পার্বত্যাঞ্চলের আইন শৃংখলা পরিস্থিতি ক্রমশ নাজুক হয়ে উঠেছে। বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সন্ত্রাসীরা। গত দেড়মাসের ব্যবধানে রাঙামাটির বিভিন্ন উপজেলায় অপহরণ, খুন ও চাদাঁবাজির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় মানুষের মনে আতংক বিরাজ করছে। আইন শৃংখলা রক্ষায় প্রশাসনকে হিমশীম খেতে হচ্ছে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও রাঙামাটিতে বেড়াতে আসা পর্যটকরা অপহরণ, খুন ও চাদাঁবাজির ঘটনার শিকার হচ্ছেন অবাধে। এসব ঘটনায় পার্বত্যাঞ্চলের মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে চরমে। প্রভাব পড়েছে পার্বত্যাঞ্চলের অর্থনীতিতে। মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ফরিয়া ব্যবসায়িরা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিশাল একটা অংশের রুটি রোজগারের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাচাঁমালের ব্যবসা বন্ধ রয়েছে বড় কয়েকটি উপজেলায়। আতংকগ্রস্থতার কারণে কমে গেছে বেড়াতে আসা পর্যটকদের আগমন। হোটেল মোটেল গুলো প্রায়ই খালি থাকছে। নিয়ন্ত্রণহীন চাদাঁবাজির কারণে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে অবকাঠামোগত সহ সার্বিক উন্নয়ন। মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ, স্মারকলিপি প্রধান করেও আশাব্যঞ্চক কোনো সুফল পাচ্ছেনা পার্বত্যবাসী। আইন শৃংঙ্খলার চরম অবনতিতে ক্রমশ জটিল হয়ে পড়ছে পার্বত্যাঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি।
গত দেড় মাসে রাঙামাটিতে সন্ত্রাসীদের হাতে দুই বাঙ্গালী ও এক উপজাতি খুন হয়েছে। অপহৃত হয়ে নিখোঁজ আছেন এক আওয়ামীলীগ নেতা ও পাঁচ বাঙ্গালী। গত ৪ ডিসেম্বর রাঙামাটির বরকল উপজেলার হরিনা সীমান্তবর্তী কর্ণফুলী নদী থেকে পাঁচ বাঙ্গালী জেলেকে অপহরন করে নিয়ে যায় উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা। এর ৯ দিনের মাথায় বাঘাইছড়িতে এক বাঙ্গালী মোটরবাইক চালককে খুন করে তার মোটরসাইকেল ছিনিয়ে নেয় সন্ত্রাসীরা। গত ২৯ ডিসেম্বর জুরাছড়ির বালুখালীর দুর্গম উগইছড়ি এলাকায় পার্বত্য চুক্তির পক্ষ জেএসএস-বিপক্ষে ইপিডিএফ এর মধ্যে বন্দুক যুদ্ধে সুপায়ন চাকমা নামের ১ উপজাতীয় নিহত হয়েছে। এরপর গত ১১ জানুয়ারী রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলা হতে জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যাকে অপহরন করে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। গত রোববার বাঘাইছড়ি থেকে নিখোঁজ হয় এক বাঙ্গালী মোটরবাইক চালক। এছাড়াও জেলা আওয়ামীলীগ ও কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের পক্ষ থেকে যেকোন মূল্যে অপহৃত অনিল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যাকে মুক্তির দাবী করা হলেও রাঙামাটির মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যাকে গত ৯ দিনেও উদ্ধার করতে পারেনি প্রশাসন। এখনো তার কোন সন্ধান না পাওয়ায় তার ভাগ্যে কি ঘটেছে তা কেউ নিশ্চিত বলতে পারছেনা।
এদিকে সন্ত্রাসীরা বাঘাইছড়িতে ভাড়ায় চালিত মটর বাইক চালক আ: সাত্তারকে হত্যার একমাসের ব্যবধানে বাঘাইছড়িতে ভাড়ায় চালিত আরো এক মটর বাইক চালক মো মামুনকে অপহরণ করে সন্ত্রাসীরা। তার ভাগ্যে কি ঘটেছে তা এখনো যানা যায়নি। বাঘাইছড়িতে ২ জন মটর বাইক চালক খুন ও অপহরনের ঘটনায় এলাকায় অধিবাসীদের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
