আরিফ চৌধুরী শুভ :: গায়ের চামড়া কেটে যদি জুতো বানিয়ে দাও ভারতকে, তাহলেও ঋণ শোধ হবার নয় একাত্তরকে স্মরণ করলে, কিন্তু জুতোর বিনিময়ে পাচ্ছে ঝাড়ু। স্বাধীনতার মিত্র শক্তি হিসেবে ভারতের এতটুকু প্রাপ্য ছিল বাংলাদেশের কাছে আজীবনের জন্য, কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র অর্ধশত বছরের মাথায় উচ্চশিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের নিউরণে ভারত ই বাংলাদেশের একমাত্র শত্রুতে পরিণত হয়েছে। এর জন্য বাংলাদেশ যতটা না দায়ী, তার সহস্রগুণ দায়ী কট্টর হিন্দুত্ববাদী ও মুসলিম বিদ্বেষী রাষ্ট্র ভারত নিজেই। অথচ মাত্র ১ যুগ আগেও দুদেশের সম্পর্ক ছিল ইলিশের স্বাদের মতো।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের চোখে না দেখে ভারতের শাসকগোষ্টি শুধু নিজেদের স্বার্থে দেখেছে যখনই সুযোগ পেয়েছেন। অথচ আমাদের ভাতের থালায় নারায়ন হতে পারতেন ইতিহাসের বড় অংশিদার হিসেবে, কিন্তু ভারতের বড়ই দুর্ভাগ্য। মৌদি সরকার ভারতের স্বার্থকে এতটাই প্রকট করেছেন, যেখানে ভবিষ্যত ভারতের জন্য বাংলাদেশের অনুগ্রহের পথ চিরতরে বন্ধ হবার পথে। দু:খ হচ্ছে ভারতের জন্য! কারণ আজকে আমাদের যে উচ্চ শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের মস্তিষ্কে ভারত শুধু স্বার্থবাদী ও কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র হিসেবে স্থান করে নিচ্ছে, সেই প্রজন্ম আগামী এক থেকে দেড় যুগ পর যখন ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবে, ঠিক তখনই টের পাবে ভারত। আজ যেমন ৭১ এর রাজাকার, জামায়াত, শিবির, মৌলবাদী ও তাদের অনুসারীরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির কাছে তারা কোনঠাসা হয়ে আছে। ঠিক তখনোও এমনটিই ঘটবে ভারতের ভাগ্যে। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। এরাও করবে না। ভারতই নিজের ভাগ্যকে নিজেই পোড়াচ্ছেন সীমান্ত হত্যা, তিস্তার পানি বন্টন, ট্রানজিট, রপ্তানী বন্ধ ও বিভিন্ন ইস্যুতে। ভূরাজনীতে বাংলাদেশ যে একটি ডায়মন্ড, তা মাত্র কয়েকদিন আগে চায়নার সাথে বাংলাদেশের একটি চুক্তির মাধ্যমে প্রথম ধাক্কাটি খেল ভারত। খেলা শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু কিছুই শিখলো না মৌদিজি।
২. কথায় কথায় ভারত বিদ্বেষী একটি প্রজন্মকে নিয়ে আরো বেশি দু:খ লাগে এই ভেবে যে, শুধু স্বাধীনতা বিপক্ষের শক্তি বা মৌলবাদীরাই না, উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের একটি শ্রেণি এই দেশকে শুধুমাত্র নিজেদের রুটি রোজগার আর অভায়াশ্রম ভাবেন মাত্র। কিন্তু কিভাবে এই স্বাধীন ভূমি তাদের অভায়াশ্রম হলো সেটি তাদের চিন্তার খোরাক হয় না কখনো। খাওয়া দাওয়া ঘুম আর বিলাসী জীবনই এদের বৃত্তবলয়। তার জন্য যা যা করা দরকার বরং তারা সেটিই করতে প্রস্তুত ও করছে। এদের পারিবারিক শিক্ষার চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দৌরাত্ব বেশি। রাষ্ট্র তাদের সেই সুযোগটি দিয়েছে। এরাই বিসিএস ক্যাডার হচ্ছেন, এরাই আমলা হবেন। এরাই হবেন জনপ্রতিনিধি। এরা এদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সরাসরি অস্বীকার করতে না পারলেও এদের মনের মধ্যে একটি ক্ষোভ, স্বার্থবাদী চিন্তার সৌরজগৎ তৈরি হয়ে গেছে এরই মধ্যে। এই সৌরজগতের গ্রহগুলো বিভিন্ন দিক দিয়ে অনেকটা প্রায় সঙ্গবদ্ধ। এদের সাথে মিশে গেছে একাত্তরের বৈরি শক্তির অনু পরমানু। এরা হয়ে গেছেন চাল, ডাল গোশতের মিশ্রিত খিঁচুড়ি না হয় কাঙ্গালভোজ। এদের উত্থানে খুব অদূর ভবিষ্যতেই বিলুপ্ত হবে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও আমাদের বীরত্বগাঁথার শোকগল্পগুলো। বিরঙ্গনারা আবারো ধর্ষিত হিসেবে চিহ্নিত হবে এদের চোখে। এরা শিক্ষিত তরুণ গ্যাং। এরাই বলে মুক্তিযুদ্ধ ব্যবসা ও চেতনা। মুক্তিযুদ্ধ এখন আর চলে না। আমার মতো এদের ঘরে যদি একজন মুক্তিযোদ্ধা বাবা রোজ এদের মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথা গল্প শুনিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ঘুমপাড়াতো, তাহলে এরা হয়তো এমন হতো না কখনো। অতীতের সমস্ত শাসকের রেকর্ড ভেঙ্গে এরা নিজেদের স্বার্থ হাছিলের শাসন ব্যবস্থা কায়েম করবে অদূর ভবিষ্যতে সেই চেষ্টায় ক্লান্ত । সেপথেই কি হাঁটছে স্বপ্নের বাংলাদেশ?
