মেহেরুন নেছা রুমা :: চিন্তার পাহাড়টা মাথায় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে রাজউক ভবনের সামনে এসে পড়লাম বুঝতেই পারিনি। পাঁচ/ ছয় বছরের মেয়েটি এমনভাবে এসে হাত পাতল যে আমাকে থামতেই হল। ঝারি মেরে বললাম, অন্যদিকে যা। মেয়েটা যেন কিছুই শুনেনি, দ্বিগুণ আগ্রহে আমার আরো কাছে ঘনিয়ে এসে মুখটা মারাত্মক মলিন করে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল, স্যার সারাদিন কিছু খাই নাই। কয়টা টাকা দেন ভাত খামু।
টাকা কি তোর বাপের নাকি যে তুই চাইলি আর দিয়ে দিলাম? যা ভাগ এখান থেকে। মেয়েটাকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে মনটা একটু খারাপ হল। আজকাল একদমই মেজাজ ঠিক রাখতে পারি না। মেঘলাও বলে, তোমার সাথে ঠিকমতো কথাই বলা যায় না, সমস্যা কি বলবে তো? সিয়াম তো ভয়ে এখন কাছেই আসে না। অথচ ছেলেটা আমার ঘা ঘেষা বিড়ালছানার মত কেমন লেপ্টে থাকত সারাক্ষণ। যতখানি পথ পিছনে অতিক্রম করেছি আরো দ্বিগুণ পথ পাড়ি দিতে হবে সামনে। মাথার মধ্যে লক্ষকোটি ভাবনা কিলবিল করছে। কিভাবে চলবে সামনের দিনগুলো! চলা তো বন্ধ হয়ে গিয়েছে কবেই, এখন তো কেবল কোনরকম ঠেলেঠুলে নিয়ে যাওয়া। সংসার এমন এক জায়গা যেখান থেকে অপারগতা নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। এই বোঝা কাঁধে নিয়েই চলতে হবে।
ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে যখন ঘরে ফিরি মেঘলা নাক কুচকে বলে, কী বিশ্রী অবস্থা! এই শীতেও কেউ এভাবে ঘামে? এতটা পথ হেঁটে আসার ধকল সামলাতে পারি না। রাগান্তিত কণ্ঠটা আরো তেজালো হয়ে মেঘলার উপর বর্ষিত হয়। পকেটের দুর্দশার কথা গোপন রেখে যতটা পারি হম্বিতম্ভি করে গোসলখানায় যেয়ে অনেকটা সময় নিয়ে শরীরে পানি ঢালি।
চাকরিটা যাই যাই করে এবার একেবারে চলেই গেল। বেশ কয়েকমাস ধরে ঠুনকো অজুহাতে একে ওকে ছাটাইয়ের মহরা চলছিল। নিজের যোগ্যতার উপর ভরসা থাকলেও কতৃপক্ষের মর্জির উপর ভরসা ছিল না। ছাটাইয়ের আশংকা নিয়েই আরো বেশি পরিশ্রম করেছি, কাজের ভারগুলো অনায়াসে কাঁধে নিয়েছি। দিন রাত হিসেব না করে, প্রতিষ্ঠানটিকে জীবনের বরাদ্দ সবটুকু সময় দিয়ে বসে ছিলাম এই আশায় যে সবাইকে ছাটাই করলেও অন্তত আমার দিকে নজর না দেয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত করোনা মহামারির উছিলায় তাদের ভেতরের সমস্ত সংকোচ দ্বিধার পোশাক একেবারে খসে পড়ল। পরিষ্কার কণ্ঠে জানিয়ে দিল, আপনার আর আসতে হবে না অফিসে। এতগুলো মানুষের ব্যয়ভার বহন করার মতো অবস্থা এখন প্রতিষ্ঠানের নেই।
বাসাভাড়া বাকি আছে দুই মাসের, এই বিল সেই বিল নিয়ে আরো বেশ কিছু ঋণ জমেছে, ছেলের স্কুলের বেতন এই সপ্তাহে না দিলেই নয়, কোচিং এ সবার সামনে দাঁড় কিয়ে টিউশন ফি চেয়েছে বলে সিয়াম লজ্জায় তারপর আর কোচিংয়ে যায়নি। বাসায় এসেও সারাদিন কেঁদেছে। করোনার জন্য স্কুল কোচিং সব ছুটি দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এসব ফি পরিশোধ না করাটা ঠিক হবে না। ক’মাস ধরে বেতনটা ঠিকমত পাচ্ছিলাম না বলে এতকিছু জমে গিয়েছে। অফিসে হেঁটে আসা যাওয়া করতে করতে একমাত্র জুতাজোড়াও ছিড়ে গেল। এখন কোথাও ইন্টারভিউ দিতে গেলে যে জুতা লাগবে সেটাও নাই। সিয়ামের বাসায় পড়ার প্যাণ্ট দুইটা কয়েকবার মেঘলা সেলাই করে দিলেও এখন আর সেলাইও টিকছে না। এদিকে মাকে প্রতিমাসে সামান্য যে কটা টাকা পাঠাই তাও তিনমাস ধরে দিতে পারিনি। মায়ের সাথে কথা বলতে গেলে লজ্জায় মুখ ফোটে না। কিভাবে চলছে আমার মা! কি খায় না খায়, আমার ওই টাকাটার আশায় মা অপেক্ষা থাকেন। নিজের পান জর্দ্দা, ওষুধ পথ্য এসবের জন্যতো হাতে কিছু টাকা অবশ্যই দরকার আছে।
মার কথা ভাবতে ভাবতে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সৈকত। গোসলের পানিতে ধুয়ে যায় তার চোখের পানি। বাইরে থেকে মেঘলা ডাকে, আর কতক্ষণ লাগবে তোমার? চা ঠান্ডা হয়ে গেল।
শরীর মুছতে মুছতে তিনজনে চায়ের কাপ নিয়ে মেঝেতে বসি। রোজ সন্ধায় মেঘলার এককাপ চা লাগেই। এছাড়া আর কোন বিশেষ অভ্যাস নেই তার। মা-ছেলের তেমন কোন চাহিদাও নেই। চায়ের কাপে চোখ পড়তেই বুঝে ফেললাম, তবু মুখ ফসকে প্রশ্নটা বেরিয়ে গেল, কি ব্যাপার রং চা করলে যে?
দুধ নেই। মেঘলার শান্ত ভেজা জবাব। অক্ষম পুরুষ হিসেবে আমি আরো শান্ত হয়ে যাই। মেঘলা কখনো রং চা খেতে পারে না, সিয়াম তো একেবারেই মুখে দেয়না রং চা। অথচ আজ আমার আগেই মা ছেলে কেমন চুপে চুপে চা টা শেষ করে নিল। আর আমি একজন ব্যর্থ মানুষের স্পষ্ট ছায়া দেখতে পেলাম আমার ঠান্ডা হতে যাওয়া টলমলে স্বচ্ছ চায়ের কাপে। যেখানে দীর্ঘশ্বাসের মৃদু বাষ্প নি:শব্দে পলায়নের পথ খুঁজে বেড়ায়।