অপরদিকে বরকলের ছোট হরিণা সীমান্তে তবলাবাগ এলাকায় অপহৃত ৫ জেলের মধ্যে ১জনের লাশ উদ্ধার হলেও ৪ জেলের এখনো কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। গত ৪ ডিসেম্বর বরকলের হরিণার তবলাবাগ হতে ৫ বাঙ্গালী জেলেকে অপহরন করে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। এর কয়েকদিন পর কুরকুটিছড়ির পাশে নদীতে ভাসমান অবস্থায় আ; রাজ্জাক নামে এক জেলের লাশ পাওয়া যায় । কিন্তু বাকী ৪ জেলের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা এখনো জানা যায়নি। এ ঘটনায় স্থানীয় মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। এ ঘটনার পর পাহাড়ী বাঙ্গালীর পারস্পরিক দ্বন্ধ অবিশ্বাসের কারনে ছোট হরিনার ব্যবসায় ধস নেমেছে। গাছ, বাশ , মাছ, হলুদ, আদা, কলা সহ সবধরনের ব্যবসা বন্ধ রয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। বরকল সদর থেকে ছোট হরিনায় যেতে যাত্রী সংকট দেখা দেয়ায় রাঙামাটি-বরকল রুটে যাত্রীবাহি লঞ্চের লোকাল সার্ভিস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। একারনে বিভিন্ন জেলা থেকে ফরিয়া ব্যবসায়িরাও রাঙামাটিতে আসা বন্ধ করে দেওয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে রাঙামাটির অর্থনীতিতে।
এসব ঘটনায় পার্বত্যাঞ্চলের আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ে চরম উদ্বেগ উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছে মানুষ। সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে উঠলেও আইন শৃংখলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। অপহরন ও খুনের ঘটনায় থানায় মামলা হলেও ঘটনার সাথে জড়িত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার বা নিখোঁজদের উদ্ধার করতে পারেনি আইনশৃংখলা বাহিনী। এসব ঘটনার জন্য উপজাতি সন্ত্রাসীদের দায়ি করছেন সংশ্লিষ্টরা। পাহাড়ের আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মাঝে উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা বাড়লেও আইনশৃংখলা পরিস্থিতি অবনতির কথা বেমালুম অস্বীকার করছে প্রশাসন ও পুলিশ।
প্রতিমাসেই অপহরন ও খুনের ঘটনা ঘটতে থাকলেও আইনশৃংখলা সভায় জেলার সার্বিক আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়।
জেলার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে পুলিশ সুপার মাসুদ-উল হাসান বলেন পাহাড়ে এসব নতুন কিছু নয়। বরকলের পাঁচ বাঙ্গালী জেলে ও আওয়ামীলীগ নেতা অনিল তঞ্চঙ্গ্যা অপহরনের ব্যাপারে পুলিশের কাছে নতুন কোন তথ্য নেই বলে তিনি জানান।
এদিকে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলা থেকে নিখোঁজ মামুন ও খাগড়াছড়ির দিঘীনালার মোটরবাইক চালক নিহত আব্দুস সাত্তার ও চিকনমিলা চাকমার হত্যাকারী সন্ত্রাসীদের বিচারের দাবীতে বৃহস্পতিবার বাঘাইছড়িতে মানববন্ধন করেছে পাহাড়ি-বাঙ্গালীরা। পাহাড়ি-বাঙালিদের সমন্বয়য়ে গঠিত বাঘাইছড়ি সচেতন নাগরিক সমাজের ব্যানারে উপজেলা পরিষদ থেকে চৌমূহনী চত্তর পর্যন্ত দীর্ঘ মানববন্ধনে স্থানীয় শত শত পাহাড়ি-বাঙালি অংশগ্রহন করেন। সেখানে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা, বাঘাইছড়ি পৌর মেয়র আলমগীর কবির, সাবেক পৌর মেয়র নিজাম উদ্দীন, উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক আলী হোসেন, হেডম্যন বিশ্বজিৎ চাকমা প্রমূখ।
উল্লেখ্য, গত ১৪ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ির দিঘীনালার কবাখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা মোটরবাইক চালক আব্দুস সাত্তারের লাশ বাঘাইছড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়। এর জের ধরে উত্তেজিত বাঙালিদের হামলায় দীঘিনালার কবাখালীতে চিকনমিলা চাকমা নিহত হন। সর্বশেষ গত ১৫ জানয়ারী ভাড়ায় চালিত মোটরবাইক নিয়ে দিঘীনালার উদ্দেশ্যে যাওয়ার পথে আরেক মোটরবাইক চালক মোঃ মামুন নিখোঁজ হন।
ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/আলমগীর মানিক/রাঙ্গামাটি