) কাজী নুরুজ্জামান, লেঃ কর্ণেল (অবঃ) আবু ওসমান চৌধুরী এবং ব্যারিস্টার শওকত আলী খান।
শিক্ষকতার পেশা থেকে বেরিয়ে তিনি নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। ব্যক্তিত্বময়ী জাহানারা ইমাম ষাটের দশকেই ঢাকার সংস্কৃতি মহলে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি ‘গার্লস গাইড’, ‘পাকিস্তান উইমেন্স ন্যাশনাল গার্ড’, ‘খেলাধুলা’, ‘অল পাকিস্তান উইমেন্স এসোসিয়েশন’ এবং বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি ঢাকা বেতারে উপস্থাপিকা হিসেবে অনেক দিন অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন। জাহানারা ইমাম বাংলাদেশ টেলিভিশনে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছেন। তিনি ‘ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি মঞ্চে’ শেক্সপিয়ারের একটি নাটকে অভিনয়ও করেছিলেন। এছাড়াও জাহানারা ইমাম ১৯৬০ সালে এডুকেশনাল বোর্ডের প্রতিনিধি হয়ে সিলেবাস সেমিনারে যান পশ্চিম পাকিস্তানের পেশোয়ারে। পাকিস্তান অলিম্পিক গেমস-এ খেলোয়াড়দের নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। তিনি বাংলা একাডেমীর কার্যনির্বাহী পরিষদে জুলাই ১৯৮০ সাল থেকে জুলাই ১৯৮২ সাল পর্যন্ত সদস্য ছিলেন।
ষাট ও সত্তর দশকে সাহিত্যজগতে জাহানারা ইমাম অল্প-বিস্তর পরিচিত ছিলেন শিশুকিশোর উপযোগী রচনার জন্য। কিন্তু তাঁর সর্বাধিক খ্যাতির কারণ দিনপঞ্জিরূপে লেখা তাঁর অনবদ্য গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি পুত্র রুমী ও স্বামীকে হারান। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস কেটেছে তাঁর একদিকে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও ত্রাসের মধ্য দিয়ে; অন্যদিকে মনের মধ্যে ছিল দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার স্বপ্ন। সেই দুঃসহ দিনগুলিতে প্রাত্যহিক ঘটনা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার বৃত্তান্ত লিখেছিলেন তিনি নানা চিরকুটে, ছিন্ন পাতায়, গোপন ভঙ্গি ও সংকেতে। ১৯৮৬ সালে গ্রন্থরূপ পাওয়ার পর তা জনমনে বিপুল সাড়া জাগায়। বস্তুত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি শিহরণমূলক ও মর্মস্পর্শী ঘটনাবৃত্তান্ত হলো ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থটি।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জাহানারা ইমাম লেখালেখিতে ব্যস্ত সময় কাটান। তাঁর প্রধান গ্রন্থগুলি এ সময়েই প্রকাশ পায়।  ছোটদের পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন। ১৯৬৭ সালে ‘গজকচ্ছপ’, ১৯৭৩ সালে ‘সাতটি তারার ঝিকিমিকি’ ও ১৯৮৯ সালে ‘বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ শিশু সাহিত্য সম্পাদনা করেন। গল্প, উপন্যাস ও দিনপঞ্জি জাতীয় রচনা মিলিয়ে তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ রয়েছে। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: অন্য জীবন (১৯৮৫), বীরশ্রেষ্ঠ (১৯৮৫), জীবন মৃত্যু (১৯৮৮), চিরায়ত সাহিত্য (১৯৮৯),শেক্সপীয়রের ট্রাজেডি (১৯৮৯),বুকের ভিতরে আগুন (১৯৯০), নাটকের অবসান (১৯৯০), দুই মেরু (১৯৯০), নিঃসঙ্গ পাইন (১৯৯০), নয় এ মধুর খেলা (১৯৯০), ক্যানসারের সঙ্গে বসবাস (১৯৯১) ও প্রবাসের দিনলিপি (১৯৯২)। বাংলা উচ্চারণ অভিধান (যৌথভাবে সম্পাদিত) (১৩৭৫), An Introduction to Bengali Language and Literature (Part-I)(1983)
জাহানারা ইমাম মুলত শিশু সাহিত্য রচনা করতেন, করতেন অনুবাদ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন বই লিখেছেন। লেখালেখির জন্যে পেয়েছেন অনেক জাতীয় পুরস্কার।  স্বাধীনতা পদক (১৯৯৭), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮), কমর মুশতরী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮), বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১), নারী গ্রন্থ প্রবর্তনা (১৯৯৪), রোকেয়া পদক (১৯৯৮), অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (২০০১),ইউনিভার্সাল শিল্পী গোষ্ঠী পুরস্কার (২০০১), প্রভৃতি পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ১৪০১ সনের পয়লা বৈশাখ ‘আজকের কাগজ’ তাঁকে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দেয়। এ পুরস্কার গ্রহণের আগেই ১৯৯৪ এর ২ এপ্রিল তিনি চিকিৎসার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওনা হন।
