দুই বছরেও শেষ হয়নি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শেষ বর্ষের মেধাবী ছাত্র জয়পুরহাটের খোর্দ্দসগুনা গ্রামের  দরিদ্র পরিবারের সন্তান ফারুক হত্যাকান্ডের তদনত্ম। বিচার হয়নি নৃশংস এ হত্যাকান্ডের। ছেলে হারানোর শোকে ফারুকের মা হাসনা বানু এখনও পাগলপ্রায়। ফারুকের ছবি বুকে নিয়ে দিনরাত শুধুই কান্নাকাটি করেন। বাতে আক্রানত্ম বাবা ফজলুর রহমানও ছেলের শোকে মাঝে মধ্যেই স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে পড়েন। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকান্ডের ১০ মামলায় অদ্যবধি পর্যন্তকোন প্রকার চার্জসিট দাখিল করতে পারেনি তদন্ত কর্মকর্তারা। ছাত্রশিবিরের নৃশংস নির্যাতনে দীর্ঘ দুই বছরেও ছেলের নির্মম হত্যাকান্ডের বিচার না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ফারুকের বাবা-মা। তাদের একটাই দাবি, সন্তান হত্যাকারীরাদের যেন দ্রুত বিচার হয়।

এদিকে মৌলবাদি ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের হাতে নৃশংসভাবে নিহত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শেষ বর্ষের মেধাবী ছাত্র ফারুকের হত্যাকান্ডে ক্ষমতাশীল সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের কর্মী হওয়া সত্তেও বিচার ব্যবস্থা ঢিলেঢালে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছে ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। তারা ফারুক হত্যাকান্ডের আসামীদের দ্রুত বিচার দাবি করেছে।

অপরদিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম পট পরিবর্তনকারি এই হত্যাকান্ডের ১০ টি মামলায় ১৯০ জনের বেশি আসামীকে গ্রেপ্তার করা হলেও বর্তমানে ৩০-৩৫ জন আসামী জেলহাজতে রয়েছে। বাকী আসামীরা জামিন বীর দর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

জানা যায়, ২০১০ সালের ৮ ফেরম্ন্রয়ারী রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল দখলকে কেন্দ্র করে ছাত্রশিবিরের ক্যাডারেরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাতের আধারে ‘জয় বাংলা’ স্রোগান দিয়ে সবাইকে বোকা বানিয়ে ছাত্র শিবিরের সশস্ত্র নেতাকর্মীরা নারকীয় তা-ব চালিয়েছিল। রাতভর মুহুর্মুহু গুলির শব্দে গোটা ক্যাম্পাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। সেদিন শিবিরের নৃশংসতায় প্রাণ হারান ছাত্রলীগ কর্মী ফারম্নক হোসেন। সকালে ক্যাম্পাসের একটি ম্যানহোল থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি গণিত বিভাগের শেষ বর্ষের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। এই সংঘর্ষে শিবিরের ক্যাডারদের হাতে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কর্মী ও গণিত বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী ফারুক হোসেন কে নির্মমভাবে খুন করা হয়। আহত হয় পুলিশসহ ছাত্রলীগের অর্ধশত নেতা-কর্মী। ওই রাতে ছাত্রশিবিরের ক্যাডারেরা ছাত্রলীগের তিনজন নেতা-কর্মীর হাত ও পায়ের রগও কেটে দেয়। সেই সময় ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার স্থগিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাজেদুল ইসলাম এ ঘটনায় বাদী হয়ে ছাত্রশিবিরের ৩৫ জন নেতা-কর্মীর নাম উলেস্নখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ১৫-২০জনকে আসামী করে মতিহার থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। অপর দিকে পুলিশ বাদী হয়ে শিবির নেতা-কর্মীদের বিরম্নদ্ধে আরো কয়েকটি মামলা দায়ের করেন।

