জাতীয় অধ্যাপক, বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক কবীর চৌধুরী ইহলোকের মায়া ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ৮৮ বছর বয়সে মঙ্গলবার ভোর ৬টায় নয়াপল্টনের নিজ বাসায় তিনি মারা যান।

মহান এই ব্যক্তিকে তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী কোন ধরনের লৌকিকতা ছাড়াই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে নামাজে জানাযা শেষে সন্ধ্যায় মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

‘জীবন যখন শুকায়ে যায়/করুণা ধারায় এসো’— করুণা ধারায় মিশে যাবার আগ্রহেই যেন মিশে গেছেন যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে সোচ্চার, জনতার অগ্রদূত এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক কবীর চৌধুরী।

আকণ্ঠ যার ছিলো জ্ঞান পিপাসা, তাকে কি মৃত্যু থামিয়ে দিতে পারে? তাই চিরতরে ঘুমিয়ে যাওয়া মানুষটি ঘুমিয়ে আছেন ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই বাংলাদেশের মানুষের মননে।

কবীর চৌধুরীর পরিবার থেকে জানানো হয়েছে, রাজধানীর নয়াপল্টনে নিজ বাসভবনে মঙ্গলবার ভোররাতের কোনো একসময় ঘুমন্ত অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তবে দীর্ঘদিন ধরেই তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। গত রবিবার হৃদযন্ত্রের পেসমেকারটি পাল্টে ফেলা হয় তার নিজ বাড়িতে।

জীবনের শেষ রাতের মুহূর্তগুলো সম্পর্কে কবীর চৌধুরীর মেয়ে শাহীনা কবীর জানালেন, মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে মিষ্টি খেতে চেয়েছিলেন তিনি। পরে একটু চকলেট খাইয়ে দিয়ে গায়ে চাদর দিয়ে ঢেকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলেন শাহীনা। তার কিছুক্ষণ পরে কোনো এক সময়ে অধ্যাপক কবীরের মৃত্যু হয় ওই বিছানায়।

১৯২৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন এই শিক্ষাবিদ। তার পৈতৃক ভিটা নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার গোপাইরবাগ গ্রামের মুন্সী বাড়ি।

তার বাবা আবদুল হালিম চৌধুরী ও মা আফিয়া বেগম ছোটবেলা থেকেই সন্তানদের দিয়েছেন উদার ও মুক্তচিন্তার এক পারিবারিক পরিমণ্ডল। সেখান থেকেই বেড়ে ওঠেন তিনি, তাঁর ভাই শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী, বোন ফেরদৌসী মজুমদারের মতো বাংলাদেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিরা।

কবীর চৌধুরীর শিক্ষাজীবন ছিলো কৃতিত্বপূর্ণ। আজীবন অসামান্য মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন কবীর চৌধুরী। সবকিছুকে চিন্তা করেছেন বুদ্ধি, যুক্তি আর মানবতার মানদণ্ডে।

১৯৩৮ সালে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৪০ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৪৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম এবং পরের বছর একই বিষয়ে এমএতেও প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করেন তিনি। অসম্ভব মেধাবী এই মানুষটিকে সম্মান জানাতে ১৯৯৮ সালে তাকে জাতীয় অধ্যাপক করা হয়।

পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন কবীর চৌধুরী। পরে রাজশাহী সরকারি কলেজ, ঢাকা কলেজ, বরিশালের বিএম কলেজ ও ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে শিক্ষকতা করেন।

১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। স্বাধীনতার পর তিনি প্রথম জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

সর্বশেষ ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। সুপারিশ করেন উদার ও অসাম্প্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থা চালুর।

তাই স্বাধীন দেশে তিনি সোচ্চার হয়েছিলেন ওই সময়কার মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবিতে। নব্বইয়ের দশকে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সমমনাদের নিয়ে গঠন করেন ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, মৃত্যুর আগেই কবীর চৌধুরী তার মৃত্যু-পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে শেষ ইচ্ছার কথা লিখে গেছেন। তার শেষকৃত্য নিয়ে কোনো ধরনের আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন হোক, তা তিনি চাননি।

তার সেই ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কবীর চৌধুরীর মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হয়নি। তবে তিনি চেয়েছিলেন শেষবারের মতো তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে যেতে। সেই ইচ্ছাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে বাদ আসর তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

জানাজা শেষে তাকে গার্ড অব অনার দেওয়া দেওয়া হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ব্যক্তি এবং সর্বস্তরের মানুষ ফুল দিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এরপর মরদেহ দাফনের উদ্দেশে শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।

কবীর চৌধুরীর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া শোক প্রকাশ করেছেন।

তার মৃত্যুর খবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন অঙ্গনের বরেণ্য ব্যক্তিরা নয়া পল্টনে কবীর চৌধুরীর বাসায় ছুটে যান তাকে শেষবারের মতো দেখতে। রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে তার পিএস ফজলুল হকও এই শিক্ষকের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান।

মৃত্যুর খবরে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, ‘অজস্র সাহিত্যকর্ম দিয়ে তিনি জাতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের আন্দোলনে জাতিকে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন, সংগ্রাম করেছেন।’

কবীর চৌধুরীকে দেখতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, উদার মানসিকতা ও মুক্ত চিন্তার ধারক ছিলেন কবীর চৌধুরী। জাতির দুঃসময়ে সুচিন্তিত ও মূল্যবান পথনির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার ৪০ বছরেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে যেতে না পারায় আক্ষেপ থাকবে তার। তবে আমরা আশা করি, এ বিচার শিগগিরই হবে। তিনি পরপার থেকে তা দেখবেন, তার আত্মা শান্তি পাবেন।’

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, দেশের যে কোনো সংকটে এগিয়ে এসে কবীর চৌধুরী অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠনে পরিণত বয়সেও কবীর চৌধুরী সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন।

এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়র উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, পরিকল্পনামন্ত্রী একে খন্দকার, যোগাযোগসমন্ত্রী ওবায়েদুল কাদের, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ, মাহবুব-উল আলম হানিফ, সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম খান, চলচ্চিত্রকার নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু সকালেই কবীর চৌধুরীর বাসায় আসেন তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।

অধ্যাপক কবীর চৌধুরী তাঁর জীবদ্দশায় অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি ১৯৯১ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। স্বাধীনতা পদক লাভ করেন ১৯৯৭ সালে।

তার উল্লেখযোগ্য সম্মাননাগুলো হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের স্বর্ণপদক (১৯৬৮), হাবীব ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার, লেখক সংঘ পুরস্কার (১৯৬৯), ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭০), রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সম্মাননা পদক (১৯৭৩), মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৮৬), ভারতের উইলিয়াম কেরি স্বর্ণপদক (১৯৯৪), বঙ্গবন্ধু জাতীয় পুরস্কার (১৯৯৪), সুফী মোতাহার হোসেন সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৮), শহীদ সোহরাওয়ার্দী জাতীয় পুরস্কার (১৯৯৯), কবি জসীমউদ্দীন পুরস্কার (১৯৯৯), বিশ্ব বাঙালি সম্মেলন পুরস্কার (২০০১), ওয়ার্ল্ড পোয়েট্রি গোল্ডেন অ্যাওয়ার্ড (২০০৪), নাগরিক নাট্যাঙ্গন সম্মাননা (২০০৫), বিশ্ব নাটক দিবস সম্মাননা (২০০৬) প্রভৃতি।

ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/স্টাফ রিপোর্টার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here