ইয়ানূর রহমান যশোর প্রতিনিধি ::

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সেই তামান্না আক্তার নুরা এবার গুচ্ছভুক্ত-২২ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ‘ক’ ইউনিটে উর্ত্তীণ হয়েছেন। বৃহস্পতিবার বিকালে গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ওয়েবসাইটে গুচ্ছের ‘ক’ ইউনিটের ফল প্রকাশিত হয়। এবারের পরীক্ষায় পাসের হার ৫৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এর মধ্যে প্রকাশিত ফলাফলে তামান্নার মার্কস এসেছে ৪৮.২৫। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তামান্না আক্তার নুরা নিজেই।

এর আগে, গত ৩০ জুলাই যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাডেমিক ভবনের কেন্দ্রীয় গ্যালারিতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন।

তামান্না যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া আলীপুরের রওশন আলী ও খাদিজা পারভীন শিল্পী দম্পতির সন্তান। অদম্য এই তরুণী শুধুমাত্র একটি পা দিয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সবকটি পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে চমক দেখিয়েছিলেন।

তার এই সাফল্যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহেনা খোঁজখবর নেন। একই সঙ্গে তারা দুই বোন তামান্নার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসেন। তার চিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থাও করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর এই দুই কণ্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা।

মেধাতালিকা প্রাথমিকভাবে উর্ত্তীণ উচ্ছাসিত তামান্না জানান, ‘প্রাথমিক রেজাল্টে খুশি লাগছে। মার্কসও ভালো। আশাকরি যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছা থাকলেও অন্যান্য ভাই-বোনদের খরচ চালিয়ে বাবার পক্ষে তাকে পড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে, তাই যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছা তার। তার যে মার্কস এসেছে সেই
মার্কস দিয়ে তিনি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) মাইক্রোবাইলোজি অনুষদভুক্ত চয়েজ দিবেন বলে জানান তিনি। আশাকরি আল্লাহর ইচ্ছায় মাইক্রোবাইলোজিতেই পড়ার সুযোগ পাবো।

তামান্নার বাবা রওশন আলী জানান, তার স্বপ্ন গবেষণাধর্মী কোনো বিষয়ে পড়াশোনা করে বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরি নেওয়ার। স্বপ্ন পূরণে কয়েক মাস আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলো। দুঃভাগ্য সেখানে তার চান্স হয়নি। যবিপ্রবিতে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়। সেই রেজাল্টে উত্তীর্ণ হয়েছে সে। আশাকরি তার স্বপ্ন পূরণে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার চান্স হবে।

যবিপ্রবিতে চান্স হলে সেটা তামান্না আর আমার পরিবারের জন্য ভালো। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ল্যাব ও বিভিন্ন ব্যবহারিকের জন্য বিভিন্ন ভবনে যাওয়া আসা করা লাগতে পারে তার। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে লিফট নাই। যবিপ্রবিতে আছে। সেটা তামান্নার পড়াশুনার ক্ষেতে অনেক ভূমিকা রাখবে।

তিনি বলেন, তাছাড়া ‘আমি একটি ননএমপিওভুক্ত দাখিল মাদরাসার শিক্ষক। টিউশনি করে সংসার চালাই। তাই জেলার বাইরে পড়াশুনার খরচ বহন করাও সম্ভব হয়ে উঠবে না। তাছাড়া তামান্না যেখানেই পড়াশুনা করবে সেখানে তার সঙ্গে পরিবার থাকা
লাগবেই। কেননা তার চলাচল সহ সব কাজে একজনের সহযোগিতা ছাড়া সে সম্পন্ন করতে পারে না। তাই তার ইচ্ছা বাড়ির কাছে নিজ শহরে যবিপ্রবিতে পড়াশুনা করার। আমার চাকুরিটাও করা যাবে; আবার সে ভালোভাবে লেখাপড়াটাও করতে পারবে। তামান্নার জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন তিনি।

যবিপ্রবির সহকারী পরিচালক (গণসংযোগ) আব্দুর রশিদ অর্ণব বলেন, ‘তামান্নার প্রতিবন্ধি কোটায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ ছিলো। কিন্তু সেই সুযোগ নেয়নি। নিজের মেধার জোরে সে পড়াশোনা করতে চায়। তার এই অদম্য ছুটেচলা অবশ্যই প্রশংসিত। তার জন্য শুভকামনা রইল।

২০০৩ সালের ১২ ডিসেম্বর তামান্নার জন্ম। তামান্নার বাবা রওশন আলী ঝিকরগাছা উপজেলার দাউলিয়া মহিলা দাখিল মাদ্রাসার (ননএমপিও) শিক্ষক। মা খাদিজা পারভীন গৃহিণী।

তিন ভাইবোনের মধ্যে তামান্না সবার বড়। ছোট বোন মুমতাহিনা রশ্মি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ভাই মুহিবুল্লা তাজ প্রথম শ্রেণিতে। ছয় বছর বয়সে তামান্নাকে পায়ে কাঠি দিয়ে লেখানোর চেষ্টা করে তার পরিবার। সেখান থেকে তার ইচ্ছা শক্তির উপর ভর করে বাঁকড়া আজমাইন এডাস স্কুলে ভর্তি হয়। সেখানে মাত্র দুই মাসের মাথায় ও পা দিয়ে লিখতে শুরু করে।

এরপর ছবি আঁকা শুরু করে তামান্না। তার আঁকা অনেক ছবি ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠিয়েছেন তামান্না। গেল বছরে এইচ এসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার পরে গত ২৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করাসহ দুটি স্বপ্নের কথা জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন তামান্না।

সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ ফেব্রুয়ারি সোমবার বিকাল ও সন্ধ্যায় পৃথক দুটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে অডিওকলে ফোন দিয়ে তামান্নাকে অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা। একইসঙ্গে দুই বোন তামান্নার স্বপ্ন পূরণে যেকোনো সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তামান্নাকে তার স্বপ্ন পূরণে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টে আবেদন করার পরামর্শ দেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তামান্নাকে ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়।

সেখানে বার্ন ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেনের তত্বাবধানে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন শেষে উন্নত চিকিৎসার জন্য পরবর্তীতে দেশের বাইরে নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল টিমটি।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here