Budgetগত ১ জুন মহান জাতীয় সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করা হয়। প্রতি বছরই প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে বিভিন্ন সেক্টরে আলোচনা হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে সংযোজন বিয়োজন করে সরকার চুড়ান্তভাবে বাজেট ঘোষণা করে। নতুন অর্থ বছরে সরকার মোট ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে। মোট বাজেটে নারীর হিস্যা বা সংশ্লিষ্টতা রয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ১৯ কোটি টাকায়, যা শতকরা হারে ২৭.৯৯ ভাগ। সব মিলিয়ে এবারের বাজেট নিয়ে কয়েকজন বিশিষ্ট নারীর মতামত নিয়েছেন- আ হ ম ফয়সল

 

ড. নাজনীন আহমেদজেন্ডার বাজেটিং এর মূল লক্ষ্য অর্জন হচ্ছে না
ড. নাজনীন আহমেদ
সিনিয়র রিসার্স ফেলো, বিআইডিএস

প্রথমত এবারও জেন্ডার বাজেট দেখে হতাশ হলাম। জেন্ডার বাজেটিং এর মূল লক্ষ্য অর্জন হচ্ছে না। পিছিয়ে পড়া নারীদের সামনে এগিয়ে নিয়ে আসা বিশেষ করে সে সকল নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথটিকে সুগম করতে সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যে সকল প্রকল্প, কর্ম পরিকল্পনা বা উদ্যোগগুলো গ্রহণ করে সেগুলো অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় হচ্ছে কি না, নারীদের কতটা কাজে লাগছে কিনা, সেটি সম্পর্কে যাতে সবাই জানতে পারে সে জন্যই মূলত জেন্ডার বাজেট কিন্তু দেখা যাচ্ছে দিন দিন জেন্ডার বাজেট এমন ভাবে পেশ করা হচ্ছে সেখানে কোন মন্ত্রণালয়ে কত টাকা বরাদ্দ দেয়া হলো টাকা অংকগুলো উল্লেখ করে একটি খতিয়ান থাকে। নতুন অর্থ বছরে সরকার বলছে মোট বাজেটের ২৭.৯৯ ভাগ অর্থ নারীদের উন্নয়নে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে বিষয়টি স্পষ্ট না। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে নারী উন্নয়নের খাতগুলো আরো বিস্তারিত ভাবে থাকা প্রয়োজন ছিল। জেন্ডার বাজেট আলাদা করে ঘোষণা করে, রিপোর্ট দিয়ে নারীদের উন্নয়নে সরকারের পদক্ষেপগুলো কতটা কার্যকর হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। সরকার যখন বাজেট ঘোষণা করছে ঠিক তখনই বিবিএস বাংলাদেশের শ্রমজরিপ-২০১৬ প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা গেছে নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেকারত্ব বেশি এবং এক তৃতীয়াংশ নারী শ্রমবাজরে যুক্ত আছে, এ বিষয়গুলোকে সরকারের বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া সক্ষমতা বাড়াতে নারীদের আয়মুক্ত করের সীমা ৫০ হাজার টাকা বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করা উচিত।

 

পারভীন মাহমুদ বাজেট বরাদ্দ বাস্তবায়নে মনিটরিংকে গুরুত্ব দিতে হবে
পারভীন মাহমুদ
সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)

এবার ৪৩টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে জেন্ডার বাজেট ঘোষণা করা হলেও এতে মনে হচ্ছে ইফেকটিভ কিছু বাড়েনি। মোট বাজেটের ক্ষেত্রেও নারীদের জন্য এবারের বরাদ্দ তেমন বাড়েনি। এসডিজির ৫নং অভীস্ট হলো ‘জেন্ডার সমতা অর্জন এবং সকল নারী ও মেয়ের ক্ষমতায়ন’। সে ক্ষেত্রে বাজেটে নারীদের ক্ষাতগুলোকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। বাজেট বরাদ্দের থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সত্যিকার অর্থে নারীরা এর সুফল কতটুকু পাচ্ছে, মানে বাজেট বাস্তবায়ন কতটুকু হচ্ছে। বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের সক্ষমতা বাড়লেও বিভিন্ন মহলে সমালোচনা রয়েছে। বাজেটের ক্ষেত্রে সুশাসন ও নিয়ন্ত্রণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক নিরাপত্তা খাতগুলো সরকার এবারও বাড়িছে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য গতবারেরমত এবারও একশ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বরাদ্দ ঠিকই আছে তবে উদ্যোক্তাদের এ ধরণের বরাদ্দ ছাড়করণ হচ্ছে কি না অথবা কত সহজে পাচ্ছে সে বিষয় গুলোকেও সরকারের নজরে আনতে হবে। স্পেশাল পেশার সাথে জড়িতদের জন্য বাজেটে বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। সরকারের বিভিন্ন ধরণের ভিকটিম সেন্টর রয়েছে, হটলাইন সুবিধা রয়েছে, এগুলোর সুরক্ষা ও গুণগত মান বাড়াতে বাজেটে সুনির্দিষ্ট ভাবে বরাদ্দ ও মনিটরিং থাকা প্রয়োজন। বাজেট বরাদ্দ বাস্তবায়নে মনিটরিংকে গুরুত্ব দিতে হবে। যদিও সরকারের লোকবল সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সরকার বাজেট মনিটরিং করতে প্রফেসনাল প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)কে সহযোগী হিসেবে নিতে পারে।

