ইতিহাস জাতীয় জীবনের ও সভ্যতার স্মারক। অতীতকে ব্যক্ত করে নির্মল নিরপেক্ষতায়। ইতিহাসের এমনি এক পথে জরাজীর্ণ অবস্থায় দাড়িয়ে আছে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার ভাটপাড়া নীলকুঠি। কুঠিবাড়িটি সংরক্ষণ ও সংস্কার করলে এটিও হতে পারে একটি পর্যটন কেন্দ্র। এলাকাবাসি বারবার তাগিদ দেয়া স্বত্বেও কুঠিবাড়িটি সংরক্ষনের জন্য কেউ কোন পদক্ষেপ নেননি আজও।
জানা যায়, মেহেরপুর অঞ্চলে ১৭৭৮ সালে ক্যারল ব্লুম নামে এক ইংরেজ ব্যক্তি নীলকুঠি স্থাপন করেন। নীল চাষ অত্যধিক লাভজনক হওয়ায় ১৭৯৬ সালে এখানে নীল চাষ শুরু হয়। এ সময় বিখ্যাত বর্গী দস্যু নেতা রঘুনাথ ঘোষালির সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে গোয়ালা চৌধুরী নিহত হলে মেহেরপুর অঞ্চলে রানী ভবানীর জমিদারীভুক্ত হয়। রানী ভবানী নিহত হলে কাসিম বাজার অঞ্চলটি ক্রয় করেন হরিনাথ কুমার নন্দী। পরে হাত বদল হয়ে গোটা অঞ্চলটি মথুরানাথ মুখার্জির জমিদারীভুক্ত হয়। এক সময় মথুরানাথ মুখার্জির সঙ্গে কুখ্যাত নীলকর জেমস হিলের বিবাদ বাধে। মথুরানাথ-এর ছেলে চন্দ্র মোহন বৃহৎ অঙ্কের টাকা নজরানা নিয়ে মেহেরপুরকে জেমস হিলের হাতে তুলে দেন। চন্দ্র মোহনের ছেলে মহেষ মুখার্জি জেমস হিলের মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ইতিহাসে ইনিই নীলদর্পণ নাটকে গুপে দেওয়ান নামে পরিচিত।
১৮১৮ থেকে ১৮২০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মেহেরপুরর বেশ কয়েকটি স্থানে নীলকুঠি স্থাপিত হয়। তার মধ্যে গাংনীর ভাটপাড়া নীলকুঠি অন্যতম। নীল গাছ পচা পানি জ্বালিয়ে তৈরি করা হতো নীল রঙ। এক বিঘা জমিতে আড়াই থেকে তিন কেজি নীল উৎপন্ন হতো- যা উৎপাদন করতে ব্যয় হতো ১২-১৪ টাকা। অথচ চাষীরা পেতো মাত্র তিন-চার টাকা। নীল গাছ থেকে যে রঙ তৈরি করা হতো তা ছিল চাষীদের বুকের পুঞ্জ্িভূত রক্ত। ভাটপাড়া নীলকুঠিটি কাজলা নদীর তীরে ৩৩ একর জমির ওপর অবস্থিত। সাহেবদের প্রমোদ ঘর ও শয়ন রুম সংবলিত দ্বিতল ভবনটি জীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। কাঁচারি ঘর, জেলখানা, মৃত্যুকুপ ও ঘোড়ার ঘর বিলুপ্ত প্রায়। দামি মার্বেল পাথর আর গুপ্তধনের আশায় এলাকার প্রভাবশালীদের ইন্ধনে ভেঙে ফেলা হয়েছে বেশ কিছু স্থাপনা। রক্ষাণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে সরকারের বাজস্ব বিভাগ। এরই মধ্যে ভবনের ইট ও পাথর চুরি হয়ে গেছে। দামি ফলজ ও বনজ বৃক্ষ নিধন করা হয়েছে । কিছু অংশে গড়ে উঠেছে আবাসন প্রকল্প, জায়গা জমি ক্রমান্বয়ে বেদখল হয়ে যাচ্ছে। নীলকুঠির মূল ভবন ছাড়াও বিধ্বস্ত ভবনের চার পাশে আগাছার মতো ছড়িয়ে আছে নীল গাছ। কুঠি ভবন ও এ নীল গাছ স্মরণ করিয়ে দেয় নীলকরদের অত্যাচার ও নির্যাতনের কথা।
গাংনী ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক এনামুল আযীম বলেন ইতিহাসের সাক্ষী ভাটপাড়া নীলকুঠি সংরক্ষণ করা জরুরী। কারণ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মরা ইতিহাস খুঁজতে এসে যদি হতাশ ফিরে যায় তাহলে তার দায় আমাদের উপরই বর্তায়। কুঠিবাড়িটি সংরক্ষণ করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান তিনি।
সহকারী অধ্যাপক মাসুদ রেজা বলেন কুঠিবাড়িটি এখন কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে। সব থেকে ভাল হয় কুঠিবাড়িটির জায়গায় কৃষিকলেজ বা সরকারী কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে এর রক্ষণাবেক্ষনের দায়ীত্ব তাদের উপর ছেড়ে দেওয়া। অথবা কুঠিবাড়িটির সংরক্ষণ করে এখানে একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা। তাহলে এলাকার মানুষ বিনোদনের একটু জায়গা পাবে।
মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক বেনজামিন হেমব্রম বলেন, জেলায় তিনটি কুঠিবাড়ি আছে। আমঝুপি কুঠিবাড়িটি কিছুদিন আগেও রেষ্ট হাউস হিসাবে ব্যবহৃত হত। এখন শহরে ভাল হোটেল হওয়ায় সেখানে আর কেউ থাকতে চায়না । তবে আমঝুপিতে এখনও পর্যটকরা যায়। কিন্তুু ভাটপাড়া নীলকুঠিবাড়ির বেশ কিছু জমি ইতিমধ্যে ভূমিহীনদের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অবৈধ দখলদার কুঠিবাড়ির যায়গা দখল করেছে কথাটি সত্য নয়। ভবনগুলো অনেক দিনের পূরানো। সরকার থেকে রক্ষণাবেক্ষনের কোন লোক নিয়োগ না থাকায় দুস্কৃতীকারিরা কুঠিবাড়ির গাছপালা কেটে নেওয়ার চেষ্টা করে। প্রশাসনিক তৎপরতায় সে চেষ্টা এখন ব্যার্থ। ভাটপাড়া নীলকুঠিবাড়িটি সংরক্ষণ পূর্বক এখানে কোন একটি ভাল প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে।
কালের সাক্ষি ভাটপাড়া কুঠি বাড়িতে এখনও কিছু দর্শনার্থীরা যায়, তবে অবস্থা দেখে হতাশ হয়েই ফিরে যায়। এলাকাবাসীর দাবি পরাধীনতার শিকলে বন্দি থাকাকালিন শোষক এবং শাসকদের নির্যাতনের নির্মম স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক ভাটপাড়া নীলকুঠি সংরক্ষণে হতে পারে এক অনিন্দ্য সুন্দর দর্শনীয় স্থান। গড়ে তোলা যেতে পারে একটি পর্যটন কেন্দ্র। এ ব্যাপারে সরকারের সু-দৃষ্টি কামানা করেছেন এলাকাবাসী।
ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/রামিজ আহসান/মেহেরপুর