সিরাজগঞ্জ জেলার বাঘাবাড়ীতে অবস্থিত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পেরেশন (বিপিসির) জ্বালানীতেল ডিপোর বাইরে ১২টি স্থানে জ্বালানীতেল চোরাকারবারীরা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এই চোরাকারবারীরা ট্যাংক লরি থেকে পেট্রোল অকটেন চুরি করে তাতে কেরোসিন সাদা করে মিশিয়ে ভেজাল করছে।
অন্যদিকে কনডেন্স সেট থেকে ব্যাক্তিমালিকানাধীন শোধনাগারে পরিশোধিত (এমটিটি) তারপিন জাতীয় সাদা (স্থাণীয় নাম বাংলা পেট্রোল তেল) সরাসরি উত্তরবঙ্গের পেট্রোল পাম্পগুলোতে অবৈধ ভাবে সরবরাহ করা হচ্ছে। এই তেল সরাসরি সাধারন ক্রেতাদের কাছে পৌছে যাচ্ছে। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনের নাকের ডগায় হলেও তারা কোন প্রকার ব্যবস্থাই গ্রহন করছেনা বলে অভিযোগ উঠেছে। অপরদিকে চুরি ও ভেজাল জ্বালানী তেল বিক্রয় করে অসাধু ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকা অবৈধ ভাবে উপার্জন করছে। এই ভেজাল তেল ব্যবহার করে যানবহনের স্থায়ীত্বকাল কমে যাচ্ছে। সমপ্রতি ভ্রাম্যমান আদালতে একজন ভেজালকারীকে তিনমাসের বিনাশ্রম কারাদন্ডাদেশ প্রদান করা হয়েছে।
এলাকাবাসী ও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, ডিপোর উত্তরে বাজারের ৮ টি স্থানে, বড়াল সেতুর নিচে তিনটি স্থানে এবং বগুড়া নগরবাড়ী মহা সড়কের দুইপার্শ্বে ১৫টি ছোটবড় ঘরে এই ভেজাল কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। এ সকল স্থানে প্রতিটি ট্যাংক লরি থেকে দুই থেকে তিন ড্রাম করে (২৫০ লিটার) পেট্রোল ও অকটেন বের করে নিয়ে উক্ত ট্যাংক লরিতে সমপরিমান নীল কেরোসিন সাদা করে মেশানো হচ্ছে। বিশেষ কায়দায় রঙিন কেরোসিন সাদা করা রং পরিবর্তন করা হচ্ছে। সড়কের দুই পার্শে বড় আকারের দরজা দিয়ে ঘর তৈরি করা হয়েছে। এই দরজা দিয়ে ট্যাংকলরি ভিতরে প্রবেশ করার পর দরজা বন্ধ করে দিয়ে এই অবৈধ কাজ করা হচ্ছে।
এ ছাড়াও নৌ-চ্যানেলের কাশিয়ার চর এলাকা থেকে চয়রা পর্যন্ত চলাচলকৃত জাহাজ থেকে সরাসরি তেল চুরি করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ট্যাংকলরি থেকে ত্রিশ থেকে ৪০ লিটার করে তেল চুরি করা হচ্ছে। প্রতিদিন দুই থেকে তিনশত ট্যাংক লরি এবং জাহাজ চলাচল করে থেকে। যে কারনে মোটা অংকের চুরি এখানে হচ্ছে বলে সূত্রটি জানায়।সূত্রটি আরও জানায়, নীলাভ বর্ণের কেরোসিনকে সাদা করতে কয়েক প্রকার রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করতে হয়। বাঘাবাড়ী ব্যাসষ্ট্যান্ড এর উপর বেশ কিছু ঘরের মধ্যে পূর্ব থেকেই কেরোসিন সাদা করার পর রেখে দেয়া হয়। ট্যাংকলরি আসার সঙ্গে সঙ্গে তা পাল্টিয়ে দেয়া হয়। যাতে সময়ক্ষেপন কম হয়। বেশী পরিমান তেলের সঙ্গে মেশানোর কারনে খালি চোখে এগুলো সহজে ধরা পড়েনা।
