টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ফল ও সবজি বাগানে ক্ষতিকর হরমোন এবং কীটনাশক প্রয়োগ করায় মৌমাছি ও প্রাণ বৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। মৌ মাছিরা ফুল ফসল থেকে হরমোন যুক্ত খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। এ ভাবে মধুর জন্য বিখ্যাত মধুপুর গড়ে দিন দিন মৌ মাছি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। গড় এলাকার প্রায় সহস্রাধিক মৌচাষী দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
জানা যায়, লালমাটির মধুপুর গড় এলাকার মধুপুর, মুক্তাগাছা, ফুলবাড়ীয়া, ঘাটাইল, সখীপুর, ভালুকা ও জামালপুর সদর উপজেলায় আনারস, কাঁঠাল, কলা, সরিষা, তিল, তিষি, জলপাই, লিচু, আম, পেঁপেঁ, কুল, আদা, হলুদ, মিষ্টি কুমরা, লাউ, শিম, আলু, কাসাবা, কপি, গাজর, মুলাসহ বিভিন্ন কৃষিজ ফসল বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদন হচ্ছে। হাজার হাজার একরে নানা জাতের সবজির চাষ হয়। সরেজমিনে মধুপুর গড় এলাকার বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে জানা যায়, বাণিজ্যিক ফল ফসলের জমিগুলোতে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ও অধিক মোনাফা লাভের আশায় ব্যবহার করা হয় নানা ধরণের হরমোন ও কীটনাশক। শুধুমাত্র মধুপুর ও ঘাটাইল উপজেলার উচু এলাকার লালমাটিতে আনারস ও কলা বাগানে ২৭ ধরণের হরমোন ব্যবহার করা হয়। হরমোনে পাকানো ফল দেখতে সুন্দর হলেও খেতে বিস্বাদ। এ ধরণের পাকানো ফল খেলে পেটে পীড়া হয়। অথচ এসব ফসলের জমিই হলো মৌমাছিদের খাদ্য সংগ্রহের প্রধান ক্ষেত্র। মৌমাছিদের খাদ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত হরমোন ও কীটনাশক প্রয়োগের ফলে মৌমাছিসহ গড়ের প্রাণ বৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। এসব ফলের জমিতে পোকা মাকড় ও রোগ বালাই দমনের জন্য ব্যবহার করা হয় ১৭ প্রকার কীটনাশক। নিষিদ্ধ ঘোষিত ডিডিটিসহ ও ক্ষতিকর কীটনাশকের অবাধ ব্যবহার হচ্ছে। আনারস ও কলা বাগানে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ও ক্ষতিকর হরমোন ব্যবহার করায় মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট হচ্ছে। মৌমাছিসহ নানা ধরণের কীট পতঙ্গ বিলুপ্ত হচ্ছে। এভাবে ফলের উৎপাদন বাড়লেও বাড়েনি মধুর উৎপাদন বৃদ্ধি পায়নি মৌ মাছি। ফলে প্রাকৃতিক বন এলাকায় এখন খামার ভিত্তিক মৌমাছি পালন করা হচ্ছে। এক সময় মধুপুর বনে মৌমাছি ব্যাপক হারে দেখা যেত। এ বনে এখন মৌমাছি নেই বললেই চলে। প্রাকৃতিক বন উজার ফসলে ব্যাপক হারে ক্ষতিকর হরমোন কীটনাশক প্রয়োগের ফলে মৌমাছি বিলুপ্তি হয়ে যাচ্ছে। বিষাক্ত ফুল ও ফলের নেকটার সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রাণও হারাচ্ছে। ফলে মৌচাষীরা মৌ পালনে আগ্রহ ও ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এসব তথ্য মৌচাষিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে।
