মুম্বইয়ে ধারাবাহিক বিস্ফোরণ কাণ্ডে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন-জঙ্গি ইয়াসিন ভাটকলের নাম প্রধান ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে ঘোষণা করল মুম্বইয়ের সন্ত্রাস দমন শাখা (এটিএস)। বিস্ফোরণের ধরন দেখে প্রথম দিন থেকেই সন্দেহভাজনদের তালিকার শীর্ষে ছিল ওই জঙ্গি সংগঠনের নাম। সেই সঙ্গে এটিএস সোমবার দাবি করেছে, বিস্ফোরণের ষড়যন্ত্র কী ভাবে হয়, কারা যুক্ত ছিল সব তথ্যই তারা পেয়েছে। তাই মূল চক্রী ইয়াসিন ওরফে ইমরান ওরফে শাহরুখ শাহবান্দারি ওরফে আহমেদ জহর সিদ্দিবাপ্পা এখনও নাগালের বাইরে থাকলেও বিস্ফোরণের তদন্তে ‘সাফল্য’ এসেছে বলেই মনে করছে এটিএস।
কিন্তু ‘সাফল্যের’ দাবির সঙ্গে সঙ্গেই বিতর্কে জড়িয়েছে মুম্বই এটিএস। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে খবর, তাদের না জানিয়েই বিস্ফোরণ-তদন্তে ‘সাফল্য’ নিয়ে মুখ খুলেছেন এটিএস কর্তারা। সেই বিতর্কের মধ্যেই দিল্লি পুলিশের দাবি, এই তদন্তেরই কাজে মুম্বই যাওয়া তাদের এক ‘ইনফর্মার’কে অভিযুক্ত বলে দাবি করে গ্রেফতার করেছে এটিএস। ফলে বিস্ফোরণ-তদন্তে কতটা সাফল্য এসেছে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা থাকছেই।

এ দিন দুপুরে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে মুম্বই এটিএসের প্রধান রাকেশ মারিয়া জানান, গত বছর ১৩ জুলাই মুম্বই শহরের জাভেরি বাজার, অপেরা হাউস এবং দাদারে পরপর বিস্ফোরণের ছক কষে ইয়াসিনই। তাকে সরাসরি সাহায্য করেছিল বিহারের দ্বারভাঙার দুই যুবক নাকি আহমেদ এবং নাদিম আখতার। ওই দুই যুবক সম্প্রতি ধরা পড়তেই ধারাবাহিক বিস্ফোরণের পরিকল্পনা ও আড়ালে থাকা তথ্য সন্ত্রাসদমন শাখার হাতে আসে। দ্বারভাঙা থেকে দু’টি চোরাই মোটরবাইক উদ্ধার হয়। রবিবার গ্রেফতার করা হয় হারুন ইয়াসিন নায়েক নামে আরও এক ব্যক্তিকে। রাকেশ জানান, বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য টাকা জোগাড় করতে সাহায্য করেছিল হারুন।

এটিএসের দাবি, ‘সাফল্য’ এসেছে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমেই। বিস্ফোরণের ৬ মাস ১০ দিনের মাথায়। ১৮টি রাজ্য ঘুরে। ১৮০টি ক্যামেরা ফুটেজ দেখে। ১২ হাজার ৩৭৩ জনকে জেরা করে।
সেই ‘সাফল্য’ অবশ্য আর ‘প্রশ্নাতীত’ রইল না সোমবার সন্ধ্যার পর থেকেই। দিল্লি সূত্রে খবর মেলে, মুম্বই বিস্ফোরণ মামলার কিনারা হয়েছে বা প্রধান অভিযুক্তদের ধরা গিয়েছে এমন কোনও তথ্যই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে দেয়নি মুম্বই এটিএস। মন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছে, স্বরাষ্ট্রসচিব নিজে মুম্বইয়ের সাংবাদিক বৈঠক দেখে এটিএস প্রধানকে টেলিফোন করার পর বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারেন। মুম্বই এটিএসের এই ব্যবহারে ‘ক্ষুব্ধ’ এবং ‘বিস্মিত’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা। তাঁদের মতে, এত বড় বিষয়ে মুখ খোলার আগে সরকারকে জানালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই সেই সাংবাদিক বৈঠকে উপস্থিত থাকতে পারতেন।