৩৫ জন আসামীর মধ্যে ২৫ জন উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। একজন মারা গেছেন এবং চারজন পলাতক রয়েছেন। তাছাড়া হত্যাকান্ডের পরপরই ২০১০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও সারাদেশে পুলিশের শিবির বিরোধী অভিযান চালিয়ে ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করে।

এজাহারভুক্ত ছাত্রশিবিরের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি শামসুল আলম ওরফে গোলাপ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব আবদুল লতিফ হল শাখার ছাত্রশিবিরের সভাপতি হাসমত আলী, শহীদ হবিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি রাইজুল ইসলাম, মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র ও শিবিরকর্মী রম্নহুল আমিন এবং শিবির ক্যাডার বাপ্পী নামক পাঁচজন আসামী ছিলেন। সন্দেহভাজন হিসেবে আরও ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের মধ্যে আছেন কেন্দ্রীয় নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মতিউর রহমান নিজামী , দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও রাজশাহী মহানগর জামায়াত ইসলামীর আমির আতাউর রহমান। কেন্দ্রীয় এই তিন নেতা অন্য মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁদের এ মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়েছে । তারা বর্তমানে যুদ্ধাপরাধীসহ বিভিন্ন অভিযোগে কারাগারে আছেন।

ছেলের নির্মম হত্যাকান্ডের দুই বছর পেরোলেও মা হাসনা বানু কিছুতেই ছেলে হারানোর বেদনা সইতে পারছেন না। ছেলের ছবি হাতে সারাড়্গণ শুধু কান্নাকাটি আর আহাজারিতে দিন পার করছেন। আর কোন আগনত্মক দেখলেই ছেলেকে ফিরে পাওয়ার বায়না ধরছেন। দুই পা’ বাতে আক্রান্ত বাবা ফজলুর রহমান জানান, ‘ছেলেকে নিয়ে বড় স্বপ্ন ছিল। কিন্তু রাজনীতির কালো থাবায় তাঁর জীবনে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন মেধাবী ছেলে ফারুকের নির্মম মৃত্যু তার সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে। দেখতে দেখতে দুই বছর পেরোলেও ছেলে হত্যাকারীদের শাস্তি হলো না। তিনি বলেন,‘বেঁচে থাকতে ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে পারবো কি-না তাও নিশ্চিত করে বলতে পারছিনা। তবে তাঁর দাবি, আর যেন কোন বাবাকে তাঁর মত অসহায় হতে না হয় সেজন্য প্রকৃত দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত’।

ফারম্নকের বাল্যবন্ধু খন্দকার ওলিউজ্জামান সুফল জানান, ‘ফারম্নকের বড় সখ ছিল বড় হয়ে সে গ্রামের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। ইচ্ছে ছিল বিসিএস ক্যাডারের একজন বড় কর্মকর্তা হয়ে গ্রামের কোলঘেঁষা ছোট যমুনা নদীতে ব্রীজ নির্মান করে এলাকাবাসীর প্রাণের দাবি পূরণ করা। মৃত্যুর পর মন্ত্রী ও সাংসদসহ আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের কাছে তার সে ইচ্ছের কথা জানানো হলে তাঁরা ব্রীজটি নির্মাণের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। আমাদের দাবি তার স্মৃতি রক্ষার্থে ব্রীজটি দ্রুত নির্মাণ করে ফারুকের নামে নামকরণ করা হোক।

ফারুক হত্যাকান্ডের তদন্তকারী কর্মকর্তা ও মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অফিসার্স ইনচাজ তোফাজ্জল হোসেন খান জানান, আমরা ইতিমধ্যে চার্জ সিট তৈরি করার সকল কাজ সম্পূর্ণ করেছি। আশা করছি আগামি ২/৩ দিনের মধ্যে চার্জ সিট দাখিল করতে পারবো।

জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাহিদ আরেফিন জানান, ফারুক আমাদের অহংকার। আমরা আহ্‌বান জানাবো আদালত দ্রুত ফারুক হত্যাকান্ডের বিচার করুক।

ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/এস এম শফিকুল ইসলাম/জয়পুরহাট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here