ভার্চুয়াল জগৎের বন্ধুত্ব ও শেকড়ের বন্ধুত্ব
সায়েম মাহামুদ কাজল :: আগস্ট মাসের প্রথম রবিবার হিসেবে আজকে বন্ধু দিবস। ইংরেজি ক্যলেন্ডারের হিসেবে রাত বারটা থেকেই ০৭ তারিখ শুরু।সেই তখন থেকেই বিভিন্নজন টেক্সট করে বন্ধু দিবসের শুভেচ্ছা জানানো শুরু করল। একটু সেকেলেই রয়ে গেলাম তাই আর কাউকে শুভেচ্ছা জানানোর মত সৌজন্যতাবোধ টুকুও দেখাইনি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই নিত্যকাজে বাসা থেকে বের হয়ে ক্যাম্পাসে পা রাখলাম। কিছুক্ষন পর হঠাৎ করে থমকে গেলাম।
কারণ, ছোট ভাইয়ের টেক্সট- ” কি ভাই, ছোট একটা যে ভাই আছে মনে হয় ভুলেই গেলি”। এ টেক্সটটা পাওয়ার পর আমারর তিনপ্রকার অনুভুতি হইছিল, প্রথমটা হাসি, দ্বিতীয়টা কান্না তৃতীয়টা ভাবনা। হাসির কারণ- সকাল সাতটায় আমি বাসায় ফোন দেই তখন মায়ের সাথে কথা হয়েছে ওর খোজ নিতেই বলল ঘুমে। সে হিসেবে বললাম যে ছোটতো তাই আবদারটা একটু বেশী।
কান্না- এর পেছনে একটা কারণ আছে যা আমার মত সকলকেই কাদায়। ২০১৪ সাল থেকে আমি স্নাতক ভর্তি হয়ে বাড়ির বাহিরে থাকি। ঐ বছরই আমার বাবাও আমাদের ছেড়ে চলে যান ওপাড়ে। আমার বড় ভাই আগে থেকেই গ্রামের বাহিরে। তৎক্ষনাৎ খুব লাগছিল ব্যাপারটা, নিজেও যেন ছোট হয়ে গেছিলাম।ষোল বছরের একটা ছোট্ট ছেলে একা থাকে কেমন তার অনুভুতি!!
ভাবনাঃ- এই টপিকে যাওয়ার জন্য এই অংশটা জরুরী। যখন আমি ২০১৪ সালে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসি তখন প্রায় প্রতিদিনই এলাকার ছেলে-মেয়ে গুলোর খোজ নিতাম। মায়ের খোজ নিতাম, ভাইয়্যাকেও কল দিতাম। অনেকে হয়ত প্রতিদিন ফোন দেয়াতে বিরক্তবোধও করত। কিন্তু আমি সেটাকে উপভোগ করতাম মন থেকে।সময়ের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে দিনদিন ভার্চুয়াল লাইফে ঝুকে পরি আমি।ঠিক তখন থেকেই গ্রামের সেই দিনগুলোও ভুলতে শুরু করি।
২০১৫ সালের কথা, আমি তখন অনার্স ফার্স্ট ইয়ার তথা দুই সেমিস্টার শেষ করে তৃতীয় সেমিস্টারে। একটু একটু পরিচিতি বাড়তে শুরু করে ক্লাস থেকে সেকসান, সেকসান থেকে ডিপার্টমেন্ট, ডিপার্টমেন্ট থেকে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়। আমি এখন খুব ব্যস্ত ভার্চুয়াল লাইফ নিয়ে।সকালে ঘুম থেকে উঠেই মোবাইলের ডাটা অপেন করতে হয় নাহয় যেন ঘুম ভাঙ্গবেনা অবস্থা। আবার সেই শেষ রাত অবধি সঙ্গি একটাই ভার্চুয়াল জগৎের কিংখান মোবাইল। এর বাহিরের সব ভুলে যেতে লাগলাম দিনদিন।
ঐদিন প্রথম-আলোতে একটকটা রিপোর্ট পড়েছিলাম, “মা মোবাইল টিপছে, ছেলে পানিতে ভাসছে”। আমার ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছিল। আমি যেন দিনদিন আপন ভুলে যাচ্ছিলাম।আমার মা আমাকে দুই-তিনদিন পর ফোন দিয়ে বলত,”কিরে একদম ভুলে গেছিস?”। কিসের মোহে পরে এমনটা হচ্ছিল তার হদিস পেতে আমার দুইটা বছর সময় লাগছিল। আজ ঠিক তিনবছর পর ২০১৮ সালের অগাস্ট মাসে এসে আমি আবার সেই পুরনো বাবুতে ফিরে যাচ্ছি। আমার হুস ফিরেছে, লাইক, কমেন্টট আর হাই-হ্যালোর বন্ধুত্ব থেকে দূরে সরে নিজের আপনকে কাছে নেয়র দীক্ষা নিচ্ছি রোমেন্টিক পয়েট্রি থেকে। ছোট-ভাইয়ের টোক্সট আমাকে অনেকটা ভাবিয়েছে।নিজেকে চিনতে নিজেকে ভালবাসতে গিয়ে নাহয় একটু আধটু সেকেলে বনে গেলাম তাতে আর তেমন ক্ষতি কোথায়??
ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের ক্ষনস্থায়ীত্বঃ যেকোন কারণে হঠাৎ করে ফেমিলিয়ারিটি কুবের হয়ে গিয়েছিলাম। সেটাও ২০১৫ সালের কথা।আমি তখন থেকে বেশী বেশী অনলাইনে থাকা শুরু করি। একজন দুইজন করে গুনগ্রাহী আমাকে টেক্সট দিতে থাকে বিভিন্ন পরামর্শ আদান-প্রদানের জন্য। এক পর্যায়ে তা পরামর্শ প্রদান থেকে অন্যদিকে মোড় নেয়।একদিন দুইদিন এমন করতে করতে একবছর। শেয়ারিংয়ের মাত্রাটা একটু বাড়তে শুরু করল। সবকিছুই শেয়ার করি এখন আমরা। আমার এমন কোন ফটো পাওয়া যাবেনা যেটাতে তার লাভ ইমো নাই এবং আমার সব ফটোই তার কালেকশানে থাকে। এমন করে একবছর চলল।
২০১৫ সেপ্টেম্বর -২০১৬ এর জুলাই মাস। সে হঠাৎ করে আমার পাশ থেকে স্রোতের আঘাতে ছিটকে পরে অর্থার্ৎ আমার সংস্পর্ষ আর তার প্রয়োজন নেই। সেই অপারেটর এখন আর আমাকে আগের মত চিনে না। এক ক্লিকেই তার ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে আমি বাদ পরে যাই, তার সাথে শেয়ার করা স্মৃতিগুলো শুধু অনলাইনে আসলেই চোখে পড়ে। এখন আর আমার ফটোগুলোতে তার লাভ ইমো নাই, প্রতিদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠলেই তার টেক্সট পাওয়া যায় না।
তবে হ্যা! এখন সে আমাকে মিস করে! যদি কোন দরকার পরে তখন হঠাৎ ম্যাসেন্জারের নিল বাততি জ্বলে উঠে আর স্ক্রিনকে আলোকিত করে ভেসে উঠে, “আই মিস ইউ … আমার এই কাজটা…!”
এটা বাস্তব ঘটনা। আমার সাথে ঘটে যাওয়া ভার্চুয়াল জগতের সবচেয়ে মনে রাখারমত একটা ইভেন্ট।ছোট বেলার বন্ধুরা যারা না বুঝেই আবেগের কারণে বন্ধুত্বের আবেশে জড়িয়ে পরে তারাই আসল বন্ধু। এরা শেকড়ের মত, শেকড় যেমন গাছ কেটে ফেলার পরেও বাকি থাকে এরাও তেমন দেহ চলে গেলেও মনে রাখবে বহুদিন।
বন্ধু দিবসে এসে আসল বন্ধু চেনাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন কাজ। সবাইকে দিয়ে তা হয়ে উঠে না। আপনি যদি পারেন তবেই আপনি সফল।
লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম। sayemkajal@gmail.com
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here