আশির দশকের শুরুতে ১৯৮১-র দিকে জাহানারা ইমাম মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। রোগ উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে, কথা বলাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। প্রতি বছর একবার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হতো তাঁকে। ২৬ মার্চ ১৯৯৩ সালে মহান স্বাধীনতা দিবসে গণআদালত বার্ষিকীতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণতদন্ত কমিটি ঘোষিত হয় এবং আরো আটজন যুদ্ধাপরাধীর নাম ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৩ সালের ২৮ মার্চ ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সমাবেশে পুলিশ বাহিনী হামলা চালায়। পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন জাহানারা ইমাম। পরে তাকে পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু কর্কট রোগ তাঁর কর্মস্পৃহা ও আদর্শকে বিন্দুমাত্র স্তিমিত করতে পারেনি। সকল ব্যথা-বেদনা উপেক্ষা করে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির কর্মকান্ড সমান উৎসাহে চালিয়ে যেতে থাকেন।
২ এপ্রিল ১৯৯৪ হাসপাতালে ভর্তি হলে উনার চিকিৎসা চলতে থাকে। অসুস্থতার কারণে বাকশক্তি হারিয়ে ফেললে ছোট ছোট চিরকুট লিখে প্রিয়জনদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা চালিয়ে যেতেন তিনি। ২২ এপ্রিল চিকিৎসকরা জানান, চিকিৎসার আওতার সম্পূর্ণ বাইরে চলে গেছেন তিনি। তাঁর মুখগহ্বর থেকে ক্যান্সারের বিপজ্জনক দানাগুলো অপসারণ করা আর সম্ভব নয়। বাকশক্তি হারিয়ে কথা বলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো তাঁর। ১৯৯৪ সালের ২২ জুনের পর থেকে তার অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে শুরু করে। সব ধরনের খাবার গ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়। চিকিৎসকরা ওষুধ প্রয়োগও বন্ধ করে দেন। ২৬ জুন ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় মিশিগানের ডেট্রয়েটের সাইনাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ৬৫ বছর বয়সী শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।
তাঁর মৃত্যুতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি ২৮ জুন থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত শোক সপ্তাহ এবং ৬ জুলাই জাতীয় শোক দিবস পালন করে। ৪ জুলাই বিকেলে বাংলাদেশে আসে শহীদ জননীর মরদেহ তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বর্তমান শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সমন্বয় কমিটির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে শহীদ জননীর লাশ গ্রহণ করেন জাতীয় সংসদের তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী এখনকার প্রধান মন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ৫ জুলাই সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শহীদ জননীর কফিন রাখা হয় জনগণের শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যে। দুপুরে যোহরের নামাযের পর জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় তাঁর নামাযের জানাযা।
জানাযা শেষে শহীদ জননীকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা গোরস্থানে সমাহিত করা হয়। এ সময় মুক্তিযুদ্ধের আটজন সেক্টর কমান্ডার শহীদ জননীকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় হলো বিভিন্ন মহল থেকে শহীদ জননীকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করার দাবি উত্থাপিত হলেও তা কার্যকর হয়নি। ইহা আমাদের জন্যে লজ্জার, আমাদের জন্যে অপমানের। রাজনৈতিক রোসানলের কারণে এমন একজন শহীদ জননীকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া হয়নি। ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের কণিকা বাসবভনটি তাঁর আন্দোলন সংগ্রামঘন দিনগুলোর স্মৃতি বহন করে। তাঁর ছেলে জামী, পুত্রবধূ ফ্রিডা ও দুই নাতনী লিয়ানা ও লিনিয়া বর্তমানে আমেরিকায় বসবাস করছেন।
লেখক: সাহিত্যিক, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here