মীর আব্দুল আলীম ::

রমজান মাস। জন্মের পর থেকে দেখছি এ মাসে লাফিয়ে লাফিয়ে পণ্যমূল্য বাড়ে। এ দেশের ব্যবসায়ী-মজুদদাররা ধরেই নেয়, মুনাফায় পকেট ভারী করার মওকাই হচ্ছে রমজান। রমজানে দুটো পয়সা কামিয়ে নিতে এরা কোমর বেঁধে প্রস্তুতি নেয় আগেই। মজুদ গড়ে তোলে, দফায় দফায় মূল্য বাড়িয়ে সাধারণ ভোক্তাদের নাভিশ্বাস তোলে। পণ্যমূল্য নিয়ে আর কোনো দিন লেখব না এমনটিই ভাবছিলাম। লেখে কিই বা লাভ? আমার লেখায় কি বাজারে দ্রব্যের উত্তাপ এতটুকুও কমবে? ৩০ বছর ধরে লেখালেখি করেছি, কি সুফল পেয়েছে দেশের মানুষ? তবু আমি আশাহত নই। মানুষের বিবেক একদিন জাগবেই; মানুষের বোধোদয় হবেই। মানুষের মধ্যে ধর্মানুভূতি আসবেই। এমন আশা বুকে নিয়েই লেখি, লিখে যাব। এমন দিনের আমরা প্রত্যাশা করি, যেদিন রমজানে ব্যবসায়ীরা আর মুনাফা করতে চাইবে না। অন্তত এই একটি মাসে লাভের কথা চিন্তা না করে ভোক্তাদের কল্যাণে কাজ করবে।

যদি কোনো মুনাফাখোর, মজুদদার আমার লেখাটা পড়েন, তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি। নানা ছলচাতুরীতে টাকার পাহাড়তো গড়েছেন। আর কত টাকা চাই আপনাদের? একজন মানুষের জীবনে কত টাকার প্রয়োজন হয়? দামি গাড়ি হাঁকান; নানা জায়গায় গড়ে তুলেছেন আলিসান বাড়ি; কারো কারো আছে ভোগবিলাসের বাগানবাড়িও। আর খাবার? যখন যা চাইছেন তাই তো মিলছে। বাঘের চোখও তো চাইলে আপনারা পান। এবার অন্তত সিয়াম সাধনার মাসে এ দেশের অসহায় মানুষগুলোর কথা ভাবুন। রোজার আগেই নিম্নআয়ের মানুষগুলো আপনাদের চাপিয়ে দেওয়া যথেচ্ছ দাম দিয়ে খাবার কিনতে পারছে না। ওরা দুবেলা পেট পুরে খেতে পাচ্ছে না। রোগে-শোকে মরছে। আপনারা কি নিজের সন্তান না খেয়ে কাতরানোর দৃশ্য দেখেছেন কখনো? অভাবী মানুষগুলো প্রতিনিয়তই তা দেখছে। ওদের অভ্যাসগত দেখা এটি। সামান্য টাকার অভাবে ওরা সন্তানের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুটাও চেয়ে চেয়ে দেখে।

মানুষকে জিম্মি করে ভোগ্যপণ্যের অধিক মুনাফা লাভের এই খেলা কেন সরকার বন্ধ করতে পারে না? কিন্তু এই সম্ভবকে অসম্ভব করতে হলে সরকারকে অবশ্যই হার্ডলাইনে যেতে হবে। প্রথমে চিহ্নিত করতে হবে সেসব অসাধু ব্যবসায়ীকে, যারা সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। ইচ্ছেমতো পণ্যের দাম বাড়িয়ে নিজেদের ফায়দা লুটে। অর্থনীতিতে একটা কথা আছে, চাহিদার তুলনায় উৎপাদন যত কম হবে, পণ্যের দাম তত বেশি হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সহজ কাজ নয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যতবার পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, ততবারই বাজারে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। বড় বড় ব্যবসায়ী সরকারকে বারবার আশ্বাস দিচ্ছে, রোজার মধ্যে পণ্যের দাম বাড়বে না। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন বাজারে নেই।

এটাও সত্য যে বিশ্বজুড়েই মূল্যস্ফতি চলছে। সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ০২ শতাংশ। যা বছরওয়ারি হিসাবে এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। মূল্যস্ফীতির চাপে আছে সাধারণ মানুষ। যতটা পণ্যমূল্য হওয়ার কথা তার চেয়ে অনেক বেশি পণ্যম্যূ বেড়েছে বাংলাদেশে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং দেশে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে আমদানি খরচ বাড়ে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা। নানা কারন থাকলেও পণ্যের দাম লাফিয়ে বেড়ে ওঠার প্রধান কারন সিন্ডিকেট। সরকারের পক্ষ থেকেও সেটা স্বিকার করা হচ্ছে। ৩ জুলাই আকাম চুম্বি কাঁচামুরিচের দাম নিয়ে খোদ সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রী বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি রংপুরে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন কাঁচা মরিচের দাম বাড়িয়েছেন সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ীরা। সুযোগসন্ধানী ব্যাবসায়ীদের কথা বরাবরই বলা হলেও সরকার কেন তাদের রোধ করতে পাছেনা। প্রশ্ন হলো সিন্ডিকেটওয়ালারা কি দেশ চালায়? তারা কি সরকারের চেয়েও ক্ষমতাধর? এটা কি মঘেরমুলুক যে ৫০ টাকার পণ্য মুহহুর্তে হাজার টাকা হয়ে যায়। ৪০ টাকার পিয়াজ সপ্তাহ ব্যবধানে হয়ে যায় দেড়’শ দুই’শ টাকা!

