শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাক জাতীয় পণ্য বিক্রি বন্ধ করা উচিৎ

মো. ইসহাক ফারুকী: রিফাত (ছদ্মনাম), বয়স ১০ বছর। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার পথে বিভিন্ন ঘটনা দেখতে দেখতে যায়। অজানাকে জানতে, অচেনাকে চিনতে তার খুব ভাল লাগে। স্কুলের গণ্ডি পেরুলেই চকলেট, চিপসের দোকান। সেখান থেকে চকলেট বা চিপস কেনার আগ্রহ তার অনেক। তার মতো আট-দশটা শিশুও সেই দোকানে চকলেট-চিপসের লোভে যায়। দোকানে আরও হরেক রকমের মনোহারি জিনিসে ভর্তি। চকলেট, চিপস, আইসক্রিম, ললিপপ, বিস্কিট আরও কতো কি? পাশাপাশি একটি অদ্ভুত জিনিসও রয়েছে। বন্ধু-বড় ভাইরা বলে, এটা সিগারেট। তার চোখের সামনে চকলেট, বিস্কিট যেখানটায় রয়েছে, সেখানে বিভিন্ন নামের সিগারেটের প্যাকেটও আছে। পাশে টাঙ্গানো আছে প্রতিটি শলাকার দাম।রিফাতের লোভ জাগে, কি এমন জিনিস এটা? এটা টানলে ধোঁয়া বের হয়; আবার শিশুদের নাকি খেতে হয় না। যেখানেই না, সেখানেই আকর্ষণ। এটা তো খেয়ে দেখা লাগে। আদিল, বিল্লাল, সাজুরা (ছদ্মনাম) নাকি লুকিয়ে লুকিয়ে খায়। ওদের বয়স ১২ বছর। সিগারেট নামক এই জিনিস তার চোখের সামনে, হাতের নাগালে আছে। কেন খেয়ে দেখবে না? আর এটা খেলে আদিলদের সাথে তার ওঠাবসা হবে। বড় বড় ভাব আসবে। খেয়ে দেখবে নাকি? রিফাত একদিন চারপাশে তাকিয়ে দেখে পরিচিত কেউ আছে নাকি? কিনতে যাবে? ওইতো বিল্লালকে দেখা যাচ্ছে। ও কিনছে। বিল্লাল তো ওর চেয়ে মাত্র দু’বছরের বড়। ও কিনতে পারলে রিফাতও পারবে। নিজেকে অভয় দিল। দোকানে সাজানো প্যাকেট দেখে দুরু দুরু বুকে অর্ডার দিয়েই ফেললো।

তার কয়েকদিন পরের কথা। রিফাত টিফিনের টাকা জমিয়ে আদিলদের সাথে বসে সিগারেট খায়। সে খুশি নিষিদ্ধ এই জিনিসটি খেতে পেরে, আদিলরা খুশি ধুমপানের সঙ্গী পেয়ে, দোকানদার খুশি বিক্রি করতে পেরে, সিগারেট বিক্রেতা কোম্পানী খুশি আগামী অনেক বছরের জন্য নিয়মিত একজন গ্রাহক পেয়ে।

কিন্তু এই চিত্র কি আমাদের কাম্য? আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ কি এমনই হবে? এদিকে বিদ্যমান আইনে বিজ্ঞাপন প্রচার নিষিদ্ধ হলেও ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে টোব্যাকো কোম্পানীগুলো বিজ্ঞাপন প্রচার করছে।

রাজধানীর বাসাবো, মগবাজার, মালিবাগ, পল্টন, মতিঝিল, কারওয়ানবাজার, নিউমার্কেট, ধানমন্ডি, মিরপুরের  ৫০টি বিক্রয়স্থলের বিক্রেতা ও ক্রেতার সাথে আলোচনা করে এবং বিক্রয়স্থল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অন্যান্য ক্রেতার পাশাপাশি ৮-১৮ বছর বয়সী শিশুদের বেশ আনাগোনা রয়েছে। কেউ সিগারেট কিনে লুকিয়ে অন্য জায়গায় চলে যায়, কেউ দোকানে বসে ধূমপান করে, কেউ দোকানের বাইরে ধূমপান করে। কোন কোন শিশু রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চকলেট, চিপসসহ অন্যান্য জিনিস কেনার সময় সিগারেটের প্যাকেটের দিকে বা ধূমপায়ীর দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কিছু শিশুকে দেখা যায়, দলবদ্ধভাবে সিগারেট কিনছে এবং পান করছে। বিক্রেতারাও বিক্রি করছে লাভের আশায়। কেউ আবার ১২-১৮ বছর বয়সী শিশুদের দূর্ব্যবহারের কারণে সিগারেট বিক্রি করছে।