এর থেকেও বড় বিতর্ক অপেক্ষা করে ছিল। মুম্বই বিস্ফোরণ-তদন্তে এমনিতেই একাধিক বার মুম্বই এটিএসের সঙ্গে দিল্লি পুলিশের বিশেষ তদন্ত দলের সংঘাত বেধেছে। সেটাই চরমে পৌঁছল এ দিন। দিল্লি পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ধৃত নাকি আহমেদ আদৌ বিস্ফোরণে যুক্ত নয়। বরং সে দিল্লি পুলিশের ‘ইনফর্মার’ হিসেবে মুম্বই গিয়েছিল বিস্ফোরণের চক্রীদের ধরতেই। দিল্লি পুলিশের একাংশের দাবি, তাদের ‘শিক্ষা’ দিতেই নাকি আহমেদকে গ্রেফতার করেছে মুম্বই এটিএস। বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তাদের কানেও তোলা হয়েছে বলে দিল্লি পুলিশ সূত্রে খবর।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, মুম্বই এটিএস প্রধান দুপুরের সাংবাদিক বৈঠকে আগ বাড়িয়েই বলেন, “নাকি আহমেদ এই বিস্ফোরণের জন্য ইয়াসিনের থেকে দেড় লক্ষ টাকা নিয়েছিল। সে ইয়াসিনের থাকার জন্য বাইকুল্লা এলাকায় ভাড়ার বাড়িও খুঁজে দেয়। ওই জঙ্গিকে মোবাইলের সিমও দিয়েছিল সে-ই। নাকি আহমেদকে অনেকে নির্দোষ বলছিলেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে সব প্রমাণই আমাদের হাতে রয়েছে।” দিল্লি পুলিশের সঙ্গে তাদের ‘সংঘাত’ নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও বিষয়টিকে ‘পেশাগত প্রতিযোগিতা’ বলে এড়িয়ে যান রাকেশ। তার কিছু পরে নাকি আহমেদকে নিয়ে দিল্লি পুলিশের এমন দাবিতে স্বাভাবিক ভাবেই বিতর্ক শুরু হয়েছে। এটিএস প্রধান যদিও উৎসাহের সঙ্গেই শুনিয়েছেন তাঁদের ‘সাফল্যের’ কথা।
এটিএসের দাবি, মুম্বইয়ে ধারাবাহিক বিস্ফোরণের পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল সম্ভবত ২০১০ সালে। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে নাকি আহমেদ যখন দ্বারভাঙা থেকে মুম্বই শহরে আসে, তখন তার বন্ধু তথা পাশের গ্রামের ছেলে নাদিম বাণিজ্যনগরীর অ্যানটপ হিল এলাকায় বেশ কিছু দিন বাস করে ফেলেছে। কী ভাবে তাদের সঙ্গে ইয়াসিনের যোগাযোগ হয়, তা স্পষ্ট না জানালেও রাকেশ মারিয়ার কথায়, “একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, নাকির সঙ্গে দেখা করতে দ্বারভাঙায় গিয়েছিল ইয়াসিন। সেখানে নাকির তত্ত্বাবধানে ইয়াসিনের প্রয়োজন মতো জঙ্গি প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছিল কিছু যুবককে। ফলে ইয়াসিনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে দ্বারভাঙার ওই যুবক ওয়াকিবহালই ছিল।”
তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, মুম্বই কাঁপাতে বিস্ফোরক ও টাকা জুগিয়েছিল ইয়াসিন। কিন্তু বিস্ফোরণ ঘটানোর দায়িত্ব ছিল নাকি-নাদিমের উপরে। ২০১১-র জানুয়ারি থেকে মুম্বইয়ে লুকিয়ে থাকলেও জুলাইয়ের কিছু আগে দিল্লি গিয়ে নাদিমকে ফোন করে ডেকে পাঠিয়েছিল ইয়াসিন। সেখানেই আইইডি (ইম্প্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস)-র প্যাকেট পায় নাদিম। সেই বিস্ফোরক সে পৌঁছে দেয় নাকির কাছে। এটিএসের দাবি, জনবহুল এলাকায় বিস্ফোরক রাখার জন্য দুটি স্কুটার দ্বারভাঙার এই দুই যুবকই চুরি করেছিল। এমনকী, ১৩ জুলাই সন্ধ্যায় যারা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে বিস্ফোরক রেখেছিল, সেই যুবকদেরও মুম্বইয়ের শহরতলি, পুণে, এমনকী বিহার থেকে বেছে এনেছিল নাকি-নাদিমই।
বিস্ফোরণের পর থেকেই বেপাত্তা ইয়াসিন। খোঁজ ছিল না অন্য ষড়যন্ত্রীদেরও। শেষে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে দ্বারভাঙা থেকে ‘পাকা খবর’ পায় মুম্বই এটিএস। সেখানে অভিযান চালিয়েই খোঁজ মেলে নাকি-নাদিমের। উদ্ধার হয় চোরাই বাইকও। গত ১২ জানুয়ারি দুই যুবককে গ্রেফতার করা হয়। তার পর সপ্তাহ দেড়েক জেরার পর সোমবার বিস্ফোরণের মূল চক্রী হিসেবে ইয়াসিন ভাটকলের নাম ঘোষণা করা হল।
ছ’ মাস দশ দিন আগের সন্ধ্যার থেকে এ দিন অনেকটাই স্বস্তিতে ছিলেন রাকেশ মারিয়া। বিস্ফোরণের পর দিন সকালে মুম্বইয়ে ভিড়ে ঠাসা সাংবাদিক বৈঠকে দাঁড়িয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমের মতো তিনিও অসহায় ভাবে স্বীকার করেছিলেন, বিস্ফোরণ নিয়ে কোনও গোয়েন্দা তথ্য ছিল না। ফলে বিস্ফোরণের সন্ধ্যায় সাধারণ মুম্বইকরদের অবস্থা হয়েছিল ‘আ ওয়েডনেস ডে’ ছবির ‘স্টুপিড কমন ম্যান’-এর মতো। সেই ‘নির্বোধ’ সাধারণ মুম্বইকর, যাঁরা বাড়ি থেকে বেরনোর সময়ে জানতেন না, বাড়ি ফিরতে পারবেন কি না। ১৩ জুলাই সন্ধ্যায় কাদের জন্য আর বাড়ি ফেরা হল না, সেটাও জানা ছিল না সাতাশ জন ‘নির্বোধ’ সাধারণ মুম্বইকরের।
এ দিন অন্তত কিছু তথ্য জানালেন মুম্বই এটিএসের প্রধান। যদিও তা ‘প্রশ্নাতীত’ নয়!

সুত্র : আনন্দবাজার

ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/স্টাফ রিপোর্টার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here