অসাধু সিন্ডিকেটের কারসাজিতে  প্রতি সপ্তাহে কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের ঠকাচ্ছে। সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও দাম বাড়িয়ে ভোক্তাকে নাজেহাল করা হচ্ছে। আবার চাল নিয়ে করা হচ্ছে চালবাজি। এ ছাড়া ব্রয়লার মুরগি থেকে শুরু করে সব ধরনের সবজি, আদা-রসুন, মাছ-মাংস, চিনি ও ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়ে ক্রেতাকে জিম্মি করা হচ্ছে। বছরের পর বছর এমন অবস্থা চললেও সরকারের একাধিক সংস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। শুধু হাঁকডাকের মধ্যেই তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছে।
আমরা জানি, এসব পরিস্থিতি থেকে ভোক্তাকে রক্ষা করতে সরকারের একাধিক বাজার তদারকি সংস্থা কাজ করছে। এর মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তদারকি সেল, মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, কৃষি মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, বিএসটিআই, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, র‌্যাবসহ সরকারের অন্যসব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে।

এছাড়া এসব সংস্থা নিজস্ব আইনে বাজার তদারকি করছে। তারপরও বাজারে কোনো ধরনের শৃঙ্খলা আনা সম্ভব হয়নি। তাহলে কি গোড়ায় গলদ? এদেশের সিন্ডিকেটওয়ালারা বড়ই প্রভাবশালী। সরকারের লোকজনেরসাথে তাঁদের সখ্যতা অনেক। তাই হয়তো তাঁদের রোধ করা যায় না কিংব রোধ করা হয় না। এদেশের  অসাধু ব্যবসায়ীরা চাইলে ভোগ্যপণ্যের বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করতে পারে বা পণ্যের সরবরাহ কমাতে পারে। কৌশল করে তারা দাম কমাতে পারে, আবার বাড়াতেও পারে। এখানে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

রমজান উপলক্ষে বিশেষ কতক পণ্যের চাহিদা বাড়ে। ভোজ্য তেল, চিনি, ছোলা, মসুর, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, নানা রকম মসলাসহ চাহিদা বাড়ে মাছ, মাংস ও দুধের। আর ব্যবসায়ী-মজুদদাররা ধরেই নেয়, মুনাফায় পকেট ভারী করার মৌসুমই হচ্ছে সিয়াম সাধনার মাস পবিত্র রমজান। রমজানে দুটো পয়সা কামিয়ে নিতে এরা কোমর বেঁধে প্রস্তুতি নেয়। মজুদ গড়ে তোলে, দফায় দফায় মূল্য বাড়িয়ে সাধারণ ভোক্তাদের নাভিশ্বাস তুলে ছাড়ে। এই মুনাফাখোররা এ দেশের অসহায় মানুষের কথা ভাবে না।

এ দেশে দ্রব্যমূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পায়। কোনো পণ্য আজ যে দামে বিক্রি হচ্ছে, কাল সেই একই পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। তবু মন্দের ভালো এবার রমজানে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ১৩৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে না। সরকারের ব্যাপক প্রচেষ্টায় এক মাস আগের ২৫ টাকার পেঁয়াজ এখন পাচ্ছি ৪০ টাকায়। সব পণ্যতেই কমবেশি রমজানের আঁচ লেগেছে। চাল, ডাল, মাছ, মাংস, তেল, তরিতরকারি, ফলমূল, চিনি, লবণ, গম, আটা, রুটি, বিস্কুট ইত্যাদি দ্রব্যের মূল্য আগের তুলনায় বেড়ে গেছে। মানুষের ওপর চেপে বসেছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ঘোটক। জীবন ধারণের উপযোগী প্রতিটি জিনিসের অগ্নিমূল্য। ফলে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। অতিরিক্ত মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের জন্যই সাধারণ মানুষকে এই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সরকারকে কঠোর হাতে অতিলোভী এই ব্যবসায়ীদের দমন করতে হবে। আশার কথা, এবারের রমজানে দ্রব্যমূল্য এবং চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে সরকার কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে।