২০১৭ সালে ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস- এর কারিগরি সহযোগিতায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০০ গজের মধ্যে ঢাকা আহছানিয়া মিশন ‘বিগ টোব্যাকো টাইনি টার্গেট ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি গবেষণা চালিয়েছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ৯০.৫ শতাংশ স্কুল ও খেলার মাঠগুলোর ১০০ মিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে তামাকজাত পণ্য বিক্রি করতে দেখা গেছে। শিশুদের চোখের স্তরে (প্রায় ১ মিটার) তামাকজাত পণ্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ক্যান্ডি, মিষ্টি বা খেলনাগুলোর পাশে ৬৪.১৯ শতাংশ তামাকজাত পণ্য প্রদর্শিত হচ্ছে। নির্বাচিত স্কুল এবং খেলার মাঠের আশেপাশে ৮২.১৭ শতাংশ তামাকজাত পণ্য প্রদর্শিত হচ্ছে। ৬৭.৩৯ শতাংশ স্টিকার / ডেমো-প্যাকেট / ফেস্টুন / ফ্লাইয়ার বিজ্ঞাপন এবং ২৯.৬০ শতাংশ পোস্টার বিজ্ঞাপন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল ইয়োথ টোব্যাকো সার্ভে ২০১৩ সমীক্ষায় দেখা গেছে, অপ্রাপ্তবয়স্কদের (১৩-১৫ বছর) মধ্যে ৬.৯ শতাংশ ছেলে-মেয়ে কোনো না কোনো ধরনের তামাক ব্যবহার করে (ছেলে ৯.২%, মেয়ে ২.৮%)। ৪.৫ শতাংশ ছেলে-মেয়ে ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করে (ছেলে ৫.৯%, মেয়ে ২%)। ৫২.৩ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রীরা পয়েন্ট অব সেলে তামাকজাত পণ্যের প্রদর্শণ/প্রচারণায় আকৃষ্ট হয়। ৬.৩ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রীদের ফ্রি নমুনা সিগারেট দেওয়া হয়। ৯ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রীদের ব্র্যান্ডের লোগো সম্বলিত প্রচারণা পণ্য উপহার হিসেবে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ ২০০৪ সালের ১৪জুন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল- এফসিটিসি‘তে অনুসমর্থন করেছে। যেখানে বলা হয়েছে আইনপ্রণেতাদের এবং তামাক শিল্পের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া সীমাবদ্ধতার আহ্বান জানানো, কর ও তামাকের চাহিদা হ্রাস করার অন্যান্য ব্যবস্থা, গৃহমধ্যস্থ কর্মস্থল, গণপরিবহন এবং জনসাধারণের জায়গায় তামাকের ধোঁয়ায় আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে সমস্ত লোককে রক্ষা করার বাধ্যবাধকতা, তামাকজাত সামগ্রীর বিষয়বস্তু এবং নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং উপাদানগুলো প্রকাশ করতে হবে, বৃহৎ স্বাস্থ্য সতর্কতা (কমপক্ষে৩০ শতাংশ প্যাকেট কভার, ৫০ শতাংশ বা আরও বেশি প্রস্তাবিত), সরল প্যাকেজিংয়ের পরামর্শ দেওয়া হয়; প্রতারণা সম্বলিত লেবেল (“হালকা”, “খুব হালকা” ইত্যাদি) নিষিদ্ধ, ধূমপানের পরিণতি সম্পর্কে জনসচেতনতা, জাতীয় সংবিধান নিষিদ্ধ না করা হলে ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা, আসক্তি এবং অবসান কর্মসূচি, তামাকজাত পণ্যের অবৈধ বাণিজ্য নিরসনে পদক্ষেপ নেওয়া, নাবালকদের কাছে বিক্রয় নিষিদ্ধ, তামাক সম্পর্কিত গবেষণা এবং তথ্য ভাগ করে নেওয়া।

ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ এবং ২০১৩ (সংশোধিত) আইনের ৫ ধারার ছ- এ বলা আছে, তামাকজাতদ্রব্যেরবিক্রয়স্থলে (point of sales) যেকোন উপায়ে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করিবেন না বা করাইবেন না। ব্যাখ্যা- উপ-ধারা (১) এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, “তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার”অর্থ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো তামাকজাত দ্রব্য বা তামাকের ব্যবহার প্রবর্ধনের উদ্দেশ্যে যেকোন ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করা।

