রাকিবুল হাসান, মনপুরা (ভোলা) প্রতিনিধি ::

ভোলার মনপুরা উপজেলার বনাঞ্চলে কাঁকড়া শিকার করে সংসার চলে প্রায় দুই হাজার জেলে পরিবারের। প্রতিদিন এসব জেলে জীবিকার তাগিদে বনের গহিনে ঢুকে কাঁকড়া শিকার করে। এদের মূল পেশা কাঁকড়া শিকার করা। কর্মসংস্থানের অভাব, স্বল্প পরিশ্রম ও বেশি মুনাফার আশায় বঙ্গোপসাগরের মোহনায় চর পিয়াল,চর পাতালিয়া,জংলা চর,বদনার চর,কাজিরচর, ১৬ নাম্বার চর,চর শামসুদ্দিন,জাগলার চর,বদনা চর,কাজির চর,মুক্তিযুদ্ধার চর ও চর কলাতলিসহ বিভিন্ন স্থানে কাঁকড়া শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করছে স্থানীয় মানুষ । দিনে দিনে শিকারির সংখ্যা বাড়ছে।কাঁকড়া আহরণ সহজলভ্য হওয়ায় অনেকেই এ পেশায় ঝুঁকে পড়েছেন। এ পেশায় নিয়োজিত হয়ে জীবিকা চলছে এ অঞ্চলের অন্তত ২ হাজার মানুষের। এ অঞ্চল থেকে কাঁকড়া রপ্তানি করে বছরে প্রায় শত কোটি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে।

প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যান্ত শুকিয়ে যাওয়া খাল, বিল, নদী ও ম্যানগ্রোভ বাগানে শিকারিরা নেমে পড়েন কাঁকড়া শিকারে। বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, মনপুরা উপজেলার সংরক্ষিত বনাঞ্চলের রয়েছে ৩০ হাজার ৫৫১.৭৯ একর । এ বনের মধ্যে বিভিন্ন খাল রয়েছে।বর্ষা মৌসুমে এ বনাঞ্চলে প্লাবিত হয়ে যায়।এ খাল গুলোর মধ্যে জোয়ার ভাটার পানি প্রবহমান। এ খালের বিভিন্ন স্থানে কাঁকড়া গর্ত তৈরি করে বসবাস করে। কাঁকড়া শিকারীরা বনের গভীনে ঢুকে খালের ওই কাঁকড়ার গর্তে লোহার রড দিয়ে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে কাঁকড়া শিকার করে ।

কাঁকড়া শিকার করে তারা প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় করে । এ দিয়েই চলে তাদের সংসার। প্রকারভেদে এসব কাঁকড়া ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি দরে আড়ৎদারের কাছে বিক্রি করে। আড়ৎদাররা এ কাঁকড়া ভারত, তাইওয়ান, কোরিয়া ও চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠাচ্ছেন ।

এ ব্যাপারে মৎস্য বিভাগ জানায়, মনপুরায় কাঁকড়া শিকার করে এমন কোন তালিকা নেই ,তবে প্রকৃতিক ভাবে বাগানে অনেকে কাঁকড়া শিকার ও বিক্রিৱ করে অনেক পরিবারই এখন সামলম্বী হয়েছেন। তবে নির্বিচারে কাঁকড়া শিকারের কারণে পরিবেশের বিরুপ প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কাঁকড়া শিকারীরা জানান, কাঁকড়া ব্যাপক সম্ভবাবনা থাকলেও তারা মৎস্য অধিদপ্তরের কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মনপুরা উপজেলার ৪টি ইউনিয়নে এবং মনপুরা থেকে বিচ্ছিন্ন চর গুলোতে প্রায় দুই হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু কাঁকড়া শিকার করে। তবে মনপুরা উপজেলা কাঁকড়া শিকার করে বেশির ভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ।

আরও জানা যায়, মনপুরা ৩০ হাজার একর ম্যানগ্রোভ বাগান জুড়ে আছে শতাধিক ছোট-বড় খাল। প্রাকৃতিক ভাবেই এসব খালে রয়েছে বিপুল পরিমাণ কাঁকড়া।

কাঁকড়া শিকারি জানান, কাঁকড়া শিকার করে দৈনিক ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা আয় করে। এ দিয়েই চলে সংসার। গহীন অরণ্যের মধ্যে জীবনের ঝুঁকিৱ নিয়ে কাঁকড়া শিকার করতে হচ্ছে । এ জঙ্গলে বিভিন্ন প্রজাতির সাপ ও বন্যপ্রাণী রয়েছে । ওই গুলোর সাথে মোকাবিলা করে কাঁকড়া শিকার করতে হয়। কাঁকড়া ব্যবসায়ী নিরব দাস বলেন,আগে মনপুরায় প্রচুর কাঁকড়া পাওয়া যেত,এখন কিন্তু আর তেমন পাওয়া যায় না ।তাই আমাদের ব্যবসা ও মন্দ হয়ে এখন মুখ ফিরে অন্য পেশায় চলে আসছি। কারণ এখন বন বিভাগ থেকে বন লিজ নিতে হয় সেখানে তাদের কে টাকা দিয়ে হয় ।শিকারীদের কে দাধন প্রদান করতে হয় ।এখন আর বনে কাঁকড়ার বিচরণ নেই ।প্রতিনিয়ত বনে বিষ প্রয়োগ করার কারণে কাঁকড়া কমে গেছে । তা ছাড়া সরকারি নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে না জানায় জেলে ও শিকারিরা দেদার কাঁকড়া আহরণ করে চলছে।