 

রাশেদা কে. চৌধূরী উচ্চ শিক্ষায় মেয়েদের প্রণদনা এবং আবাসিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে
রাশেদা কে. চৌধূরী
নির্বাহী প্রধান, গণস্বাক্ষরতা অভিযান

সরকার জেন্ডার বাজেট প্রণয়ন নিয়মিত করে যাচ্ছে- এটি একটি ইতিবাচক দিক। কিন্তু প্রতিবারেরমত এবারও বাজেট বরাদ্দ ব্যবহার যথাযথ হয়েছে কি না সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। জেন্ডার বাজেটে ব্যবহারের খাতগুলো সুনির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের মোটা একটি অংশ নারীর জন্য থাকে কিন্তু জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদনে এর সুনিদিষ্ট প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই না। শিক্ষা খাতে সরকার উপবৃত্তির পরিধি বাড়িয়েছে কিন্তু বস্তিবাসীদের জন্য উপবৃত্তির যথাযথ বরাদ্দ আমরা দেখতে পাইনি।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। উচ্চ শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াতে কারিগরি শিক্ষায় মেয়েদের প্রণদনা দিতে হবে এবং আবাসিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। আবাসিক সুবিধা না থাকার ফলেই উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য গ্রাম থেকে মেয়েরা শহরে আসতে চায় না। প্রস্তাবিত বাজেটে মাতৃত্বকালীন ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে তবে ভাতার পরিমানও বাড়ানো প্রয়োজন। তবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মনিটরিং কে গুরুত্ব দিতে হবে। সরকার এবার প্রথমবারেরমত হিজড়াদের জন্য বরাদ্দ রেখেছে- এটি সরকারের জনবান্ধব দৃষ্টিভঙ্গি। তবে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সঠিক ব্যক্তির কাছে পৌছানো।

 

শাহিদা পারভীনজেন্ডার বাজেট নূন্যতম ৫০ শতাংশ হওয়া উচিত
শাহিদা পারভীন
রিসার্স অ্যাসোসিয়েট, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)

