মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক :: মানুষ তো রোবট নয়। রোবটের কোনো দেহঘড়ির ছন্দ নাই; কিন্তু মানুষের শরীরের একটি জৈবছন্দ আছে। শিল্পবিপ্লবের পর বিশ্বে যখন কলকারখানায় শ্রমজীবী মানুষের প্রয়োজন দেখাদিল, তখন প্রথমদিকে তাহাদের ব্যবহার করা হতো যন্ত্রের ন্যায়।

তৎকালীন শিল্পকারখানায় কাজ করতে হতো ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৮ ঘণ্টার অধিক কাজ করতে হতো। কাজের পরিবেশের কারণে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যহীনতা ও মৃত্যুঝুঁকি ছিল নিত্যসঙ্গী। মেহনতি মানুষের সংগ্রাম, সংহতি আর বিশ্বব্যাপী শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মহান মে দিবস আজ। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের সূচনা হয়েছিল শ্রমিকদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের সব শিল্পাঞ্চলে ধর্মঘটের মাধ্যমে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। সেদিন অনেক শ্রমিক জীবন দিয়েছিলেন।

সেই আত্মদানের পথ ধরে পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বজুড়ে অভাবনীয় এক সংক্রমণে জিম্মি আজ পৃথিবী। অতি ক্ষুদ্র একটি ভাইরাস যার নাম কভিড-১৯। মানুষের জন্য এটি একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। দেশে ক্রান্তিকালে কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাওয়া মেহনতি দিন মজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষগুলো সবচেয়ে বেশি অসহনীয় অবস্থার মধ্যে পতিত হয়েছে। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ জনসংখ্যাবহুল একটি দেশে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ বয়ে আনতে পারে করুণ ট্র্যাজেডি। কর্মহীন হয়ে পড়া এসব মানুষের পাশে দাঁড়ানোই এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি।

মানবসভ্যতা গড়ে উঠেছে মানুষের শ্রমের বিনিময়ে। এক পক্ষের দিক নির্দেশনায় অপর পক্ষের কায়িক শ্রমে সভ্যতার ইট একটি একটি করে গাঁথা হয়েছে; কিন্তু অধিক কায়িক শ্রমে ব্যক্তির কার্যসম্পাদন ক্ষমতা ও দক্ষতা নষ্ট হয়ে যায়। বর্তমানে যখন মে দিবস পালিত হচ্ছে, তখন বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী শ্রমিকশ্রেণির অবস্থা কভিড-১৯ জন্য ভালো বলা যাচ্ছে না। এই মানবগ্রহ ধনসম্পদে অনেক উন্নত হলেও এর পেছনে যে মূল চালিকা শক্তি শ্রমিকশ্রেণির ভাগ্যের তেমন পরিবর্তন হয়নি।

শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্যে গুটিকয়েক মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত হয়েছে বিশ্বের সিংহভাগ সম্পদ। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। মে দিবসের পথ ধরেই বিশ্বের উন্নত দেশে শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি কাজের ব্যাপক পরিবর্তন এলেও আমাদের দেশের শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার, বিশেষ করে শ্রমিকদের মজুরি, কাজের পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধা এসব ক্ষেত্র ছাড়াও শ্রমিকেরা বেতনবৈষম্যের শিকার। অন্যদিকে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে শিশুশ্রম বন্ধ, দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার ছিল। অথচ বাংলাদেশে শ্রমিক শ্রেণির দুর্দশা ঘোচেনি আজও।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মপরিবেশ অনেকটা ভালো হলেও শ্রমিকদের মজুরি রয়ে গেছে নিম্ন পর্যায়ে। আমাদের দেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রধান তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হলেও ন্যুনতম মজুরিকাঠামোয় তাঁদের ন্যায্য দাবিদাওয়া অপূর্ণই রয়ে গেছে। ফলে এই শিল্পে অস্থিরতা কাটেনি। শিল্পমালিক যদি শ্রমিকের কাছ থেকে বেশি কাজ আদায় করতে চান তাহলে তাদের উপযুক্ত মজুরি দিতে হবে। দুঃখের বিষয় হলো, তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের শ্রমবাজারে এখনো কোথাও কোথাও আমেরিকার উনিশ শতক বিরাজ করছে। আজকের মে দিবসে আমরা পথেঘাটে নানাপ্রান্তে এখনো এমন অনেক দিনমজুর দেখি যাহারা বোঝে না মে দিবস বা শ্রমদিবস কী জিনিস। মে মাসের কাঠফাটা রোদে কেহ মাটি কাটতেছে, কেহ রিকশায় প্যাডেল মারতেছে, কেহ ইটভাটার আগুনকে পরোয়া না করে শ্রম দিয়া যাচ্ছে। এই সকল শ্রমিকের লক্ষ্য একটাই সারা দিন রোদে পুড়ে হাড়ভাঙা খাটুনির পর একমুঠো চালডাল নিয়ে বাড়ি ফেরা। এরা কেবল বোঝে একদিন কাজ না করলে ওইদিন না খেয়ে থাকতে হবে।

বাংলাদেশের অনেক শ্রমিক বঞ্চিত এবং বৈষম্যের শিকার। হে মার্কেটের শ্রমিকেরা আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন করলেও বাংলাদেশে অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের এখনো তার চেয়ে অধিক কাজ করতে হয়। তাঁদের চাকরি ও বেতন-ভাতারও নিশ্চয়তা নেই। তৈরি পোশাক খাতে ৮০ ভাগই নারী একধরনের নিরাপত্তাহীনতার পরিস্থিতির মধ্যে তাঁদের জীবনযাপন করতে হয়। এর পাশাপাশি দুঃসংবাদ হলো, একদিকে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের অনেকে বেকার হয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন, অন্যদিকে বিদেশগ্রামী শ্রমিক একেবারে কমে গেছে। সরকার দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিক তৈরি করতে না পারায় বিদেশে তাঁদের চাহিদা কমে গেছে। শ্রমিক শ্রেণির অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হলেও অনেক ক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে না। যা শ্রমিক শ্রেণির জন্য যথেষ্ট নয়। একে আরও যুগোপযোগী করার পাশাপাশি শ্রমিক শ্রেণির মানবেতর জীবনের অবসান ঘটানোর অঙ্গীকার করতে হবে আমাদের সবাইকে।

সমাজের অন্যান্য পেশার মানুষের মতো শ্রমিকদের একটি মর্যাদাসম্পন্ন শ্রেণি হিসেবেই দেখা উচিত। মহান মে দিবস পালন তখনই সার্থক হবে, যখন দেশের শ্রমিকের অধিকার ও জীবনমান উন্নয়ন, ন্যুনতম মজুরি নির্ধারণ, নিরাপদ কর্মপরিবেশের নিশ্চয়তা থাকবে। এছাড়া মালিকদের উপলব্ধি করতে হবে, শ্রমিকদের ঠকিয়ে শিল্পের মুনাফা আদায় বা অর্থনীতির বিকাশ নিশ্চিত করা যাবে না। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক। এটাই মহান মে দিবসে আমাদের প্রত্যাশা।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here