রহিমা আক্তার মৌ

রহিমা আক্তার মৌ :: ২৬৯ সালে ইতালির রোম নগরীতে সেন্ট ভ্যালেইটাইন’স নামে একজন খৃষ্টান পাদ্রী ও চিকিৎসক ছিলেন। ধর্ম প্রচার-অভিযোগে তৎকালীন রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস তাকে বন্দী করেন। কারণ তখন রোমান সাম্রাজ্যে খৃষ্টান ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। বন্দী অবস্থায় তিনি জনৈক কারারক্ষীর দৃষ্টহীন মেয়েকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। এতে সেন্ট ভ্যালেইটাইনের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে রাজা তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন।

কারো মতে ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি খ্রিস্টানবিরোধী রোমান সম্রাট গথিকাস আহত সেনাদের চিকিৎসার অপরাধে সেন্ট ভ্যালেনটাইনকে মৃত্যুদন্ড দেন। মৃত্যুর আগে ফাদার ভ্যালেনটাইন তার আদরের একমাত্র মেয়েকে একটি ছোট্ট চিঠি লেখেন, যেখানে তিনি নাম সই করেছিলেন `ফ্রম ইওর ভ্যালেনটাইন`। সেন্ট ভ্যালেনটাইনের মেয়ে এবং তার প্রেমিক মিলে পরের বছর থেকে বাবার মৃত্যুর দিনটিকে ভ্যালেনটাইনস ডে হিসেবে পালন করা শুরু করেন। যুদ্ধে আহত মানুষকে সেবার অপরাধে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত সেন্ট ভ্যালেনটাইনকে ভালোবেসে দিনটি বিশেষভাবে পালন করার রীতি ক্রমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

ভ্যালেনটাইনস ডে সর্বজনীন হয়ে ওঠে আরো পরে প্রায় ৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। দিনটি বিশেষভাবে গুরুত্ব পাওয়ার পেছনে রয়েছে আরো একটি কারণ। সেন্ট ভ্যালেনটাইনের মৃত্যুর আগে প্রতি বছর রোমানরা ১৪ ফেব্রুয়ারি পালন করত `জুনো` উৎসব। রোমান পুরানের বিয়ে ও সন্তানের দেবী জুনোর নামানুসারে এর নামকরণ। এ দিন অবিবাহিত তরুণরা কাগজে নাম লিখে লটারির মাধ্যমে তার নাচের সঙ্গীকে বেছে নিত। ৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে রোমানরা যখন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীতে পরিণত হয় তখন `জুনো` উৎসব আর সেন্ট ভ্যালেনটাইনের আত্মত্যাগের দিনটিকে একই সূত্রে গেঁথে ১৪ ফেব্রুয়ারি `ভ্যালেনটাইনস ডে` হিসেবে উদযাপন শুরু হয়। কালক্রমে এটি সমগ্র ইউরোপ এবং ইউরোপ থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

বর্তমানকালে, পাশ্চাত্যে এ উৎসব মহাসমারোহে উদযাপন করা হয়। যুক্তরাজ্যে মোট জনসংখ্যার অর্ধেক প্রায় ১০০ কোটি পাউন্ড ব্যয় করে এই ভালোবাসা দিবসের জন্য কার্ড, ফুল, চকোলেট, অন্যান্য উপহারসামগ্রী ও শুভেচ্ছা কার্ড ক্রয় করতে, এবং আনুমানিক প্রায় ২.৫ কোটি শুভেচ্ছা কার্ড আদান-প্রদান করা হয়।

খৃস্টীয় এই ভ্যালেন্টাইন দিবসের চেতনা বিনষ্ট হওয়ায় ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার কর্তৃক ভ্যালেইটাইন উৎসব নিষিদ্ধ করা হয়। ইংল্যান্ডে ক্ষমতাসীন পিউরিটানরাও একসময় প্রশাসনিকভাবে এ দিবস উদযাপন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এছাড়া অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও জার্মানিতে বিভিন্ন সময়ে এ দিবস প্রত্যাখ্যাত হয়। সম্প্রতি পাকিস্তানেও ২০১৭ সালে ইসলামবিরোধী হওয়ায় ভ্যালেন্টাইন উৎসব নিষিদ্ধ করে সেদেশের আদালত।