নারীর ক্ষমতায়ন ও জেন্ডার ভিত্তিক বৈষম্য দূরীকরনে সরকারের সদভাব প্রশংসার দাবীদার। সরকারের সদিচ্ছার বহিপ্রকাশ ঘটে থাকে মূলত জাতীয় বাজেট প্রনয়ন ও তার বাস্তবায়নে। ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে বাংলাদেশ সরকার জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদন তৈরি করছে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে জেন্ডার বাজেট মোট বাজেটের ২৭.৯৯ শতাংশ, যা ২০০৯-১০ থেকে ২০১৭-১৮ সময়ের মধ্যে, সর্বোচ্চ ছিল ২৮.৬৮ শতাংশ ২০১২-১৩ অর্থ বছরে। এবার প্রস্তাবিত অর্থবছরে জেন্ডার বাজেট প্রবৃদ্ধি ২০.৮ শতাংশ, যা মূল বাজেটের প্রবৃদ্ধি ১৭.৫ শতাংশ থেকে সামান্য বেশি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ৪৩ টি মন্ত্রনালয় ও বিভাগের মধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বরাদ্দের তুলনায় ১২ টিতে উল্লেখ্যযোগ্যভাবে বরাদ্দ কমেছে আর ৩১ টিতে বেড়েছে। অন্যদিকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় বাজেটে ৩৪ টিতে বরাদ্দ বেড়েছে এবং ৮ টিতে কমেছে এবং ১ টিতে অপরিবর্তিত আছে। বরাদ্দ কমে যাওয়াটা মোটেই প্রত্যাশিত নয় যেহেতু বরাদ্দই খুব কম।
বরাদ্দ বাড়া বা কমার চেয়ে প্রশ্ন হচ্ছে এই বাজেট বরাদ্দ কিভাবে হয় এবং এই বরাদ্দ কি যথেষ্ট কিনা? আমরা যতদূর বুঝতে পারছি বিবেচ্য মন্ত্রনালয়গুলোতে এবং মন্ত্রনালয়গুলোর অধীনে যেসব নারীরা যুক্ত তাদের পেছনে যে খরচ তারই হিসাব হচ্ছে জেন্ডার বাজেট। যেসব মন্ত্রনালয় ও বিভাগের তথ্য আছে লক্ষ্য করলে দেখা যায় নারীর অংশগ্রহন খুবই কম, এমনকি এক তৃতীয়াংশেরও কম। বিশেষ করে প্রশাসনের উচ্চ স্তরে এই হার ভীষনভাবে কম, নারীর অংশগ্রহণ কিছুটা বেশি শিক্ষা ও সেবামূলক পেশায়। উদাহরন সরুপ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে অফিসার পদে আছেন ১৬ জন নারী ও ৪১ জন পুরুষ এবং অন্যান্য স্টাফ আছেন ১৩ জন নারী ও ১০৩ জন পুরুষ। মন্ত্রনালয়গুলোর অধীনে যেহেতু নারীর অংশগ্রহণ কম তাদের জন্য মোট বরাদ্দও কম। ২০১৫-১৬ শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ হার মাত্র ৩৫.৬ শতাংশ।
বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশ নারী। সত্যিকার জেন্ডার বাজেট ১৪-২৮ শতাংশের মধ্য সীমাবদ্ধ না রেখে নূন্যতম ৫০ শতাংশের মত হওয়া উচিত। পিছিয়ে থাকা নারীদের এগিয়ে আনার জন্য বরঞ্চ তাদের জন্য অতিরিক্ত বরাদ্দ থাকা উচিত। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে নারীদের বরাদ্দ ২০০৯-১০ থেকে এখন পর্যন্ত ১৪-২৮ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। প্রচলিত বরাদ্দ দেখে মনে হয় নারীদের জন্য যে খরচ তা সরকার যথাযথভাবে তথ্যের মাধ্যমে আলাদা করে উপস্থাপন করতে পারে নি অথবা নারীদের দিকে কম মনোযোগ দেয়া হচ্ছে।

 

আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরীচ্যলেঞ্জিং নারীদেরকে তুলে আনতে বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন
আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী
সংসদ সদস্য

মাননীয় অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তিতায় ‘উন্নয়নে নারী’ শিরোনাম দিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’ উল্লেখ করেছেন। এটি বলার মধ্য দিয়ে তিনি উন্নয়নের মহাসড়কে আজকের যে বাংলাদেশ তার অবদানে নারীর অর্ধেক অবদানকে আক্ষরিক অর্থে স্বীকার করলেন। প্রস্তাবিত বাজেটে নারীর বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন কিন্তু এ বিষয়গুলো যদি অন্তর্নিহীত দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখা হয়, এখানে নারীর যে চ্যালেঞ্জিং রুপ, ঘরে এবং বাহিরে, বাজেটে নারীদের উন্নয়নের ক্ষেত্রগুলো আরো সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল। চ্যালেঞ্জিং যে সকল যায়গা গুলোতে নারীরা এখন সংগ্রাম করছে সেখানে অর্থের বিনিয়োগ সুনির্দিষ্টভাবে থাকা প্রয়োজন। এভারেষ্ট বিজয়ী ওয়াসফিয়া নাজরীন, নীশাত মজুমদারেরমত তারা সমাজে নারীর দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। এ ধরণের চ্যলেঞ্জিং নারীদেরকে তুলে আনতে তাদের জন্য বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন।
নারীর ক্ষমতায়নে শেখ হাসিনার সরকারের অবদান বলার অপেক্ষা রাখে না। এছাড়া অনেকে মনে করলেও সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্যের পদটি আমি অলংকার পদ হিসেবে মনে করি না। বাজেট বাস্তবায়নে আমাদেরও কাজ করার অনেক সুযোগ আছে, চেষ্টাও করে যাচ্ছি। নারীর ক্ষমতায়নে মেয়েদের খেলাধুলা, ড্রাইভিংকে গুরুত্ব দিতে হবে। এসব সেক্টরে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। সে জন্য বাজেটে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে দিলে তখন নারীরা যেমনি উৎসাহিত হবেন এবং গতানুগতিক সীমানা প্রাচির ভেঙ্গে যে সকল নারীরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, সেরকম নারীর সংখ্যা বেড়ে আসবে। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা খাতে দূর্যোগকালীন সময়ে নারীদের জন্য বাজেট বরাদ্দের দিকটিকে বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দেয়া উচিত।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here