মধুপুর গড়ে প্রায় সহস্রাধিক বাণিজ্যিক মৌ-চাষি রয়েছে। কৃত্রিম পদ্ধতিতে তারা মৌচাষ করে থাকে। এখানে বার্ষিক মধু উৎপাদনের পরিমান গড়ে ২৫০ মেট্রিক টন। মৌচাষীরা জানান, একসময় মধুপুর গড়ে প্রচুর পরিমানে মধু আহরণ হত বলে এ এলাকার নাম হয়েছে মধুপুর। গজারীসহ প্রাকৃতিক বন হতে আদিবাসী গারো ও বনবাসীরা এক সময়ে প্রাকৃতিক মধু সংগ্রহ করতো। উৎপাদিত হত বিপুল পরিমান মোম। প্রাকৃতিক বনাঞ্চল সংকোচিত হওয়ায় আশির দশক হতে কৃত্রিম পদ্ধতিতে মৌচাষ শুরু হয়। মৌচাষ উন্নয়ন সংস্থা, বিআইএ, প্রশিকা ও গ্রামীণ ব্যাংক প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে সাবলম্বি করার জন্য সমপৃক্ত করে। পরে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে মৌচাষীর সংখ্যা। মধুপুর মৌচাষ উন্নয়ন সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল হোসেন জানান, মধুপুরে ৩৫টি মাল্টিনেশনাল কোম্পানী পেস্টিসাইডের উপর কাজ করছে। এরা যেসব কীটনাশক কৃষকদের ব্যবহার করার পরামর্শ দিচ্ছে তা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এর মধ্যে মৌমাছিরা সবচেয়ে বেশী ক্ষতির শিকার। কারণ এসব ফুল ফসল থেকে মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু হরমোন ও কীটনাশকের পাতানো ফাঁদে খাদ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে মৃত্যু মুখে পতিত হয়। তিনি এসব পরিবেশ বিদ্বেষী হরমোন কীটনাশক ব্যবহার না করার দাবী জানান। মধুপুর গড়ে মৌমাছির নেকটার সংগ্রহের বড় উৎস হল আনারস, কলা, সরিষা ও সবজি বাগান। কিন্তু ৭-৮ বছর ধরে আনারস ও কলা বাগানে নির্বিচারে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ও হরমোন প্রয়োগ করায় মৌমাছিরা নিরাপদে খাদ্য ও নেকটার সংগ্রহ করতে পারছেনা। গড় এলাকার কৃষকরা অজ্ঞতা বশতঃ সবজি বাগানেও একইভাবে হরমোন ও কীটনাশক প্রয়োগ করায় পরিবেশ বান্ধব মৌমাছি তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছে। মধুপুরে ৬শতাধিক মৌচাষী রয়েছে। কাকরাইদ গ্রামে গেলে কয়েকজন মৌচাষী এ প্রতিবেদককে জানান, কলা গাছের থোড় হতে মৌমাছি নেকটার সংগ্রহ করে। কিন্তু কলা বাগানে পোকা মাকড় দমনের জন্য কৃষক, শ্রমিক ও জমির মালিকরা বিভিন্ন কোম্পানীর বিষ প্রয়োগ করে। এ বিষ দ্বারা মৌমাছি সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এ জন্য থোড়ের ফুটন্ত ফুলে সেপ্র করা যাবে না। মৌমাছি সকাল বেলা নেকটার সংগ্রহ করে বলে দুপুরে এ বিষ প্রয়োগের নির্দেশাবলীও রয়েছে। কে শুনে কার কথা। বাগান মালিকরা সেটি না মানায় কলা বাগানের থোড় হতে নেকটার সংগ্রহ করতে গিয়ে বহু মৌমাছি মারা যাচ্ছে। অনেক সময় ক্ষতিকর কীটনাশক ও হরমোনের সংস্পর্শে এসে শ্রমিক মৌমাছি শুধু মারাই যায়না বরং সংগৃহিত বিষাক্ত নেকটারে পুরো মৌ কলোনী দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। তারা আরো জানান, মৌমাছি প্রকৃতি ও পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। মৌমাছি শুধ ু মধু ও মোম দেয়না; সার্থক পরাগায়নের মাধ্যমে ফুল, ফল ও ফসলের উৎপাদন নিশ্চিত করে। কিন্তু ফল ও সবজি উৎপাদনে নির্বিচারে ক্ষতিকর হরমোন মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করায় মৌমাছির মড়ক দেখা দিয়েছে, মধু উৎপাদন কমে যাচ্ছে, মৌ পালকরা দিন দিন ক্ষতির শিকার হচ্ছে। মধুপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প.প. কর্মকর্তা ডা. নুরুল হুদা জানান, কীটনাশক শুধু মৌ মাছিদের ক্ষতি করে না। মানব দেহেরও লিভার, কিডনী ও পেটের সমস্যা দেখা দেয়। মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্রত্যকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মারাত্মক ক্ষতি হয়।
ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/শাহরিয়ার সিফাত/টাঙ্গাইল