নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে ৭৭টি কিন্ডারগার্টেন স্কুল। এসব প্রতিষ্ঠানের কোমলমতি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা তাদের ওপর স্কুল কর্তৃপড়্গের নানা কৌশলে চাপিয়ে দেওয়া তথাকথিত নিয়মনীতিতে নূব্জ্য হয়ে পড়েছে। এক শ্রেণীর মুনাফালোভী ব্যক্তি স্বঘোষিত অধ্যক্ষ বা প্রিন্সিপাল সেজে কিন্ডারগার্টেনের নামে এসব প্রতিষ্ঠান খুলে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। সরকারের সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি না থাকায় ব্যবস্থা নিতে পারছে না স্থাণীয় প্রশাসন। এ যেন দেখার কেউ নেই।

বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, দুই দশক ধরে রূপগঞ্জ উপজেলার অলিতে গলিতে কোমলমতি শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার কথা বলে গড়ে উঠছে কিন্ডারগার্টেন নামের ৭৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এক শ্রেণীর শিক্ষিত বেকার ও অর্ধ-শিক্ষিত যুবকরা স্বল্প বিনিয়োগে অধিক লাভের জন্য এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। শিক্ষার কথা বললেও মূলত তারা এসবকে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানে সরকারি কোনো নিয়ম-নীতি মেনে চলা হয় না। নেই কোনো স্কুল পরিচালনা পরিষদ। যে কোনো স্থানে একটি বাড়ি বা ঘর ভাড়া নিয়ে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে চলছে এসব স্কুল নামে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। এসব কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষিত বেকার বা অধ্যয়নরত কলেজ পড়ুয়া সুন্দরী মেয়েদের নাম মাত্র বেতনে নিয়োগ দিয়ে কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়া হয়। প্রথম দিকে রূপগঞ্জে হাতে গোনা কয়েকটি কিন্ডারগার্টেন গড়ে উঠলেও বর্তমানে গ্রামগঞ্জের আনাচে-কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বেশিরভাগ কিন্ডারগার্টেন স্কুলের মালিক নিজেই অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার ইচ্ছানুযায়ী নির্ধারণ করেন ভর্তি ফি ও মাসিক বেতন। অধিকাংশ স্কুলেই প্লে থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত শিশুদের পড়ানো হয়। প্লে ক্লাসে একজন শিশুর ভর্তি ফি ৫০০ টাকা থেকে শুরম্ন করে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত এবং প্রতি মাসে মাসিক বেতন ৩০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা ধরা হচ্ছে। আবার অনেক কিন্ডারগার্টেন মালিক অধিক লাভের জন্য ডাবল শিফট চালু করেছে। ফলে একই খরচে লাভের পরিমাণ দাঁড়ায় দ্বিগুণে। প্রতি শিফটে ক্লাস হয় আড়াই ঘন্টা ধরে। অনেকে আবার অধিক লাভ দেখে বিভিন্ন নামে ৩-৪টি কিন্ডারগার্টেন খুলে বসেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তির পর কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পোশাক, সোয়েটার, টাই, জুতা, খাতা, কলম, বই কিনতে হয় নিজ নিজ স্কুলের নির্দিষ্ট করা দোকান থেকে। পরে ওই দোকান থেকে একটি মোটা অঙ্কের টাকা কমিশন হিসেবে দেওয়া হয় স্কুল মালিক বা অধ্যড়্গকে। আবার কোনো কোনো ড়্গেত্রে সংশ্লিষ্ট কিন্ডারগার্টেনের মালিক নিজেই এসব উপকরণ তৈরি করে তা অধিক দামে বিক্রি করেন শিক্ষার্থীদের কাছে।

ভুলতা ইক্বরা কিন্ডারগার্টেন স্কুলের এক ছাত্রের অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করে বলেন, এ যেন মগের মুল্লুক। গলা কেটে ফি নিয়ে ইচ্ছামতো চালানো হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান। কোনো অভিভাবক কোনো বিষয়ে অভিযোগ করলেই তার ছেলেমেয়েকে রাখা হয় কড়া নজরদারিতে। এজন্য বাচ্চাদের কথা ভেবে ভয়ে নীরবে অনেকেই অভিযোগ জানান না। জানালেও কোনো লাভ হয় না।

