সাইদুর রহমান :: টাঙ্গাইলের মানুষ প্রথম মাইক দেখে ১৯৪৯ সালের উপ নির্বাচনে৷ সে নির্বাচনে করটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নী ছিলেন মুসলিম লীগের প্রার্থী৷ একজন নিপাট প্রজাপ্রিয় ভদ্রলোক। প্রজা নিপীড়ন বা নির্যাতনের কোনো অভিযোগ ছিল না তাঁর নামে। আবার আচরণে নিখুঁত বিনয়ী। নির্বাচনী জনসভায় বক্তৃতা করার জন্য তিনি মাইক নিয়ে এসেছিলেন৷ জমিদারের নির্বাচন কিংবা প্রথম মাইক দেখার জন্য করটিয়া সাদাত কলেজের মাঠে সেই সভায় হাজার হাজার মানুষের ভিড় করেছিলো৷
জমিদার সাহেবের বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর তাঁর প্রতিদ্বন্ধী ধীরে ধীরে গেলেন মঞ্চের ওপর। জমিদারকে বললেন, হুজুর এই নির্বাচনে আমিও একজন প্রার্থী। কিন্তু আমার তো আপনার মতো টাকা নেই। আপনার মতো মাইক পাব কোথায়? যদি আমাকে অনুমতি দেন তাহলে এই মাইকে আমি আমার নিজের দুটি কথা বলতে পারি। জমিদার বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। কেন নয়?
জমিদারের প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থী মাইক নিয়ে প্রথমেই ভূয়সী প্রশংসা করলেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী খুররম খান পন্নীর। কৃতজ্ঞতা জানালেন প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মতো একজন সাধারণ মানুষকে জমিদার সাহেব মাইক ব্যবহার করতে দিয়েছেন সেজন্য। তারপর মূল কথায় এলেন। তিনি বললেন, জমিদার খুররম খান পন্নীর বিরুদ্ধে আমি প্রার্থী নই। তাঁর মতো ভালো মানুষের বিরুদ্ধে আমার কোনো বক্তব্য নেই। আমার লড়াই মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে। আমি মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছি। তাঁর সেই বক্তৃতার কোনো ডকুমেন্ট আজ কারও কাছে নেই কিন্তু অসাধারণ বক্তৃতা করেছিলেন তিনি। খুররম খান পন্নীর জনসভায় আসা মানুষও তাঁর বক্তৃতা শুনে জেগে উঠেছিলেন৷ বিশাল ভোটের ব্যবধানে খুররম খান পন্নী পরাজিত হন।
এই বিজয় মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার জনগণের প্রথম রায়। জমিদার খুররম খান পন্নীর তুলনায় তাঁর প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থী কোন বিবেচনায় যোগ্য ছিলেন না৷ কিন্তু তিনি জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। লেখাপড়া জানতেন। ইংরেজি বাংলা উভয় ভাষায় লিখতে এবং বলতে পারদর্শী ছিলেন। খুব ভালো বক্তৃতাও করতে পারতেন। সে বক্তৃতা দিয়েই তিনি জমিদারের নির্বাচনী জনসভায় জমিদারের মাইক ব্যবহার করে জমিদারের সমর্থকদের মন জয় করে বিজয়ী হয়েছিলেন৷ জমিদারের প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থীর নাম ছিলো শামসুল হক৷
আমাদের আজকের আলোচনা শামসুল হক সাহেবের দাম্পত্য জীবন নিয়ে৷ তাঁর দাম্পত্য জীবন নিয়ে আলোচনা করার পূর্বে তাঁর রাজনৈতিক জীবন নিয়ে আমাদের আরেকটু আলোচনা করা প্রয়োজন, না হয় অনেকেই হয়ত বুঝতে পারবেন না শামসুল হক সাহেব কে?
টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনের বিজয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠায় বিশাল, উর্বর একটি জমি তৈরি হয়েছিল৷ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালীরা তাদের ন্যায্য দাবী আদায়ের জন্য একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার তাগিদ অনুভব করেন৷ সে লক্ষ্যে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বিকেল তিনটায় ঢাকার কে এম দাস লেনের ‘রোজ গার্ডেনে’ এক সম্মেলন শুরু হয়। উপস্থিত ২৫০ থেকে ৩০০ জন। আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে শুরু হলো সম্মেলন। তাঁরা আলাপ-আলোচনা করে তৈরি করলেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’(বর্তমান আওয়ামীলীগ)৷
মাওলানা ভাসানীকে সভাপতি, শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক, শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মোশতাককে যুগ্ম সম্পাদক এবং ইয়ার মোহাম্মদ খানকে কোষাধ্যক্ষ করে নতুন দলের ৪০ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটি তৈরি করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন সরকার মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, আবুল হাশিম, মনোরঞ্জন ধর, শামসুল হক সহ কয়েকজনকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে৷ তাঁর অবর্তমানে শেখ মুজিব ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন৷ ১৯৫৩ সালে অত্যন্ত অসুস্থ শরীর নিয়ে শামসুল হক কারামুক্তি লাভ করেন। তাঁর শারিরিক অসুস্থতায় রাজনৈতিক কূটচালে তাকে দল থেকে বহিষ্কাকার করা হয়। শেখ মুজিবকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়৷ যুগ্ম সম্পাদক পদটি বিলুপ্ত হয়।
মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির তার ‘স্বাধিকার আন্দোলন এবং শামসুল হক’ নামক গ্রন্থে বলেন, ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসে মুকুল সিনেমা হলে (ঢাকা) আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। নিমন্ত্রণপত্র না পাওয়া সত্ত্বেও শামসুল হক অসুস্থ শরীর নিয়ে অধিবেশন কক্ষে এসে সরাসরি মঞ্চে চলে আসেন। মঞ্চে তখন মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন নেতা উপবিষ্ট ছিলেন। শামসুল হক মঞ্চে এসে দাঁড়িয়ে রইলেন। কারণ তার বসার জন্য কোনো আসন ছিল না। উপবিষ্ট নেতারা তাঁর প্রতি কোনো মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলেন না। এ অবস্থায় একদল কর্মী শামসুল হককে বসার জন্য একটা চেয়ার এনে দেয়। শামসুল হক বসতে যাচ্ছেন কিন্তু তখনই জনৈক নেতার নির্দেশে অপর কর্মী এসে চেয়ারখানি টান মেরে সরিয়ে নেয়। শামসুল হক তখন খুব ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে সবাইকে দেখলেন, কোনো কথা বললেন না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরবে প্রস্থান করলেন।
এই যে আমাদের দেশে মেধাবীদের মাঝে ‘আই হেইট পলিটিক্স’ প্রজন্ম তৈরি হয়েছে, তা কিন্তু একদিনে হয়নি৷ রাজনীতি থেকে এভাবেই মেধাবীদের অবহেলা, অবমূল্যায়ন, অপসারণ করে সেখানে পেশীশক্তিধারী, চালবাজ, প্রতারকদের পূনর্বাসন করা হয়েছে৷ পাকিস্তানী হায়েনা সরকারের নির্যাতন, দলীয় সতীর্থদের মীরজাফরগিরি সবকিছু হার মেনেছে শামসুল হকের স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতার কাছে৷
শামসুল হকের স্ত্রীভাগ্যে শনি লেগেছিল। সেই সময়কার ইডেন গার্লস কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপিকা আফিয়া খাতুনকে বিয়ে করেন শামসুল হক। আফিয়া খাতুন একজন উচ্চাভিলাষী মহিলা ছিলেন। শামসুল হক আরও অনেক বড় হবেন। মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীও হয়ে যেতে পারেন হয়তো এই আশায় তিনি শামসুল হককে বিয়ে করেন। কিন্তু শামসুল হক জেলে যাওয়ার পরে তিনি তাকে ছেড়ে চলে যান আমেরিকা এবং সেখানে এক পাকিস্তানীকে বিয়ে করেন৷ শামসুল হকের দুটি কন্যাসন্তান আছে বড় মেয়ের নাম উম্মেবতুল ফাতেমাজ জহুরা (শাহীন) এবং ছোট মেয়ের নাম উম্মেবতুল তাহেরা (সোয়েফা)। তাদেরকেও সাথে করে নিয়ে যান৷
ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী সরকারের অত্যাচার, দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রতারণা, স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতা এতসব নির্যাতনে এক সময় শামসুল হকের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে৷ ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত মানসিক ভারসাম্যহীন শামসুল হককে পথে পথে ঘুরতে দেখেছেন অনেকেই। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে প্রায় ১০ বছর পথে পথে ঘুরে বেরিয়েছেন৷ ১৯৬৫ সালে শামসুল হক হঠাৎ নিখোঁজ হন। ১৯৬৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে জোকারচর গ্রামের মহিউদ্দিন আনসারী (তৎকালীন নামকরা কংগ্রেস নেতা) কলকাতা থেকে সিরাজগঞ্জ হয়ে বাড়ি ফেরার পথে কোনো এক স্থান থেকে শামসুল হককে বাড়িতে নিয়ে আসেন। তখন শামসুল হক শারীরিক ও মানসিকভাবে ভীষণ অসুস্থ ছিলেন। প্রচণ্ড জ্বরে শামসুল হক ১১ সেপ্টেম্বর (শনিবার) দুপুর ২টা থেকে আড়াইটার মধ্যে মারা যান। শামসুল হককে টাংগাইল জেলার কালিহাতি উপজেলার কদিম হামজানি গ্রামের কবরস্থানে কবর দেওয়া হয়।
মানুষের জীবন বড়ই বিচিত্র৷ যিনি হতে পারতেন ইতিহাসের মহানায়ক, তিনি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছেন ইতিহাস থেকে৷ কিন্তু সন্তানের হৃদয় থেকে পিতা কখনো হারায় না৷ শামসুল হকের মেয়েরা দুজনেই পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত এবং বিবাহিতা। সপরিবারে আমেরিকা বসবাস করেন। তারা জানত না যে শামসুল হক তাদের পিতা৷ তাদের বলা হতো তোমাদের পিতা একজন বদ্ধ উন্মাদ, তার কাছে গেলে সে তোমাদের মেরে ফেলতে পারে। কিছুদিন পূর্বে তারা টাঙ্গাইল এসেছিলেন কিন্তু জীবীত বাবাকে তো পেলেন না, পেলেন বাবার কবরকে!
রক্তের সাথে রক্তের বন্ধন স্বার্থের অনেক উর্ধ্বে, আর নাড়ীর সাথে বন্ধন সে তো ভূমিষ্ঠ হওয়ারও আগে৷ এসব বন্ধন ছিন্ন করে কেউ কি সন্তানদের কাছে আদর্শ হতে পারে? বিত্ত, বৈভব, সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যে সারা জীবন সন্তানদের বুকে আগলে রেখে সুস্থ মস্তিষ্কের আফিয়া খাতুন কি পেরেছেন একজন আদর্শ মা হতে??? তা হয়ত তিনি এবং তার মেয়েরাই বলতে পারবেন৷ আর বলতে পারবেন যারা দাম্পত্য জীবন এই দম্পতির মত অতিবাহিত করছেন বা করেছেন ৷
চলবে………
লেখকঃ কলামিষ্ট