সজল দেব, মৌলভীবাজার
নিজের ইজ্জতের বিনিময়ে জীবন ঝুঁকি নিয়ে যে ত্যাগী মহিলা পাক হানাদারের কবল থেকে স্বামীসহ ছয় ব্যাক্তিকে মুক্ত করলেন স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরও বীরাঙ্গনার স্বীকৃতিটুকু তাহার ভাগ্যে জুটেনি। জাতীর শ্রেষ্ট সন্তানদের অন্যতম সাফিয়া বেগম বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়েও জীবিকা নির্বাহ করেন ভিক্ষা করে।
সাহায্য সহযোগিতাতো দুরের কথা, কেউ খোঁজও নেয় না। বর্তমানে তিনি দু’বেলা দু’মুটো না খেয়ে কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যূর প্রহর গুনছেন। উদ্দিনের মাধ্যমে খোঁজ মিলে বীরাঙ্গনা সাফিয়া বেগমের। মঙ্গলবার মেম্বারের ডিমাই বাজারস’ অফিসে বসে ’৭১ এর দূঃসহ আর ভয়ঙ্কর দিনগুলোর স্মৃতিচারন করতে সত্তরোর্ধ বীরাঙ্গনা সাফিয়া বেগম কেঁদে উঠেন। তিনি জানান, তাদের আদি বাড়ী ছিল কুমিল্ল্লায়।
৭/৮ বছর বয়সে পিতা-মাতা অন্যান্য ভাই বোনসহ বড়লেখা উপজেলার সদর ইউনিয়নের মধ্য ডিমাই এলাকায় চলে যান। খাস ভুমিতে ঘর তৈরী করে বসবাস শুরু করেন। কিশোরী সাফিয়া বেগমের বিয়ে হয় স’ানীয় যুবক ছিদ্দিকুর রহমানের সাথে। ভালই চলছিল তাদের দাম্পত্য জীবন। বছর ঘুরতেই তাদের ঘর আলো করে জন্ম নেয় এক পুত্র সন্তান। কিছু দিন পর দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। সাফিয়ার ছোট ভাই আবুল কাশেম দেশ মাতৃকার টানে মাটি ও মানুষকে মুক্ত করতে ঝাপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। আরেক ভাই গাইড হিসাবে মুক্তি বাহিনীকে পথ প্রদর্শন করে একের পর এক সফল অপারেশনে সহযোগিতা করতে থাকেন। স’ানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে এ খবর দ্রুত পৌঁছে যায় পাক শিবিরে। শুরু হয় ডিমাই এলাকায় সাধারন মানুষের উপর নরপিচাশদের নির্বিচার জুলুম নির্যাতন। রাজাকাররা সাফিয়া বেগমের স্বামী ছিদ্দিকুর রহমানসহ ১৮ জনের নামের তালিকা পাক বাহিনীর নিকট তুলে দেয়।
রাজাকারদের নেতৃত্বে পাকিস’ানী হায়েনারা ছিদ্দিকুর রহমান, আকবর আলী, আখমল আলী, আব্দুল খালিক (১), আব্দুল খালিক (২), আব্দুল লতিফসহ ১৮ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে যায়। স্বামী ছিদ্দিকুর রহমানের দেয়া তথ্যানুযায়ী সাফিয়া বেগম আরো বলেন, প্রথমে পাক বাহিনীর জুড়ী ক্যাম্পের ইনচার্জ ক্যাপ্টেন ফরিদের নেতৃত্বে তাদের উপর অমানসিক নির্যাতন চালানো হয়। চারদিন পর তাদেরকে বড়লেখা ক্যাম্পে পাঠানো হয়। ক্যাম্প ইনচার্জ মেজর আজম মুক্তিযোদ্ধাদের অবস’ান সম্পর্কে তথ্য উদঘাটন করতে নির্যাতন চালায়। এসময় পাকিস’ানী খানসেনারা আটক ১৮ জনের ১২ জনকে গুলি করে হত্যা করে। সাফিয়া বেগম বাড়ী ছেড়ে সীমান্তবর্তী অরণ্যে আশ্রয় নেন। স’ানীয় রাজাকাররা ছিদ্দিকুর রহমানের স্ত্রী সাফিয়া বেগমের রূপ সৌন্দর্যের বর্ননা তুলে ধরে পাক সেনাদের কাছে।
নারী লোভী পাকিস’ানী হানাদার মেজর আজম রাজাকারদের সাথে নিয়ে ডিমাই গ্রামে প্রচার করে সাফিয়া বেগম ক্যাম্পে হাজির হলে আটক ছয়জনকে ছেড়ে দেয়া হবে। আত্মগোপনে থাকা সাফিয়া বেগমের কাছে এ খবর পৌঁছে গেলে পরিবারের নিষেধ উপেক্ষা করে তিনি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্যাম্পে হাজির হন। সাফিয়া বেগম হাজির হওয়ার পরও দীর্ঘদিন আটক ছয় জনকে মুক্তি দেয়নি হায়েনারা। এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে এভাবে বিভিন্ন ক্যাম্পে আটকে রেখে ক্যাম্প ইনচার্জ থেকে শুরু করে সাধারন সিপাহী পর্যন্ত সাফিয়ার উপর পাশবিকতা চালায়। নরপশুরা শুধু সাফিয়ার শরীর খাবলে খুবলে ক্ষান্ত থাকেনি। পিটিয়ে বাম হাত ও কয়েকটি আঙ্গুল ভেঙ্গে ফেলে। আজও অনেকটা পঙ্গুর মত চলাফেরা করেন বীরাঙ্গনা সাফিয়া। এরপর বড়লেখা সদর ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান মরহুম হাবিবুর রহমানের সহযোগিতায় লাতু ক্যাম্প থেকে তিনিসহ আটক ছয়জন ছাড়া পান। কয়েকদিনের মধ্যে দেশ স্বাধীন হয়। পাক বাহিনীর শিবির থেকে ফিরে আসা সাফিয়া বেগমের স্বামীসহ ছয়জনের সকলেই পঙ্গুত্ব নিয়ে কিছুদিন বেঁচে থাকেন।
বীরাঙ্গনা সাফিয়া বেগম অশ্রুসজল কন্ঠে বলেন, বীরাঙ্গনা কি জিনিস তা জানা নেই, তবে এটুকু জানি যেসব রাজাকাররা তাকে পাকিস’ানীদের হাতে তুলে দিয়েছিল, ইজ্জত লুটেছিল তাদের কয়েকজন এখনও বেঁচে আছে। তাদের কোন বিচার হল না। শরীরে শক্তি সামর্থ থাকাবস’ায় এ বাড়ী ও বাড়ী ঝিয়ের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও এখন ভিক্ষা করে জীবন চালাই। পেটে ভাত নাই, শরীরে শক্তি নাই, মাথা গুচার টাই নেই, চিকিৎসার পয়সা নেই। তিনি প্রশ্ন রাখেন দেশের জন্য সম্ভ্রম বিলিয়ে দিয়ে আমার কি লাভ হল!
ইউপি মেম্বার সিরাজ উদ্দিন জানান, সাফিয়া বেগম বীরাঙ্গনা হিসেবে কোন সুযোগ সুবিধা পান বলে জানা নেই, তবে মাঝে মধ্যে তিনি সাফিয়া বেগমকে ইউনিয়ন থেকে চাল/গম সহায়তা দেন।