বিক্ষোভে উত্তাল মালয়েশিয়াডেস্ক নিউজ :: উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উন্নয়নের রোল মডেল মালয়েশিয়ার রাজনীতি। দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে শনিবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের পদত্যাগের দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে রাজধানী কুয়ালালামপুরসহ দেশটির বিভিন্ন স্থানে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত শনিবার শুরু হওয়া দুই দিনব্যাপী ওই বিক্ষোভ চলছিল। এদিকে, বিক্ষোভ মোকাবেলায় নিরাপত্তা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য মোতায়েন করেছে দেশটির সরকার। সেনা নামানোর সম্ভাবনার কথাও জানিয়েছে অনেকগুলো সূত্র। আজ রোববার বিক্ষোভ দ্বিতীয় দিনে গড়ানোর কথা রয়েছে।

এদিকে, মালয়েশিয়াভিত্তিক অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘মালয়েশিয়াকিনি’ জানিয়েছে, বিক্ষোভকারীদের প্রতি সরাসরি কোনো সমর্থন ব্যক্ত না করলেও শনিবার সস্ত্রীক বিক্ষোভস্থল পরিদর্শনে গেছেন আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার হিসেবে খ্যাত মাহাথির মোহাম্মদ। সংবাদসূত্র : বিবিসি, মালয়েশিয়া ইনসাইডার, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল
পুলিশ সূত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, শনিবার রাজধানী কুয়ালালামপুরে অন্তত ১০ হাজার বিক্ষোভকারীর সমাবেশ ঘটে। তাদের পরনে ছিল হলুদ টি-শার্ট, হাতে ছিল দেখতে ভুভুজেলার মতো এক ধরনের বাঁশি। কারো কারো কাঁধে সাদা ব্যাগ। তাতে নীল কালিতে লেখা_ ‘আমার প্রধানমন্ত্রী আমাকে লজ্জিত করেছেন।’ বিবিসি জানিয়েছে, শনিবার বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ৫০ হাজার থেকে ৮০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। কুয়ালালামপুর ছাড়াও বিক্ষোভের ডাক দেয়া হয়েছে বোর্নিও দ্বীপের মালয়েশীয় অংশ কোতা কিনাবালু এবং কুচিংয়ে। বিক্ষোভকারীদের নেত্রী মারিয়া চিন বলেন, ‘সরকার নয়, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদদের পতন ঘটানোই আমাদের লক্ষ্য।’

বারসিহ নামে গণতন্ত্রপন্থী একটি সংগঠন এই বিক্ষোভ-সমাবেশের আয়োজন করেছে। তারা শনি ও রোববার দুই দিনই বিক্ষোভ করতে চায়। কিন্তু এই দুই দিনে বিক্ষোভ সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে সরকার। বিক্ষোভ আয়োজনের অনুমতি চেয়ে যে আবেদন করা হয়, তা প্রত্যাখ্যান করেছে কুয়ালালামপুর কর্তৃপক্ষ। এখন সরকারি আদেশ উপেক্ষা করে বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নামায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বড় ধরনের সংঘর্ষ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ নিয়ে কুয়ালালামপুরে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এর আগে ২০১২ সালে একই ধরনের একটি বিক্ষোভ সমাবেশে পুলিশ জলকামান ও টিয়ারগ্যাস ব্যবহার করে। আর এবার প্রধানমন্ত্রীর ‘সম্মান রক্ষার লড়াইয়ে’ সেনাবাহিনী নামানোর আভাস পর্যন্ত দিচ্ছেন প্রশাসকরা। এছাড়া বিক্ষোভ দমনে গত শুক্রবার কয়েকটি ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। বিক্ষোভের তথ্য যাতে ছড়িয়ে না পড়ে এবং কেউ যাতে বিশৃঙ্খলা উস্কে দিতে না পারে, সেজন্য এই কাজ করেছে মালয়েশীয় কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া কমিশন। তবে সম্প্রতি নাজিব রাজাক বলেছেন, তিনি বিক্ষোভ উস্কে দেয়ার মতো কোনো কাজ করতে চান না। ভুল বোঝাবুঝি থাকলে আলোচনার মাধ্যমে তা সমাধানের কথা বলেন তিনি।
