গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরের বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের আজ রবিবার আখেরী মোনাজাত। বহু কাঙ্খিত বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এ আখেরী মোনাজাতের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হবে এবারের ৪৭ তম বিশ্ব ইজতেমা। গতকাল শনিবার এ পর্বের ইজতেমার লাখো মুসল্লিদের ইবাদত-বন্দেগীর মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় দিন অতিবাহিত হয়। দেশ বিদেশের লাখো ধর্মপ্রাণ মুসল্লির উদ্দেশ্যে ঈমান, আমল, দ্বীনের দাওয়াত, এবাদত-বন্দেগী সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের আলোকে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করা হয়।

গতকাল বাদ ফজর থেকে বাদ মাগরিব পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বয়ান করেন যথাক্রমে মাওলানা রবিউল ইসলাম, হযরত মাওলানা আব্দুল ওহাব, হযরত মাওলানা যোবায়েরুল হাসান ও হযরত মাওলানা মোহাম্মদ সাদ। বয়ানে আলেমগণ বলেন,  দুনিয়ার আরাম আয়েশ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। আর পরকাল দীর্ঘস্থায়ী । তাই পরকালের দীর্ঘস্থায়ী আরাম আয়েশের জন্য সকলকে দুনিয়াতে কঠিন মেহনতের মাধ্যমে তৈরি হতে হবে। ঈমান, আমল ছাড়া কেউ হাসরের ময়দানে কামিয়াব হতে পারবে না। বক্তাগন আরোও বলেন, মহান আল্লাহ তাআলার শ্রেষ্ট নবী (সাঃ) শেষ উম্মত হিসেবে দ্বীনের কাজকে আমাদের জরুরী মনে করতে হবে। মানব জাতিকে সৎ কাজে উদ্বুদ্ধ ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখার দায়িত্ব প্রতিটি উম্মতে মোহাম্মদের। তাই  দ্বীনের দাওয়াত তাবলীগের রাস্তায় ধর্মপরায়ন মুসলমানদের বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে হবে।

ইজতেমা ময়দানে দায়িত্বে নিয়োজিত একাধিক সূত্রে জানা গেছে বেলা ১২ টার পর যে কোন সময় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এ আখেরী মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। দেশ বিদেশের আনুমানিক বিশ লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান মোনাজাতে শরীক হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

প্রথম পর্বের আখেরী মোনাজাত পরিচালনাকারী দিল্লীর হযরত মাওলানা যোবায়েরুল হাসান দ্বিতীয় পর্বের আখেরী মোনাজাতও পরিচালনা করবেন বলে আয়োজকদের ধারণা।

গতকাল দুপুরে ইজতেমা ময়দানে গিয়ে দেখা যায়, পুরো ইজতেমাস্থল বিশাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। এবারও দুর দুরান্তের বহু মুসল্লিকে বিশাল চটের প্যান্ডেলে স্থান না পেয়ে আশেপাশের  এলাকায় ও খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করতে দেখা যায়। বহু মুসল্লি তাদের নিজস্ব উদ্যোগে সামিয়ানা টানিয়ে নিচ্ছেন।

আখেরী মোনাজাতে শরীক হতে গতকালও দিবা-রাত্রি চারদিক থেকে অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মুসল্লিকে বিভিন্ন যানবাহন ও পায়ে হেটে ইজতেমাস্থলে পৌঁছতে দেখা যায়। আজ রবিবার আখেরী মোনাজাতের আগ পর্যন্ত এ জনস্্েরাত অব্যাহত থাকবে।

আজ আখেরী মোনাজাতে মুসল্লিদের আংশগ্রহণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য গাজীপুর জেলা পুলিশের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর পুলিশ বিশেষ যানবাহন ও পথচারী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

এ পর্বেও আখেরী মোনাজাতে অংশগ্রহণ সহজতর করার লক্ষ্যে জেলা তথ্য অফিস ও গণযোগাযোগ অধিদফতরের উদ্যোগে টঙ্গী চেরাগআলী মার্কেট থেকে উত্তরা আব্দুল্লাপুর পর্যন্ত মহাসড়ক ব্যতীত শাখা সড়ক ও অলিগলিতে পর্যাপ্ত মাইক সংযোগের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

প্রায় ৬ হাজার বিদেশী মেহমান

গতকাল শনিবার পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় ৬ হাজার বিদেশী মেহমান ইজতেমাস্থলে পৌঁছেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। দেশ গুলোর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, মিসর, কাতার, ইরান, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, জর্দান, মরক্কো, বাহরাইন, ভারত, পাকিস্তান ইত্যাদি।

তাশকিলের কামরায় চিল্লাভূক্ত মুসল্লিগণ

দ্বিতীয় পর্বেও ইজতেমা মাঠের উত্তর পার্শে চিল্লায় অন্তর্ভূক্তি হওয়া জামাতিদের জন্য তাশকিলের কামরা স্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন মেয়াদে চিল্লায় অংশ গ্রহণেচ্ছু মুসল্লিদের তালিকাভূক্ত করা হয়েছে। এবং বিভিন্ন খিত্তা থেকে তাদের তাশকিলে কামরায় নেয়া হচ্ছে। পরে কাররাইল মসজিদের তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বিদের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এলাকা ভাগ করে তাদের দেশের বিভিন্ন এরাকায় দিনের দাওয়াতের কাজে পাঠানো হবে।

