জহিরুল ইসলাম শিবলু, লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি :: জলেই জন্ম, জলেই মৃত্যু, জলেই বসবাস, নাগরিক হয়েও তারা নিজ দেশে পরবাস। নূন্যতম নাগরিক সুবিধা বা মৌলিক অধিকার বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, স্যানিটেশন, বিশুদ্ধ খাবার পানি তো নেই বরঞ্চ অনিয়ন্ত্রিত জন্মদান, বাল্য আর বহু বিবাহ এবং কুসংস্কারে ভরপুর আধুনিক যুগে থেকেও লোকচক্ষুরু আড়ালে গহীন এক অন্ধকার জীবনে বাস করছেন “মানতা’’ সম্প্রদায়।
জন্মনিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র আর ঠিকানাবিহীন বিচ্ছিন্ন এ জনগোষ্ঠী শুধু লক্ষ্মীপুর জুড়ে রয়েছে কমপক্ষে পাঁচ হাজার, আর পুরো মেঘনাজুড়ে প্রায় অর্ধ লক্ষ। সজ্ঞায় না মিললেও জীবনাচার দেখে মনে হয় যেন তারা এ যুগের জলচর এক নতুন উপজাতি।
সম্পূর্ন ভূমিহীন আর জেলে হওয়া সত্ত্বেও এরা পায় না কোনো ভিজিএফ কার্ড, বয়স্ক বা বিধবা ভাতা কিংবা কর্মসৃজনের মতো কোনো কর্মসূচি অথবা ভাগ্যে জোটেনি কোন আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই। উল্টো অভিযোগ রয়েছে তাদের নামে ভুয়া তালিকা তৈরি করে সুবিধা নিচ্ছে মেঘনা পাড়ের জনপ্রতিনিধিরা।
স্থানীয়দের ধারণা এ বিশাল বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল ধারার বাহিরে রেখে সামুদ্রিক সম্পদ রক্ষা কিংবা দেশের উন্নয়ন মোটেও সম্ভব নয়। ঠিকানাবিহীন এবং সভ্য সমাজের আলো বিমূখ এ জনগোষ্ঠীর জীবন ধারণের নানা দিক নিয়ে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার মেঘনাপাড়ে অনুসন্ধানে জানা যায়, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মেঘনার ভাসমান নৌকায়ই কেটে যায় তাদের ঠিকানা বিহীন জীবন।
মৌলিক অধিকার ও সকল নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত সভ্য সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এ অন্ধকার জনগোষ্ঠীকে স্থানীরা বলে ভাসান জেলে। কিন’ তারা নিজদের পরিচয় দেয় “মানতা” নামে।
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর থেকে শুরু করে চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত মেঘনার বিস্তৃতি প্রায় ৬৫ কিঃমিঃ। মেঘনার বুকে হাজার হাজার জেলে নৌকার মধ্যে এমন কিছু নৌকা আছে যার চালক স্বামী-স্ত্রী, ছেলে মেয়ে মিলে বড় এক পরিবার। এদের ঘর বাড়ি আর কর্মস’ল সবই নৌকায়। এরা সব সময়ই থাকে আমাদের সামনে অথচ যুগযুগ ধরে থাকছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। দেশে শত-শত মিডিয়া থাকলেও কখনও মিডিয়ার চোখে পড়েনি বলে তাদের অভিযোগ।
অথচ ডাঙ্গাবাসীর প্রতিদিনকার রসনা বিলাসের হাজার রকমের নানা স্বাদের সামুদ্রিক মাছ জোগান আসছে এদের হাত হয়ে। ডাঙ্গার বিত্তবানদের রসনা বিলাসে প্রতিনিয়ত নিয়োজিত থাকলেও নিজেদের কোন রসনা নেই। ইসলাম ধর্ম অনুসারী হলেও জীবিকার প্রয়োজনে তাদের ধর্মও যেন অস্তিত্ব সংকটে।
সরেজমিনে গিয়ে মেঘনাপাড়ের স্থানীয় জেলে, মাছের আড়ৎদার, ঘাটের ব্যবসায়ী আর মানতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, লক্ষ্মীপুরের রায়পুর থেকে রামগতি পর্যন্ত মেঘনা নদীতে প্রায় চার শতাধিক নৌকায় পাঁচ হাজারের মতো এ মানতা সম্প্রদায় সপরিবারে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। যুগযুগ ধরে বংশ পরস্পরায় চলে আসছে তাদের এ পেশা।