বিদ্যমান আইনে যে দুর্বলতা আছে, তাতে দেখা যায়-বিক্রয়কেন্দ্রে প্রোডাক্ট ডিসপ্লে বা পণ্য প্রদর্শনী নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে আইনে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। এই সীমাবদ্ধতাকে কাজে লাগিয়ে তামাক কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। ব্যাখ্যায় সংযোজন করা প্রয়োজন-‘তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্যের কোনরূপ প্রদর্শন ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম বলিয়া বিবেচিত হইবে।’

নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড, গ্রেট ব্রিটেন, আয়ারল্যান্ড, মরিশাশ, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, নেপালের মতো বিশ্বের ৪৩টি দেশের পয়েন্ট অব সেলে (বিক্রয়স্থল) তামাকজাত পণ্য প্রদর্শণ নিষিদ্ধ করেছে।

তামাক প্রাণঘাতী পণ্য। তামাক ব্যবহারকারীর প্রায় অর্ধেক মারা যায় তামাকের কারণে। ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস-এর ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, তামাকের কারণে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে প্রায় ১২৬,০০০ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে, যা দেশে মোট মৃত্যুর প্রায় ১৩.৫ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত। ৬১হাজারেরও বেশি শিশু (১৫ বছরের নিচে) পরোক্ষ ধূমপানের কারণে সৃষ্ট রোগে ভুগছে। কখনই তামাক ব্যবহার করেন নি তাদের তুলনায় তামাক ব্যবহারকারীদের তামাকজনিত রোগ যেমন হৃদরোগ, স্ট্রোক, সিওপিডি বা ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি ৫৭ শতাংশ বেশি এবং তামাকজনিত অন্যান্য ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি ১০৯ শতাংশ বেশি।

শিশুদের (১৫ বছরের নিচে) প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ তামাক গ্রহণের ফলে তাদের দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক ও মানসিক সমস্যা হতে পারে। এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

শিশু মনোবিজ্ঞানী, কাউন্সেলর, মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট এইডার, গবেষক ও লেখক ফারজানা ফাতেমা রুমী বলেন, একেকটা পযায়ে শিশুরা নতুন নতুন কিছু শিখতে শুরু করে, নতুন নতুন জিনিসের স্বাদ নেয়, নতুন কিছু আবিষ্কার করে। তারা তাদের পছন্দের চিপস, চকলেট কিনতে একটা দোকানে যায়, হোক সেটা বড় বা ছোট দোকান, এলাকার মুদি দোকান বা গ্রামের কোন দোকান; সেখানে দেখা যায় এগুলোর পাশাপাশিসিগারেটের প্যাকেট তাদের হাতের নাগালে সাজানো থাকে।

ওটা দেখে বিশেষ করে ছেলে শিশুরা মনে করে, একদিন আমি বড় হয়ে বাবা, চাচা, মামা, বড় ভাইয়ের মতো সিগারেট খাবো। এখান থেকেই সুযোগ পায় জানার ও টেস্ট করার। একবার-দুইবার টেস্ট করে, লুকিয়ে লুকিয়ে খায়। তাদের ধূমপায়ী বন্ধু মহল বা দলও তৈরি হয়ে যায়। তাদের মনে হতে থাকে-আমার বন্ধু খাচ্ছে, আমিও খাই।

এরকম করে করে শিশুরা ধূমপানের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। এর প্রভাব পড়ে শরীরে ও মনে। তাদের এটেনশন ডেফিশিট হাইপারএকটিভিটি ডিসঅর্ডার (এডিএইচডি) ডেভেলপ করার একটি সম্ভাবনা থাকে। এডিএইচডি-তে আক্রান্তহলেশিশুরাখুবইঅমনোযোগী, ক্ষিপ্ত, আক্রমণকারী ও অতিমাত্রায় চঞ্চল হয়ে ওঠে। তারা পড়াশোনা করতে চায়না এবং নিজের ইচ্ছামতো চলতে ভালবাসে। পাশাপাশি অপ্রাপ্ত বয়সে ধূমপানে আসক্ত হলে তাদের মধ্যে খারাপ আচরণ যেমন: চিৎকার-চেঁচামেচি, উত্তেজনা, রাগ, ক্রোধ, ভাঙচুর প্রভৃতি নিওরোলজিক্যাল কিছু ইফেক্ট তৈরি হয়। এটা আসলে কোন ভাবেই কাম্য নয়। তাই যেসব স্থানে শিশুদের আনাগোনা আছে- সেখানে ধূমপানে বিজ্ঞাপন, দোকানে সিগারেটের প্রচারণা, প্রলুব্ধকরণ, প্রদর্শণ বন্ধ করা অতীব জরুরী।

শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চাইল্ড এডলেসেন্ট এন্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ এসোসিয়েশন ফর চাইল্ড এন্ড এডলেসেন্ট মেন্টাল হেলথের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট (ইলেক্ট) ড. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধূমপানের ফলেশিশুদের মানসিক ও শারীরিক সমস্যা অনেক বেশি হয়। সরাসরি ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মস্তিষ্ক বাঁধাগ্রস্ত হয়। তাদের চিন্তার বিকাশ ঘটে না। ধূমপান মাদক গ্রহণের দিকে ঠেলে দেয়। এতে শিশুদের ফুসফুসের ক্যান্সার, মুখের ক্যান্সার, রক্তনালীর প্রদাহ হতে পারে। বিভিন্ন স্কুলের আশেপাশের দোকানে সিগারেট বিক্রি ও সিগারেটের প্যাকেট প্রদর্শন শিশুদের ধূমপানের প্রতি আগ্রহী করে তুলে, যা তাদের জন্য অনেক ক্ষতিকারক। এসব বন্ধ করা প্রয়োজন। শিশুদের যে স্থানে বেশি আনাগোনা হয়, সেখানে সিগারেট বিক্রি, সিগারেটের প্রচার, প্যাকেট প্রদর্শণ এবং প্রকাশ্যে ধূমপান বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়া প্রয়োজন। আইনের সংশোধন ও বাস্তবায়ন করা অতীব জরুরী।

এদিকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চাইল্ড এডলেসেন্ট এন্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক ড. নিয়াজ মোহাম্মদ খান বলেন, শিশুদের মস্তিস্ক বিকাশ ঠিকমতো না হওয়ার কারণে তাদের পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটে। ধূমপানের জন্য বাসা থেকে টাকা-পয়সা যোগাড় করতে পারে না। অর্থ যোগাড় করতে অনৈতিক কাজে জাড়য়ে পড়ে।

রেডিয়েশন অনকোলজি বিশেষজ্ঞ, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেডিয়েশন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান এবং আহছানিয়া মিশন ক্যান্সার এন্ড জেনারেল হাসপাতালের বর্তামান ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান চৌধুরীবলেন, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধূপানের ফলে ৯০ শতাংশ পুরুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। মহিলা ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। ফুসফুসের ক্যান্সার ছাড়াও মুখের ক্যান্সার, স্বরনালীর ক্যান্সার, খাদ্যনালীর ক্যান্সার, পাকস্থলীর ক্যান্সার হতে পারে। পাশাপাশি রক্তনালীর প্রদাহ, বুক ও হৃৎপিন্ডের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপসহ নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি হয়। ধূমপান বন্ধ করতে পারলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে। আমাদের দেশে রাস্তার মোড়ে মোড়ে যত চা-পান-সিগারেটের দোকান আছে, তত ফলমূলের দোকান নেই। তাই সিগারেট বিক্রি, বহুমুখী প্রচার বন্ধ করা প্রয়োজন।

কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ এন্ড জেনারেল হাসপাতালের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগে সাবেক বিভাগীয় প্রধান এবং বাংলাদেশ স্পাইন এন্ড অর্থোপেডিক হাসপাতালের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুসাররাত হক বলেন, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধূমপান জনস্বাস্থ্যের জন্য অনেক ঝুঁকির কারণ। শিশুরাও এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। ধূমপানে আসক্ত একজন শিশু বড় হতে হতে নিজের, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ফুসফুসের ক্যান্সারে বাংলাদেশে পুরুষদের মৃত্যুর হার সবেচেয়ে বেশি। অধূমপায়ী যক্ষা, হাপানি রোগীর চেয়ে ধূমপায়ী রোগীকে বাঁচানো অনেক বেশি কষ্টকর হয়ে পড়ে। তাই শিশু বয়স থেকেই তারা যেন ধূমপানের সংস্পর্শে না আসতে পারে-সেই বিষয়টির ওপর অনেক বেশি নজর দিতে হবে।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো.জোবায়দুররহমান বলেন, স্কুল-কলেজে ১৬ বছরের নিচে শিশুদের কাছে সিগারেট বিক্রি করছে কিনা, তা আমরা দেখি। তবে আমাদেরও সীমাবদ্ধতা আছে। সীমিত লোকবলের কারণে অনেক জায়গায় দেখা সম্ভব হয় না। কোভিড পরিস্থিতির কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকাতে শিশুদের কাছে সিগারেট বিক্রির হার কমেছে। তবে স্কুল-কলেজ খুললে পরিস্থিতি আবারও পূর্বের মতো হতে পারে। আইনের যদি সংশোধন হয়, তাহলে স্কুল-কলেজের আশেপাশে সিগারেট বিক্রি বন্ধ হবে। কারণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধূমপানের কারণে নিজের ও অন্যের ক্ষতি হচ্ছে। পারসিসটেন্ট অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (পিওপিডি), ফুসফুসের খ্যান্সার, রক্তনালীর প্রদাহসহ নানাবিধ শারিরিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। দেখা যায়, আমরা টোব্যাকো থেকে যে ট্যাক্স পাচ্ছি, তার চেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে স্বাস্থ্য সমস্যা প্রতিকারে। তাই কার ব্যবসায়িক ক্ষতি হলো, তা না দেখে সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ করা উচিৎ।

ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের স্বাস্থ্য ও ওয়াশ সেক্টরের পরিচালক ইকবাল মাসুদ বলেন, ৭৭ শতাংশ বিক্রয় কেন্দ্রে শিশুদের চোখের সমান্তরালে (১ মিটার) তামাক পণ্য প্রদর্শিত হচ্ছে। ৩৩শতাংশ বিক্রয় কেন্দ্রে চকলেট, মিষ্টি বা খেলনার পাশে তামাক পণ্য দেখা গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে সিগারেট বা কোনও তামাক জাতীয় পণ্য বিক্রি নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। এই লক্ষ্যে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনের সংশোধন করতে হবে। সংশোধন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আমরা আশা করি, অতি দ্রুত এই আইনের সংশোধন হবে।

ক্যাম্পেইন ফর টোবাকো ফ্রি কিডস বাংলাদেশের গ্র্যান্টস ম্যানেজার আবদুস সালাম মিয়া বলেন, পয়েন্ট অব সেলে (বিক্রয় কেন্দ্র) শিশুদের চোখের সমান্তরালে (১ মিটার) চকলেটে, চিপসসহ তাদের পছন্দের জিনিসের পাশাপাশি সিগারেট ও তামাকজাত পণ্য প্রদর্শিত হচ্ছে। আইনের দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে এই কাজগুলো করা হচ্ছে। আইনের সংশোধন করতে হবে। এই ধরণের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে। এ বিষয়ে ক্যাম্পেইন ফর টোবাকো ফ্রি কিডস বাংলাদেশ জনমত সৃষ্টি করছে। নীতি নির্ধারক, জনপ্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করা হচ্ছে। আমরা আশা করি, যত দ্রুত সম্ভব আইনের সংশোধন হোক।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সূত্রে জানা যায়, আইন সংশোধেনে ড্রাফটিং চলছে। অতি শিগগিরই তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী চলে আসবে। তবে এরই মধ্যে বর্তমান আইন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহঅনুমোদিত কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনদের অনুরোধ করে চিঠি পাঠানো হয়েছে। মোবাইল কোর্টের ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ কাযক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা’ শিরোনামে একটি গাইডলাইন প্রণয়ণে সহায়তা, বিভিন্ন ফোরামে তামাক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনাসহ নাবিধ কর্মকান্ড পরিচালনা করছে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল।

সেলের সমন্বয়কারী (অতিরিক্ত সচিব) হোসেন আলী খন্দকার বলেন, বিক্রয় কেন্দ্রে প্রোডাক্ট ডিসপ্লে বা পণ্য প্রদর্শনী নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে আইনে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। এতে করে শিশুসহ সকলের ওপর খুব খারাপ এবং ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। আইন সংশোধনের জন্য সরকার চিন্তাভাবনা করছে। আইনের মধ্যে এই বিষয়টি আনা হয়েছে। পলিসি পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে। আমরা আশা করি, অতি শিগগিরই সংশোধন হবে।

হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, শ্বাসরোগ, ক্যান্সার, স্ট্রোক ও কিডনি রোগের মতো মরণব্যাধির মূল কারণ তামাক। দেশের ৬৭% অসংক্রামক রোগের জন্য দায়ী তামাক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছেন। আর শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ- এই কথাটিই যদি আমরা সবসময় বলে থাকি। তাহলে শিশুদের হাতে কেন তুলে দিচ্ছি তামাকের মতো মরণনেশা। তাই, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে সিগারেট বা কোনও তামাকজাতীয় পণ্য বিক্রি নিষিদ্ধ করা সময়ের দাবী। পাশাপাশি আইনের সংশোধনের মাধ্যমে বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্যের কোনোরূপ প্রদর্শন, শিশুদের প্রলুব্ধকরণে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বনসহ টোব্যাকো কোম্পানীর সকল বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।

লেখক: পরিকল্পনা সম্পাদক, ইউনাইটেড নিউজ টোয়েন্টি ফোর ডট কম

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here