যতটুকু জেনেছি, প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে; পণ্যবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজি ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে। সারা দেশে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিভাগীয় এবং জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে কাজ করছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। এ ধারা অব্যাহত রাখলে হয়তো দ্রব্যমূল্য অনেকটাই সহায়ক পর্যায়ে পৌঁছাবে। তবে সরকারকে এই লাগাম শক্ত করে ধরতে হবে।

পুরোপুরি সিন্ডিকেটের কব্জায় চলে গেছে দেশের ভোজ্যতেল, চাল, পিয়াজসহ নিত্য পণ্যের বাজার। ব্যবসায়ীরা একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে বাজার থেকে অতিরিক্ত মুনাফা তুলে নিচ্ছেন। চেষ্টা করলেও কিছুতেই তা সরকার নিয়ন্ত্রনে আনতে পারছে না। সরকার সংশ্লিষ্টদের হম্বিতম্বি কোনই কাজে আসছে না। শুধু চাল তেল নয় মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, পিয়াজ সব কিছুর দাম এখন উর্দ্ধে। তাতে উচ্চবিত্তদের কোন সমস্যা নেই। মধ্যবিত্ত আর গরিবের হয়েছে যত জ্বালা।

গত ৫ বছরে জাতীয় পর্যায়ে পারিবারিক আয় বেড়েছে ৫৯ শতাংশ, আর খরচ বেড়েছে ৮৪.৫ শতাংশ। পারিবারিক ভোগ-ব্যয়ের অর্ধেকেরও বেশি প্রায় ৫৫ শতাংশ জুড়ে রয়েছে খাদ্য। সবচেয়ে কম আয়ের পরিবারে খাদ্যের পেছনে খরচ হয় ৭২ শতাংশ, সবচেয়ে বেশি আয়ের পরিবারে খাদ্যবহির্ভূত খাতে খরচ ৫৯ শতাংশ। যেসব পরিবারের আয় মাঝামাঝি পর্যায়ে, খাদ্যের পেছনে মোট সংসার খরচের ৬১ থেকে ৬৫ শতাংশ ব্যয় হয় তাদের। সবচেয়ে বেশি দরিদ্র পরিবারের সঙ্গে সমাজের উঁচু স্তররের মানুষের আয়ের বৈষম্য বেড়েছে। তবে পাঁচ বছরে দরিদ্র্র পরিবারের আয় খানিকটা বাড়লেও ধনীদের আয় কমেছে বলে এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে।

ব্যবসায়ীরা নানা ফন্দি ফিকিরসহ ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে তাঁর মুনাফা ঠিক রাখতে পারেন। রিকশাওয়ালারা চালের দাম বাড়ার অজুহাত দেখিয়ে ভাড়া বাড়িয়ে নিতে পারেন। কিন্তু চাকরিজীবী আইজউদ্দিনরা তাঁদের বেতন চাইলেই বাড়াতে পারেন না। একটি পদের পেছনে যেখানে হাজার হাজার আবেদনপত্র পড়ে, সেখানে এক চাকরি ছেড়ে অন্য চাকরিতে ঢোকার সুযোগও নেই। ফলে একটু ভালো করে বাঁচার আশাটি আর তাঁদের পূরণ হচ্ছে না। ঢাকা মহানগরীতে সীমিত আয়ের মানুষের বসবাসের অর্থ দাঁড়িয়েছে ‘শুধু বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে থাকা।’

বলতেই হয নিম্ন আয়ের মানুষ ভালো নেই। আয় কমলেও উচ্চ আয়ের মানুষদের সমস্যা হচ্ছে কম। বেশী বিপদে রয়েছেন শুধু সনাতনি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ, যাদের জীবনবোধ ভিন্ন। তাদের মাসিক আয়ের ৬০ ভাগ চলে যায় বাড়িভাড়া, আর ২০ ভাগ খাবারে। দুই বাচ্চার পড়াশোনা আর স্কুলে যাতায়াতে খরচ হয় আয়ের ১০-১৫ ভাগ। তারপর রয়েছে চিকিৎসা। মানুষের একদিকে বাসস্থান সমস্যা প্রকট, অন্য দিকে পারিবারিক ব্যয় বহুগুণে বেড়ে যাওয়ায় মহা সংকটে পরেছে। জনগনের কথা মাথায় রেখে যে কোন মূল্যে পণ্য মূল্যসহ অন্যান্য ব্যয় যাতে কমে সেদিকে সরকারের নজরদারীর বিকল্প নেই। সরকারের কার্যকর পদক্ষেপই পারে এ ক্ষেত্রে সফলতা এনে দিতে। বাজার তদারকিসহ সকল ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ গুলো সদাই সজাগ থাকতে হবে। অধিক মুনাফার খেলা সরকার কেন বন্ধ করতে পারে না? পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রনে সরকারকে ব্যর্থ হলে চলবে না। বাজার নিয়ন্ত্রণে আরো কঠোর হতে হবে।

লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব- কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here