গাড়ী পার্কিং

ইজতেমা উপলক্ষে মুসল্লিদের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে গতকাল শনিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রবিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ধউড় ব্রিজ থেকে াাব্দুল্যাপুর হয়ে প্রগতী স্বরণী এবং টঙ্গী ব্রিজ থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত বিমান যাত্রীবাহি গাড়ী, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ী ও এ্যাম্ভুলেন্স ছাড়া সকল প্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে।

এ ছাড়া নরসিংদী ঘোড়াশাল থেকে পূবাইল কালীগঞ্জ হয়ে আসা যানবাহন টঙ্গী রেল জংশনের পূর্ব পার্শে মরকুন পর্যন্ত চলাচল করতে পারবে। ঢাকা সিলেট মহাসড়ক থেকে ঘোড়াশাল হয়ে ঢাকাগামী যানবাহন কাচপুর যাত্রাবাড়ি সড়ক ব্যবহার করবে।

আরো একজন মুসল্লীর মৃত্যু

বিশ্ব ইজতেমায় আগত আরো একজন  মুসল্লি ইন্তেকাল করেছেন। তার নাম নজির আহাম্মেদ (৭২)। তার বাড়ী নোয়াখালীর হাতিয়া থানার রেহানিয়া গ্রামে। গতসন্ধ্যায় ইজতেমাস্থলে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে টঙ্গী হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়।এ নিয়ে এ পর্বের বিশ্ব ইজতেমায় আগত  মৃত্যের সংখ্যা দাঁড়ালো ২ এ।

মোবাইল কোর্ট

গতকালও ইজতেমা মাঠ ও আশেপাশের এলাকায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। এসময় ম্যাজিষ্ট্রেট মুনতাসিমুল ইসলাম ও শহিদুজ্জামান পৃথক দুটি মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ১৬টি মামলা দায়ের এবং ৪৮ হাজার ৭৫০টাকা জরিমানা আদায় করেন।

টঙ্গী  হাসপাতালে ২৭ জন ভর্তি

গত ২৪ ঘন্টায় ইজতেমায় আগত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত মুসুল্লীরা  টঙ্গী হাসপাতালসহ ৩টি স্ব্যাস্থ্য ক্যাম্পে ৩ হাজার ৬২৪ জন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। এদের মধ্যে ২৭ জনকে টঙ্গী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য ৬ জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজসহ বিভিন্ন হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়ে।

শতাধিক যৌতুকবিহীন বিয়ে সম্পন্ন

এ পর্বেও ইজতেমার দ্বিতীয় দিনে ইজতেমাস্থলে হযরত ফাতেমা (রাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ) বিয়ের দেনমোহর অনুসারে যৌতুকবিহীন শতাধিক বিয়ে সম্পন্ন করা হয়েছে। বিয়ের পুর্বে বাদ আছর দিল্লীর হযরত মাওলানা যোবায়রুল হাসান বয়ান করেন। বয়ান শেষে এই সকল বর-কনের অভিভাবকদের সম্মতিতে বরের উপস্থিতিতে বিয়ে পড়ানো হয়। বিয়ে শেষে উপস্থিত দম্পত্তিদের স্বজন ও মুসল্লিদের মধ্যে খুরমা খেজুর বিতরণ করা হয়।

বিভিন্ন অভিযোগে আটক- ২২

গত তিন দিনে ইজতেমা মাঠ ও আশেপাশের এলাকা থেকে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা পকেটমার, ভাসমান হকারসহ ২২ জনকে আটক করেছে।পুলিশ জানায়, এদের মধ্যে অধিকাংশই মুসলেকা  ও কানধরে উঠবস করে দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

পর্যাপ্ত  নিরাপত্তামুলক ব্যবস্থা

প্রথম পর্বের ন্যায় দ্বিতীয় পর্বেও মুসল্লিদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তামুলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পুরো টঙ্গী এখন ঘিরে আছে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী সংস্থার নজরদারিতে। র‌্যাব ও পুলিশের ১৪টি ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে ইজতেমা মাঠ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এছাড়া সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সদস্যরা প্যান্ডেলের বিভিন্ন খিত্তায় নজরদারী রাখছেন।

শীতের প্রকোপে মুসল্লিদের দুর্ভোগ

শুক্রবার রাতে এবং গতকাল সকালে প্রচন্ড শীত অনুভুত হওয়ায় ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বিশেষত বয়স্ক মুসল্লিদের ওজু গোছল ও পয়ঃপ্রণালী কার্য সম্পাদনে সমস্যায় পড়তে হয়। অন্যদিকে শীতের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় বহু মুসল্লি, জ্বর, সর্দিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এজন্য ইজতেস্থলে ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পে ও টঙ্গী হাসপাতালে আক্রান্ত রোগীদের প্রচন্ড ভিড় দেখা যায়।

ইউনাইটেডই নিউজ ২৪ ডট কম/কাজী মোসাদ্দেক হোসেন/গাজীপুর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here