স্টাফ রিপোর্টার :: মিয়ানমারের পক্ষ থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জোর প্রস্তুতি শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থাসহ বিভিন্ন এনজিওর সমন্বয়ে এই কার্যক্রম চলছে।

রোহিঙ্গাদের দেয়া শর্ত মিয়ানমার সরকার পূরণ করবে কিনা- এ নিয়ে স্পষ্ট ঘোষণা না আসায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে। এ নিয়ে কক্সবাজারের আশ্রয় শিবিরগুলোতে দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে।

মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জ তাই গত শুক্রবার জানান, আগামী ২২ আগস্ট ৩ হাজার ৪৫০ রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবে তারা। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে।

বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম সোমবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, মিয়ানমার সরকারের দেয়া প্রস্তাব রোহিঙ্গারা মেনে নিলে প্রত্যাবাসন শুরু হবে। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার তত্ত্বাবধানে যৌথভাবে এই কার্যক্রম পরিচালিত হবে বলেও জানান তিনি।

এদিকে বিভিন্ন শিবিরে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিজ জন্মভূমি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ফিরতে প্রস্তুত তারা।

তবে নাগরিকত্ব প্রদান, ভিটে-জমি ফিরিয়ে দেয়া, মিয়ানমারে আটকদের মুক্তি, হত্যা, গণধর্ষণ ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের বিচারসহ নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, কোনো কোনো রোহিঙ্গা বিনা শর্তে ফিরতে রাজি থাকলেও তাদের নেতাদের ভয়ে মুখ খুলতে চাইছে না।

দায়িত্বরত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টেকনাফের ২৩, ২৪, ২৬ ও ২৭ নম্বর ক্যাম্পের পক্ষ থেকে প্রত্যাবাসনের জন্য ৩ হাজার ৪৫০ জনের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। তালিকায় কাদের নাম রয়েছে তা গোপন রাখা হয়েছে।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল হাসান বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য নিজ নিজ ক্যাম্পের ইনচার্জ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনও কাজ করছে। তবে কতজনকে প্রত্যাবাসন করা যাবে তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।

টেকনাফ নয়াপাড়া শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইনচার্জ মো. খালিদ হোসেন বলেন, প্রত্যাবাসনের জন্য রোহিঙ্গাদের তালিকা হাতে পেয়েছি। অনেক রোহিঙ্গা পরিবারের কাছে বার্তা পৌঁছানো হয়েছে।

যাদের কাছে বার্তা পৌঁছেনি, তাদের মঙ্গলবারের মধ্যে জানিয়ে দেয়া হবে। এজন্য এনজিও কর্মকর্তা, রোহিঙ্গা মাঝিদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। সেখানে প্রত্যাবাসনের বিষয়সহ ক্যাম্পের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কাউকে জোরপূর্বক প্রত্যাবাসন করা হবে না। ক্যাম্পের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।

জানা গেছে, সোমবার শরণার্থী সংস্থার প্রতিনিধি, ক্যাম্প ইনচার্জ (সিআইসি), এনজিও কর্মকর্তা ও রোহিঙ্গা মাঝিদের মধ্যে শালবাগান ক্যাম্পে একাধিক বৈঠক হয়েছে। রোহিঙ্গা নেতা মো. জাকারিয়া জানান, দুপুরের আগেই তিনটি বৈঠক হয়। সেখানে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আলাপ হয়েছে। জোর করে কাউকে পাঠানো হবে না বলে কর্মকর্তারা আশ্বস্ত করেছেন।

তিনি বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে নাগরিক অধিকারের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। এসব দাবি পূরণ হলে স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরবে রোহিঙ্গারা।

এদিন টেকনাফের সদর ইউনিয়নের কেরণতলী প্রত্যাবাসন ঘাটে কয়েকজন শ্রমিককে কাজ করতে দেখা যায়। এ সময় প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করা একটি দল প্রত্যাবাসন কেন্দ্রের বিভিন্ন স্থান ও কক্ষ ঘুরে দেখেন।

শ্রমিক সৈয়দ নুর ও মোহাম্মদ কলিম বলেন, এখান থেকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কথা রয়েছে। ক্যাম্প ইনচার্জের নির্দেশে কয়েক দিন ধরে প্রত্যাবাসন ঘাটে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছি।

প্রত্যাবাসন ঘাটে দায়িত্বরত ১৬ আনসার ব্যাটালিয়নের হাবিলদার মোহাম্মদ আইনুল হক বলেন, শুনেছি কয়েক দিনের মধ্যে এই ঘাট দিয়ে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফেরত যাবে।

একই দিন নয়াপাড়া শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্প (২৬ নম্বর) সিআইসি কার্যালয়ের পাশে ছোট ছোট ঘর নির্মাণ করতে দেখা যায়। যারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফেরত যাবে, তাদের এসব ঘরে রাখা হবে বলে জানান রোহিঙ্গা নেতারা। এ ছাড়া ক্যাম্প ইনচার্জের পক্ষ থেকে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে ক্যাম্প-২৭ এর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বশর বলেন, জন্মভূমিতে ফিরতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। তবে হঠাৎ করে প্রত্যাবাসনের বার্তা পেয়ে আমরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ। ক্যাম্পের একটি ব্লকের মাঝি মো. নুর বলেন, মিয়ানমার সরকার সেখানেও ক্যাম্পে রেখে তদন্তসাপেক্ষে কোথায় রাখা হবে এসব সিদ্ধান্ত নেবে।

এসব সিদ্ধান্ত এখনও কেউ জানে না। এতদিন ধরে আমরা ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ডের (এনভিসি) বিপক্ষে ছিলাম। এখন প্রত্যাবাসনের সময় এনভিসি কার্ড ধরিয়ে দেয়া হবে। এটা রোহিঙ্গারা মেনে নেবে না।

তারা জানান, সম্প্রতি সফর করা মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলকে চারটি শর্তের কথা জানানো হয়। এ নিয়ে আলোচনার কথা রয়েছে। এসব বিষয় সম্পন্ন না হলে রোহিঙ্গারা ফিরবে না।

ওদিকে দেশ-বিদেশ থেকে ভয়েস কল ও অনলাইন রেডিওর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রত্যাবাসনবিরোধী প্রচারণা চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর প্রত্যাবাসন শুরুর কথা থাকলেও শর্ত পূরণ না হওয়ায় রোহিঙ্গারা তাতে রাজি হয়নি।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর জাতিগত নিধন অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। এতে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত সাড়ে ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here