বিশ্ব ভালোবাসা দিবস এখন তরুণ-তরুণীর মাঝেই আটকে আছে অনেকটা। বিগত বছরগুলোতে এর প্রভাব ছিল বিস্তর, ইদানীং এক শ্রেনীর মানুষের কাছে এর জনপ্রিয়তা থাকলেও বিরোধিতা করছে অনেকে। তার কারন এই দিবসকে কেন্দ্র করে অনেক অঘটন ঘটছে। অল্প বয়সি ছেলে মেয়েরা অবাধ মেলামেশায় মক্ত হচ্ছে। ভালোবাসা দিবস পালন করতে গিয়ে তরুণী নিজের সম্মান হারাচ্ছে মুখোশধারী প্রতারক প্রেমিকের কাছে। অবশ্য এর বিরোধিতা করতে পারেন অনেকে। দিবসটি পারিবারিক অবস্থানে থাকলে হয়তো সমালোচনা হতো কম, পারিবারিক বললেও সেখানে নেই।

ব্যক্তিগত ভাবে আমার কাছে ভালোবাসা দিবসটি হল আনন্দের। আমি আমার পরিবারকে ভালোবাসি, পরিবারের সদস্যদের ভালোবাসি। কিন্তু এই দিনটাকে বিশেষ মনে করে ওদের জন্যে আলাদা একটু আয়োজন করাকেই ভালোবাসা দিসব মনে করি। ভালোবাসা মানেই অধিকার মনে করি। সেটা যার যার স্থান বুঝে। এই দিনে ওদের অধিকার আছে আমার থেকে কিছু পাওয়ার। তেমনি আমিও আশা করতে পারি ওদের কাছে। ভালোবাসা দিবসকে আমি কোন এক বা দুই শ্রেনীতে রাখি না। এটা সবার জন্যে। আমি আমার মা বাবা ভাই বোন সবাইকে প্রতিটা সময়, প্রতিটা দিনেই ভালোবাসি। তবুও এই দিনে আমি ওদের একটু খবর নিবো। ভালোবাসার শুভেচ্ছা জানাবো। হয়তো প্রতিদিন সবার সাথে কথা বলা হয় না, কিন্তু চেষ্টা করবো এই দিনে একটু কথা বলতে, এটাই আমার কাছে ভালোবাসা দিবস।

ভালোবাসা মানেই একটা অধিকার বোধ। আমি যাকে ভালোবাসি তার প্রতি আমার যেমন অধিকার থাকবে তেমনি থাকবে দায়িত্ব। ঠিক একই ভাবে তারও থাকতে হবে। সরাসরি ভালোবাসা হয় না কারো প্রতি। ভালোলাগা থেকেই জন্ম হয় ভালোবাসার। সেই ভালোলাগাটা সম্মানের হতে হবে। সম্মান না থাকলে ভালোলাগা কখনও ভালোবাসায় পরিনত হতে পারে না। আমি চাইবো এই দিনে অন্তত একটা বার সেই প্রিয় মানুষের একটা খুদেবার্তা পেতে। এটা আমার অধিকার

। অধিকার হালকা হয়ে গেলেই আমি বুঝি ভালোবাসা সেখানে আগের মতো নেই। ভালোবাসা হবে তার সাথে, যার সাথে নিজের সুখ দুঃখ শেয়ার করতে পারবো। নিজের অসুস্থ সময়ে সে আমার খবর নিবে, আমিও অসুস্থ অবস্থায় একটু শেয়ার করতে পারবো। ভালোবেসে শুধু সুখের পার্টনার হতে চাই না। ভালোবাসার মানুষ কখন কোথায় যায় সম্ভব হলে জানাবে। মনের কষ্টটা বলবে। অসুস্থ্যের খবর জানাবে। কিন্তু এখন এমন ভালোবাসা পাওয়াই কঠিন হয়ে গেছে। ভালোবাসায় কোন দেনা পাওনা হবে না, অথচ আমরা ভালোবাসা মানেই শুধু পাওয়া আর পাওয়া বুঝি।

পরিশেষে ভালোবাসা দিবসে আমার প্রিয়জন, শুভাকাঙ্ক্ষী সহ আপনজনদের শুভেচ্ছা জানাই। ভালো থাকার জন্যে আমরা তো অনেক কিছুই করছি। ভালোবাসা দিবসে যেন প্রিয় মানুষদের নিয়ে ভালো থাকতে পারি সেই প্রতিশ্রুতি করি। নিজে ভালো থাকি, অন্যকে ভালো রাখি। একটা কথা সব সময় বলি, যে কাউকে যে কারো ভালো লাগতেই পারে। ভালোবাসতেই পারে, তবে ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা চাই এই মানসিকতা দুর করতে হবে। জোর করে জমি দখল করা যায়, অন্যের ধন চুরি করে নিজের করা যায়। কিন্তু জোর করে ভালোবাসা আদায় করা যায় না। ভালোবাসতে বাধ্য করা যায় না। ভালো লাগলে ভালোবাসতে পারি বা পারেন, তয় ভালোবাসতেই হবে তা চাই না, চাওয়া ঠিকও না।

লেখক- সাহিত্যিক কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।
rbabygolpo710@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here