সাওঘাট এলাকার প্রতিভা কিন্ডারগার্টেন স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানান, সড়ক ও জনপদ বিভাগের জমিতে স্কুল স্থাপন করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ উপজেলা শিক্ষা অফিসে স্কুলের পাশের বাসা বাড়িকে (পাকা বিল্ডিং) প্রতিভা কিন্ডারগার্টেন স্কুল দেখানো হয়েছে। এ স্কুলেও প্রতিবছর পিকনিকের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৫০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। মান-সম্মানের দিক চিন্তা করে নীরবে টাকা পরিশোধ করতে হয়। এ স্কুলে যেসব শিড়্গক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের বেতন ধরা হয়েছে ৫০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা। আবার অনেক স্কুলে শিড়্গকদের বেতনের কথা বাইরে বলাও নিষেধ আছে। কিন্ডারগার্টেনের বেতন নিয়ে কথা বলতেই এক ছাত্রের মা রীতা আক্তার জানান, স্কুল-কলেজ লেভেলের ছাত্র-ছাত্রীদের মাসিক বেতন ৪০-৫০ টাকা, অনার্স ও মাস্টার্সের বেতন যেখানে ৬০-৭০ টাকা। সেখানে প্লে বা নার্সারির মতো ক্লাসের শিক্ষার্থীদের বেতন ৩০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা হয় কীভাবে? তাছাড়া বিভিন্ন খাতের কথা বলেও অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়। কেন এবং কি জন্য এত বেতন, সরকারের সংশিস্নষ্ট বিভাগের কাছে কি এদের জবাবদিহিতা নেই। তিনি আরো জানান, অনেক অভিভাবক ছেলেমেয়েদের অনেক টাকায় ভর্তি ও বেশি বেতনের স্কুলে ভর্তি করানো সামাজিক মর্যাদার ব্যাপার বলে মনে করে থাকেন।

ভুলতা উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল আউয়াল মোলস্না জানান, শুধু প্রকাশনী সংস্থার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের কমিশনের জন্যই বাচ্চাদের ওপর জটিল জটিল বই নির্ধারণ করা হয়। বয়স অনুযায়ী জটিল বই পড়ে শিশুরা মানসিকভাবে ঝিমিয়ে পড়ে। ফলে ভয়ে তাদের লেখাপড়া থেকে মন সরে যায়। প্রতিষ্ঠানের মালিকদের ব্যবসায়িক মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষা বিস্তারের মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে।

এ ব্যাপারে রূপগঞ্জ উপজেলা কিন্ডারগার্টেন পরিচালক ও শিক্ষক সমিতির সভাপতি হাবিবুর রহমান হারেজ জানান, কিছু কিছু মুনাফালোভী ব্যক্তির কারণে এসব কথা আসছে। এছাড়া সরকারি কোনো নিয়মনীতি না থাকায় কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের ইচ্ছামতো ফি-বেতন আদায় করছে। সরকারি বিধি-নিষেধ না থাকায় তারা এসব করতেও সাহস পাচ্ছেন বলে তিনি মনে করেন।

এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদ প্রফেসার নুরুল ইসলাম জানান, উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক শ্রেণীর প্রতিষ্ঠানের প্রধান নিজেকে অধ্যড়্গ বা প্রিন্সিপাল লিখতে পারেন। এইচএসসি বা ডিগ্রী পাস অনেক কিন্ডারগার্টেনের প্রধান নিজেকে প্রিন্সিপাল হিসেবে পরিচয় দেন, এটা তার বোধগম্য নয়। তার পদবী হবে প্রধান শিক্ষক। তারা টাকা ইনকামের জন্য পদ-পদবিও কৌশলে পরিবর্তন করেছেন।

রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন জানান, সরকারের সুনির্দিষ্ট নিয়ম না থাকার কারণে এসব প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে অর্থ আদায় করছে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারক মহল দিকনিদের্শনা দিলে প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/মাকসুদুর রহমান কামাল/নারায়ণগঞ্জ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here