সরেজমিনে কমলনগর উপজেলার মতিরহাট ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে নদীর পাড়ে ভীড়ে রয়েছে শতাধিক মানতা নৌকার বহর। বহরের সরদার ইসমাইল মানতা জানান, নিজস্ব ঘর-বাড়ি বা জমি না থাকায় এরা ডাঙ্গায় বসবাস করে না। নৌকাই ঘরবাড়ি, এখানেই ৭ স্ত্রী আর ১১ ছেলে মেয়ে নিয়ে ১৯ জনের সংসার। মাছ ধরে, বিক্রি করি আর খাই, এটাই জীবন। শুধু খাওয়া এবং স্ত্রী উপভোগ ছাড়া ডাঙ্গাবাসীর মতো আর কিছুই চিন্তা করে না তারা। এখানেই সব শান্তি তার।
তারা কিভাবে এবং কেন মানতা, এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে, আরেক সরদার মোতাহার জানান, বেদের মধ্যে রয়েছে অনেক উপ-সম্প্রদায়। মালবৈদ্য, বাজিকর, শালদার বা মানতা। মানতারা মূলত নদীতে মাছ ধরে।
এ প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে মানতা সর্ম্পকে আর কোন ধারণা পাওয়া যায়নি। তবে নিজে কিভাবে এ জনগোষ্ঠীতে অর্ন্তভুক্ত হয়েছে তার বর্ণনা দিতে গিয়ে কাশেম মানতার ৩নং স্ত্রী পিরোজা বেগম (৪০) জানান, ছোট বেলায় মেঘনা আমাদের ভিটেমাটি নিয়ে যায়। আমি তখন অবিবাহিত। কাশেম মানতার সাথে ৩নং স্ত্রী হিসাবে ঘর বাধি। সে নদীতে থাকে জাতে মানতা তখন থেকে আমিও তার সাথে হয়ে যাই মানতা। মোতালেব মানতাসহ আরো কয়েক জনের বক্তব্য থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়,‘মানতারা জীবনের কোন না কোন সময় নদী ভাঙনের শিকার। উপকূলীয় বিভিন্ন নদীর তীরবর্তী এলাকায় বসবাসরত মানুষরাই সহায় সম্পদ হারিয়ে উপায়ন্তর না পেয়ে জীবন বাঁচাতে এক সময় মানতা সম্প্রদায়ে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
আর এভাবেই উপকূলীয় এলাকায় প্রতি বছর জীবন সংগ্রামী নতুন মানতাদের সম্প্রসারণ ঘটে। মানতায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর বহর নিয়ে এরা দেশের বিভিন্ন স্থানে মাছ ধরতে ঘুরে বেড়ায়। অনেক সময় জনমানবহীন দ্বীপাঞ্চলে ও এরা ভীড় করে।
মানতারা নদীতে কি করে, জানতে চাইলে মধ্য বয়স্ক লোকমান বলেন, ভাসান বা মানতারা মূলত ছোট বা মইয়া জাল ও বরশি দিয়ে মাছ ধরে। নদীপাড়ের স্থানীয় বাজারে সে মাছ বিক্রি করে। আমরা প্রধানত, চিংড়ি, পোয়া, ট্যাংরা, গলসা, পাঙ্গাশ, কাওন মাছ ধরি। খাদ্য কেনার পর যা থাকে তা দিয়ে জাল আর নৌকা মেরামত করি। ঠিকানাবিহীন জীবনের কারণে কোন আড়ৎদার আমাদের দাদন না দিলেও শোষণ করতে কার্পণ্য করে না তারা।
বৈচিত্রময় বিয়ে ও তালাক: প্রতিদিনকার কাজের বাহিরেও এদের স্বাভাবিক জীবন যাপন সর্ম্পকে জানতে চাইলে, কবির হোসেন (৪৫) জানান, কর্ম জীবন যা-ই হোক জীবনের নানা ক্ষেত্রে এ সম্প্রদায়েরও রয়েছে বৈচিত্রময় কিছু রীতি। তিনি জানান মুসলমান হলেও আমাদের বিয়ের রীতি ডাঙ্গাবাসী থেকে একটু ভিন্ন। এক নৌকা থেকে অন্য নৌকায় পছন্দের মেয়েটিকে তুলে নিলেই বিয়ে হয়ে যায়। এরপর হুজুরের সাহায্যে মাঝে মাঝে কলেমাও পড়ানো হয়। আবার দাম্পত্য কলহের কারণে যদি ছাড়াছাড়ি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাহলে ওই বধূটি স্বামীর নৌকা থেকে লাফ দিয়ে বাবার নৌকায় গেলেই তালাক হয়ে যায়। তাদের বিয়ের কোন রেজিস্ট্রি হয় না।