এদিকে, বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে কথা বলছেন আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার মাহাথির মোহাম্মদও। নিশ্চিত করে কোনো মত না দিলেও মাহাথির সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন, এই অর্থ অনুদান হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এমন বিতর্কিত অর্থ সংক্রান্ত কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ায় তিনিও নাজিব রাজাককে পদত্যাগের পরামর্শ দিয়েছেন। এটি হতে পারে বিক্ষোভকারীদের জন্য খুব বড় ধরনের প্রেরণার উৎস।
যে কারণে বিক্ষোভ নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে ৭০ কোটি আমেরিকান ডলার আত্মসাতের অভিযোগ থেকেই শুরু হয়েছে এই বিক্ষোভ। বলা হচ্ছে, ‘১ মালয়েশিয়া ডেভেলপমেন্ট বারহাদ’ (১এমডিবি) প্রকল্প থেকে ওই পরিমাণ অর্থ বাগিয়েছেন তিনি। নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে বিপুল অঙ্কের অর্থ জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছিল আরো আগেই। ‘প্রমাণগুলো’ নিয়েও নাড়াচাড়া হয়েছে ব্যাপক, তদন্তকাজ চলেছে গত কয়েক মাস ধরে। তেমনি একটি তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, সমাজসেবা সংক্রান্ত খাতের ৭০ কোটি ডলার মধ্যপ্রাচ্যের অজ্ঞাত বিদেশি দাতার দান হিসেবে তিনি নিজ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করেছেন। সেখান থেকেই বিক্ষোভের সূত্রপাত। মূলত মালয়েশিয়াকে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে কুয়ালালামপুরকে শিল্প-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে নাজিব রাজাকের তত্ত্বাবধানে ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘১এমডিবি প্রকল্প’। দেশি-বিদেশি দাতারা প্রকল্পের তহবিলে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেয়। কিন্তু ২০১৪ সালে এসে দেখা যায়, ১এমডিবি বাবদ সরকার ১১ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে, যা পরিশোধ করতে পারছে না। আরো দেখা যায়, বিভিন্ন খাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পরিমাণ অর্থ খরচ করা হয়েছে এই তহবিল থেকে। রাজাক বেশ কয়েকবারই এসব দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। মালয়েশিয়ার মন্ত্রিসভা থেকে বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের এসব বেনামি দাতা দলীয় তহবিলে অর্থ দিয়েছেন; ১এমডিবির তহবিলে নয়। সেই হিসাবে প্রধানমন্ত্রী রাজাক কোনো জালিয়াতি করেননি।
বিবিসি জানিয়েছে, শুধু আর্থিক কেলেঙ্কারিই নয়, আরো বেশ কিছু ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরেই জনপ্রিয়তা হারাচ্ছেন রাজাক। ঔপনিবেশিক আমলের দমনমূলক একটি আইন নতুন করে জারি করা, দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধিতা উপেক্ষা করে খাদ্য ও জ্বালানির ওপর ভতুর্কি হ্রাস এবং অন্যান্য কর আরোপকে কেন্দ্র করেও নাজুক অবস্থায় আছেন নাজিব রাজাক। এছাড়া বিলাসী জীবনযাপনের কারণে অনেক আগে থেকেই সমালোচিত হয়ে আসছিলেন তার স্ত্রী রোসমাহ মানসুর। মালয়েশিয়ার খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অভিযোগ, নাজিব মধ্যপন্থা এড়িয়ে দেশকে ইসলামীকরণের পথে পা বাড়িয়েছেন।
কতটা শক্ত এই বিক্ষোভের ভিত?
মালয়েশিয়াজুড়ে ব্যাপক সাড়া ফেললেও পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই বিক্ষোভে সরকার পতনের তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। সামগ্রিক জনজীবনেও তা খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারবে না। কারণ শক্তিশালী বিরোধিতার জন্য প্রয়োজনীয় নেতৃত্বের অভাব রয়েছে। মালয়েশিয়ার ডেমোক্রেটিক অ্যান্ড ইকোনমিক বিষয়ক ইন্সটিটিউটের প্রধান নির্বাহী ওয়ান সাইফুল ওয়ান জান বলেন, ‘এই সমাবেশ থেকে বড় ধরনের বিক্ষোভ দেখানো সম্ভব হবে। কিন্তু এতে কোনো পরিবর্তন হবে বলে আমি মনে করি না।’ –
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here