আমাদের শাসকগোষ্ঠির ক্ষমা অযোগ্য দৃশ্যমান কয়েকটি ব্যর্থতার কারণে এদের উত্থান হয়েছে। আমরা স্বৈরশাসককে বিদায় দিয়ে নিজেরাই বেসে গেছি সেই চেয়ারে। আমাদের চেয়ার বদল হয়েছে সত্য, কিন্তু চরিত্র বদল হয়নি। আমরা জাত পাল্টিয়েছি, কিন্তু জাতে উঠিনি। আমাদের নীতি নির্ধারকরা দালালে পরিণত হয়েছেন আর আমলারা হয়েছে পদবী আর অর্থলোভি। পুলিশ হয়েছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। অযোগ্যরা হয়েছেন চেয়ারের মালিক। বিচারহীনতা আমাদের আতঙ্কিত ও নিরাপত্তাহীন করেছে। রাষ্ট্রের প্রতিটি জায়গায় আজ ভাঙ্গনের সুর। আমরা একদিকে বলছি স্বাধীনতার চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, অপরদিকে মৌলবাদীদের কাছে টানছি রাজনৈতিক স্বার্থে। বাংলাদেশের পায়ে আমরা ঠিক ততবার ই কুড়াল মেরেছি, যতবারই স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি আমাদের পাশে স্থান পেয়েছে। তাই রক্ত আমাদের ঝরবেই।
৩. ভারত যেমনি তার কট্টর আর স্বার্থবাদী আচরণের কারণে বাংলাদেশ বিমুখ, তেমিন গুম, খুন, অন্যায়, জেল জুলুম আর হত্যার রাজনীতি বর্তমান শাসকগোষ্টির বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে উচ্চশিাক্ষত তরুণ প্রজন্মকে। এদের মধ্যে যেমন ক্ষমতার লোভ আছে, তেমনি এরাও দূর্নীতি থেকে নিজেদের আড়াল করতে পারবে না। কারণ এ শ্রেণির অভিজ্ঞতার তলানীতে বিত্ত বৈভর বিচরণ করে সকাল বিকাল। অভাব অনটনের মধ্য থেকে উঠে আসা এ তারুণ্য যেকোন পথেই হোক বিত্তশীল হওয়ার পথে হাঁটে। মুক্তিযুদ্ধ দেশপ্রেম এদের মুখে মুখে কিন্তু অন্তরে ভিন্নতা। সরকার এদের ভাষা বুজতে সম্পুন্নরুপে ব্যর্থ হয়েছে ২০১৩ সালের হেফাজতে ইসলামের মতো। হঠাৎ করে পঙ্গপালের মতো রাজধানী ভরে গেল গোলটুপি আর পাঞ্জাবিতে। শুরু হলো তাণ্ডব। যারা বলে মরলে শহীদ বাঁচলে গাজী কে ফিরাবে তাদের। তাদের ধ্যান জ্ঞান সব কিছুই বড় হুজুর। হুজুর যাই বলে তাই তাদের আকিদা। আর এমন মানব সন্তান নিয়ে বেকায়দায় পড়েছিল বাংলাদেশ। মুক্তি কি মিলেছে? এককথায় না!
সরকার যতই বলুক, দৃশ্যত বাংলাদেশ এই মুহূর্তে “হেফাজতি ভাবধারায় পরিচালিত” হচ্ছে। তাদের ১৩ দফার প্রায় ১০টি দফা সরকার মেনে নিয়ে প্রচলনও করেছেন। সুতরাং আহমদ শফীর মৃত্যু মানেই হেফাজতি রাজনীতির শেষ নয়। শেষকালে ক্ষমতার কামড়া-কামড়িতে আহমদ শফী পরাজিত হয়েছেন সত্যি, কিন্তু আরও বেশি ক্ষমতার কামড়া-কামড়ির সূচনা করে গেলেন। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এই রাজনীতির সাথে ধর্মের কোনো সংশ্রব্য না থাকলেও পুরোটাই অর্থনৈতিক এজেন্ডার ছকে সাজানো। তাই রাজনীতিটা শেষ নয়, নতুন ফ্রন্টে শুরু হলো গতরাত থেকে। এই শুরুতে কারো সূর্য অস্তমিত হবে আবার কারো হবে উদিত। কে হবে কান্ডারী হতভাগা বাংলাদেশে?
লেখক: উদ্যোক্তা ও অন্যতম সংগঠক, নো ভ্যাট অন এডুকেশন আন্দোলন, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, জাতীয় পাঠাগার আন্দোলন। শিক্ষার্থী (মার্স্টাস)আন্তার্জাতিক সম্পর্ক ডিপার্টমেন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।