ভলতেয়ারসাইদুর রহমান  ::

“আরো আগে কেন তুমি এলে না!
তুমি হীনা জীবন সে তো জীবন ছিলো না৷”

অষ্টাদশ শতকের প্রভাবশালী ফরাসি সাহিত্যিক, দার্শনিক ভলতেয়ার যাকে দেখে এমন মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন সে ভদ্রমহিলা গ্যাব্রিয়েল এমিলি মার্কোয়েস শাতলেজ (কেউ কেউ এমিলি দু শেতেলেত, শাৎলেতও বলেন)ছিলেন তিন সন্তানের জননী৷ ইতিহাসখ্যাত নারীদের সবার মধ্যে একটা সাধারণ ব্যাপার ছিল তারা প্রত্যেকেই অপূর্ব রূপবতী ও আবেদনময়ী৷

উচ্চতায় এমিলি ছিল অন্যান্য মেয়েদের থেকে একটু বেশি লম্বা, পাঁচ ফুট ন ইঞ্চি। কালো কোঁকড়ানো চুল । তিন সন্তান জন্মদানের পরেও, সারা শরীরে লাবণ্য ঝরে পড়ছে যেন! তার দু চোখে ফুটে ওঠা জ্ঞান আর বুদ্ধির দীপ্তি৷ তার সৌন্দর্যে হারিয়ে যান ভলতেয়ার৷ ছয় ভাই-বোনের মধ্যে এমিলি সবার ছোটো৷ ছোটবেলা থেকেই দারুণ বুদ্ধিমতী এমিলি অন্য আট-দশজনের চেয়ে আলাদা ছিলেন৷

সুন্দরী হলেও সাহস আর চাঞ্চল্যের কারণে মেয়েলি বিষয়ের চেয়ে পুরুষালি বিষয়ই তাকে কাছে টানত বেশি। অস্ত্র চালনা ও ঘোড়দৌড়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তিনি। লেখাপড়ায় দুর্দান্ত এমিলি সমবয়সীদের ছাড়িয়ে যান। অন্যদিকে নাচের প্রতি বিশেষ অনুরাগ ছিল তার। বাদ্যসংগীতেও দক্ষতা ছিল এমিলির। তিনি হাপসিকর্ড বাজাতেন, অপেরা গাইতেন, অভিনেত্রী হিসেবে মঞ্চনাটকও করতেন। এমন মেধাবী ও বহুগুণে গুণান্বিত এমিলির বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়সে৷

এমিলির স্বামী মারকি ছিলেন একজন সেনা কর্মকর্তা। এ্যারেঞ্জ ম্যারেজের কারণে আগে থেকে কেউ কাউকে চিনতেন না। ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা, মেজাজ-মর্জি কোনো কিছুতেই কোনো মিল ছিল না। বিয়ের পর এমিলি একে একে তিন সন্তানের মা হলেও সংসারে কোন সুখ ছিলো না৷ সুখের খোঁজে ২৪ বছর বয়সে তিনি দুক দরিশেলিউ সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যান৷ এ সম্পর্কটাও এমিলিকে সুখ দিতে পারলো না৷ দেড় বছর চলার পর সে সম্পর্কে ছেদ পড়ে৷

এক পর্যায়ে আইজাক নিউটনের গবেষণার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন এমিলি। তখন তাকে উচ্চতর গণিতের চর্চায় উদ্বুদ্ধ করেন রিশেলিউ। লোরেঁ-এর সাইরি-তে চমৎকার এক পল্লী নিবাস ছিল এমিলির। সেখানে এসে থাকার জন্য তিনি আমন্ত্রণ জানান ভলতেয়ারকে৷ ভলতেয়ার খুঁজে পেলেন তাঁর মনন সঙ্গীকে৷ এমিলি খুঁজে পেলেন এমন একজন পুরুষকে , যে শুধু শরীর নয় , তাঁর জ্ঞান, বুদ্ধি আর মনীষাকেও শ্রদ্ধা করে৷ আবেগ , ভালোবাসা আর পারস্পরিক শ্রদ্ধায় এভাবেই দুজনে কাছে এলেন দুজনের৷ নিবিড় ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে গেলেন তাঁরা।

এক বুকে যে তৃপ্ত নয়, অনেকের বুকে সে কি করে তৃপ্তি পাবে! এ্যারেঞ্জ ম্যারেজে সে সুখ পায়নি, লাভ ম্যারেজটাও তাকে সুখী করতে পারেনি৷ পনের বছর এক সাথে দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করার পর চল্লিশ উত্তীর্ণ বয়সে এমিলি সম্পর্কে জড়ান সাৎ লাম্বারের (মারকি দ সাত লামবার্তের, শাৎ ল্যাম্বার্ট) সঙ্গে৷ সাৎ লাম্বারকে ভালোবেসে এমিলি ভলতেয়ারকে ছেড়ে যান৷

যে নারীর সৌন্দর্যে ভলতেয়ার মুগ্ধ হয়েছিলো, সে নারীর কারনে ভলতেয়ারের মত দার্শনিকও সমগ্র নারীদের উপর দোষ চাপিয়ে বলেন, “নারীরা এমনই, একজনকে পেলে অন্যজনকে ছুঁড়ে ফেলে৷” বন্ধু সাৎ লাম্বারকে উদ্দেশ্য করে ভলতেয়ার বলেন,

“বাগানের যত ফুল তোমারি হোক, সাৎ লাম্বার৷
গোলাপের যত কাটা আমারি থাক, গোলাপ তোমার৷”

লাম্বারের সাথে অবৈধ সম্পর্কে ফলে এমিলি গর্ভধারণ করে ফেলেছিলেন৷ সে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে এমিলি মারা যান৷ তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ৪২ বছর৷

এমিলি গবেষণা করেছেন পর্দাথবিদ্যা ও গণিত নিয়ে, আর প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও অনুবাদ। নিউটনের প্রিনসিপিয়া ম্যাথমেটিকার যে অনুবাদ তিনি করেছেন ফরাসি দেশে এখনো তা শ্রেষ্ঠ হিসেবে স্বীকৃত। এমিলির নানা আবিষ্কারের মধ্যে যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে স্বীকৃত তা হলো : The kinetic energy of an object is a function of the square of its velocity. তবে সেসবকে চাপিয়ে ভোগ-বিলাসে উন্মত্ত আর রাজকীয় অভিজাত সমাজে কামনা-বাসনার এক মোহিনী প্রতিমূর্তি হিসেবে তিনি স্মরণীয় সবার কাছে৷

চলবে………

লেখকঃকলামিষ্ট

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here