কাঁকড়া শিকারি বাবুল চন্দ্র দাস জানান,মনপুরায় ম্যানগ্রোভ বাগানের খালগুলোতে ১২ মাস কাঁকড়া শিকারের উপযোগী। তবে শীত কালে (পৌষ- মাঘে) কাঁকড়া বেশি ধরা পড়ে এবং এসময় কাঁকড়ার দামও বেশি থাকে।

নাইবেরহাট এলাকার কাঁকড়া আড়ৎদার কার্তিক চন্দ্র দাস জানান, ৫০০ গ্রাম ওজনের এক কেজি পুরুষ কাঁকড়ার দাম ৭০০ টাকা, ৪০০ গ্রাম ওজনের এক কেজি কাঁকড়ার দাম ৬৫০ টাকা, ৩০০ গ্রাম ওজনের এক কেজি কাঁকড়ার দাম ৫০০ টাকা, ২০০ গ্রাম ওজনের এক কেজি কাঁকড়া ৩০০ টাকা, ১০০ গ্রাম ওজনের এক কেজি কাঁকড়া বিক্রি হয় ২০০ টাকা । তা ছাড়া ডিমওয়ালা
২০০ গ্রাম ওজনের এক কেজি মাদি কাকড়ার দাম ৮০০ টাকা, ডিম ছাড়া খোসা এক কেজি কাঁকড়ার দাম ৪৫০ টাকা, ১৫০ গ্রাম ওজনের ডিমসহ এক কেজি কাঁকড়ার দাম ৪২০ টাকা, ডিম ছাড়া খোসা এক কেজি মাদি কাঁকড়ার দাম ২৫০ টাকা । তবে কাঁকড়ার দাম আরো বাড়তে পারে।

নাম প্রকাশে এক কাঁকড়া ব্যবসায়ী বলেন,১ বছরের জন্য বন বিভাগ ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে বনের আকার অনুযায়ী ২-৩ লাখ টাকার লিজ নিহে হয় ।প্রতি শিকারীকে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা দাধন প্রদান করতে হয় ।আন্তর্জাতিক বাজার তেমন ভালো না থাকায় এখন অনেক লোকসান গুনতে হচ্ছে ।

সচেতন মহল মহল মনে করেন মনপুরা স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে তদারতি করে কাঁকড়া চাষ প্রজনন মৌসুমে কাঁকড়া শিকার ও অবৈধ শিকার বন্ধ করা ।এই বনাঞ্চল থেকে সরকারের লাক্ষ লাক্ষ টাকা রাজস্ব আয়ের সুযোগ রয়েছে । সরকারের সুদৃষ্টি না থাকায় কিছু কুচক্র মহল এর সুবিধা নিচ্ছে বলে মনে করেন তারা ।

এ ব্যাপারে গ্রামীর জন উন্নয়ন সংস্থার ভ্যালু চেইন ফ্যাসিলিটেটর কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম জানান, মনপুরায় উপকূলে মাডসহ বিভিন্ন প্রজাতির কাঁকড়া চোখে পড়ে। এখান থেকে প্রতিবছর ৮০ থেকে ১০০ টন কাঁকড়া রপ্তানি হয়।সংস্থার হিসাব মতে কাঁকড়া আড়তের সঙ্গে ১৫ জন ব্যবসায়ী জড়িত। যারা শিকারীদের কাছ থেকে কাঁকড়া সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠাচ্ছেন ।সেখান থেকে ভারত, তাইওয়ান, কোরিয়া ও চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠাচ্ছেন ।

সাকুচিয়া পঁচা কোড়ালিয়া বিট কর্মকর্তা আব্বাস আলী বলেন,এই অঞ্চলের মানুষ বনের উপর নির্ভর করে চলে । তাই মানবিক চিন্তা করে তাদেরকে বনে কাঁকড়া শিকার করতে দিয়েছি ।এখানে কোন প্রকার টাকা পয়সা নেওয়া হচ্ছে না ।

মনপুরা রেঞ্জ কর্মকর্তা রাসেদুল ইসলাম জানান, কাঁকড়া শিকারের কথা শুনেছি, তবে আমাদের চোখে পড়েনি। তবে কেউ নির্বিচারে শিকারের চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে সংক্ষিত বন লিজ এর ব্যাপারে মোটফোনের জিজ্ঞেস করলে ব্যস্ত থাকার অজুহাতে লাইন কেটে দিচ্ছেন এই কর্মকর্তা ।

মনপুরা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিক্টর বাইন জানান, প্রাকৃতিকভাবেই যে সব কাঁকড়া পাওয়া যায়, সেগুলো ধরা যেতে পারে। কিন্তু নির্বিচারে কাঁকড়া শিকার করলে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়লে শিকারিদের ব্যাপারেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here