বাল্যবিয়ে ও বহু বিয়ে তাদের অন্যতম রীতি। তেমনটিই জানালেন, মতিরহাট ঘাটের নৌকায় বসবাসকারী শতাধিক মানতা পরিবারের সরদার হারুন মাঝি (৫০)। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ৭ টি বিয়ে করেছেন। তার ৫ স্ত্রী মাছ ধরে বিক্রীত টাকা তুলে দেয় তার হাতে। ৫ স্ত্রীকে নিয়ে বেশ সুখেই আছেন বলে তিনি জানান। তার শেষ বউ ১৩ বছর বয়সী রুপজান। এ বহরে যত নারীর সাথে কথা হয় প্রত্যেকেই স্বীকার করেন ১১-১২ বছর বয়সে তারা বিয়ের পিড়িতে বসেছেন।
কমলনগরের চরকালকিনি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য এবং মতিরহাটের ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান লিটন জানান, মানতাদের বিয়ের সময় গাঙ্গ পাড়ের কোন বাড়ির বাগানে বিয়ের আসর বসে, তখন তারা গান বাজনা করে, কিন’ বিয়ের খানাপিনে হয় ওই নৌকাতেই।
জন্ম নিয়ন্ত্রন এবং সন্তান লালন সর্ম্পকে বলতে গিয়ে বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় কুলছুম বেগম (৩০) বলেন, তারা জন্ম নিয়ন্ত্রণ করেই না। জন্ম থেকেই নদীর জলে খেলা করতে করতে বড় হওয়া বকুল বেগম (৩৫) জানান, ১৩ বছরের স্বামীর সংসারে হাল ধরতে নৌকার হাল ধরতে হয়েছে। কিশোরী বয়সের বিবাহিত জীবন আজ জীর্ণ শীর্ণ, রোগাক্রান্ত। রেহাই পাচ্ছে না সংসার যন্ত্রনা থেকে। ১১ সদস্যে পরিবারে ৯ সন্তানের জননী তিনি। মতিরহাটের রহমত (৪০), রমা (২৩) সহ শতাধিক নৌকায় প্রায় পাঁচ শতাধিক লোকের বাস। প্রত্যেক নৌকাই একটি সংসারে ১ স্বামীর অধীনে কমপক্ষে দু-স্ত্রী আর গড়ে ৮-৯টি সন্তান রয়েছে। কোন কোন নৌকায় একাধিক সংসারও রয়েছে। যা সভ্য সমাজ কল্পনা ও করতে পারে না।
সন্তান গর্ভধারণ আর লালন বিষয়ে জানাতে গিয়ে, রমা (২৩) বলেন, তার সন্তান ৩জন। তিনি প্রতি সন্তান প্রসবের কয়েক ঘন্টা আগেও নদীতে মাছ ধরেছেন। সরেজমিনে গিয়ে এ রকম দু-জন সন্তান সম্ভবা নারী জেলে পাওয়া গেছে । তাদের কথা মতো বুঝা গেল সন্তান প্রসবের বাকী আর মাত্র কয়েক দিন কিন্তু তারা এখনও ইলিশ ধরছে। তারা জানান, প্রসবের সময়ে অনেকেই কোন ঔষধ পথ্য ব্যবহার করে না। নৌকা বা নদী পাড়ের কোন ডেরায় তাদের প্রসব হয়।
মানতারা অভিযোগ করে বলেন, ইতোপূর্বে দেশের কয়েকটি জেলায় বেশ কয়েক জন মানতার নামে আশ্রয় কেন্দ্রের কক্ষ বরাদ্ধ নিয়েছেন স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। কিন্তু হস্তান্তরের সময় আর তাদের নাম পাওয়া যায়নি। তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের নামে বরাদ্ধকৃত কক্ষ থেকেও।
এ সম্প্রদায়ের মৃত্যু সর্ম্পকে জানাতে গিয়ে কাশেম সরদার জানান, মানতাদের মৃত্যু হলে আগেকার দিনে কলা গাছের ভেলায় লাশ ভাসিয়ে দেয়া হত। আজকের দিনে নদীর পাড়ে বা কোন পরিত্যক্ত ভিটে দানকৃত ভূমিতে ঠাঁই মিলে লাশটির। কেহ জমিদান না করলে বহরের সবাই চাঁদা দিয়ে ২-৩ হাজার টাকায় কবরের জমি কিনে মাটি দেয়। এ ভাবে মানতা নামের সংগ্রামী এক যোদ্ধার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা বলেন, ইতোমধ্যে মেঘনা সীমানায় বসবাসকারী ভাসমান জেলেদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করা হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যে আমরা বিষয়টির একটা পরিস্কার ধারণা পাবো বলে আশাকরী।