বিপিসির একটি সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন গ্যাস ক্ষেত্র থেকে পাওয়া তলানী (কনডেন্সসেট) পরিশোধন কৃত (এমটিটি বা মিনারেল তারপেন টাইন তেল) কেরোসিন ও ডিজেল উৎপাদন করা হয়। এই তেল বিপিসির নিয়ন্ত্রনাধীন (পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা) ডিপোর মাধ্যমে নিদিষ্ট দামে বিক্রয় করার কথা। অভিযোগ রয়েছে এসকল কনডেন্সসেট শোধন ছাড়াই চোরাই পথে এনে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন পেট্রোল পাম্পে বিক্রয় করা হচ্ছে। অধিকাংশ পেট্রোল পাম্পেই এখন এ ধরনের তেল বিক্রয় করা হচ্ছে। গত বছর সিরাজগঞ্জ র্যাব-১২ একটি দল অভিযান চালিয়ে এই তেল সহ একটি ট্যাংকলরি বঙ্গবন্ধুসেতু পশ্চিম সংযোগ সড়কের হাটিকুমরুল এলাকা থেকে আটক করেছিলো। মটর সাইকেল চালক তালগাছী পেট্রোল পাম্প থেকে তেল নিয়ে ব্যবহার করে গাড়ী নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রিংপিষ্টন বসে যাচ্ছে। প্রতিটি গাড়ীর আয়ূষ্কাল কমে যাচ্ছে। মাত্র দুই একটি পেট্রোল পাম্প ছাড়া বাকী সবগুলো পাম্পএর তেলের অবস্থা অতান্ত খারাপ বলে তারা উল্লেখ করেন।
বেশ কয়েকজন ডিলার ও এজেন্টরা বলেন, বাঘাবাড়ী বন্দর এলাকায় একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। বর্তমানে পেট্রোল ও অকটেনের চাহিদা বেশী থাকায় এই চক্রটি ভেজাল কারবার করছে। আমরা এদের কাছে ডিলার এজেন্টরা মোটামুটি জিম্মি হয়ে থাকে। তেল পরিবহনের সময় ট্যাংকলরির সঙ্গে থাকা সম্ভব হয়না। আর এই সুযোগ নিয়ে চালক শ্রমিক ও অসাধু ব্যবসায়ীরা যোগ সাজস করে এই কাজ করে যাচ্ছে। এক ড্রাম তেল বদল করলে আট থেকে ১০ হাজার টাকা লাভ হয়। এই টাকা চালক শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভাগাভাগী হয়ে থাকে। যে কারনে আমাদের এই ভেজাল তেলই বিক্রি করতে হয়।
বিগত তত্ববধায়ক সরকারের সময় এটি ছিলো না। রাজনৈতিক সরকার আসার সঙ্গে সঙ্গে এই ভেজাল ও চোরকারবারী ব্যবসা শুরু করে। বর্তমানে এরা বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কয়েকজন চোরাকারবার নাম প্রকাশ করার না শর্তে বলেন, আমাদের যে সকল ঘরে এই ভেজাল কাজ চলে এজন্য প্রশাসনকে মাসিক চাদা দিয়ে থাকি। তাছাড়া আমরা সবাই পেটের দায়ে এগুলো করি।
এ বিষয়ে বাঘাবাড়ী ডিপোর কর্মকর্তারা জানান, ডিপোর বাইরে ভেজাল কাজ করা হচ্ছে এবং বাংলা পেট্রোল নামের একটি তেল বিভিন্ন রিফাইনারী প্রতিষ্ঠান থেকে আসছে বিষয়টি সকলেরই জানা।
আমাদের পক্ষ থেকে বিষয়টি উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। ডিপো থেকে তেলের নমুনা মিলিয়ে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এখানে ভেজালের কোন সুযোগ নেই। এ বিষয়ে শাহজাদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ জসিম উদ্দীন সরকার জানান, বিষয়গুলো বিএসটি আই এর পর্যবেক্ষন করার কথা। তারা যখন আমাদের পুলিশের সাহায্যে চাইবে আমরা তাদেরকে সহায়তা করবো।
কয়েকদিন পূর্বে একজন ভেজাল কারীকে আটক করা হয়েছিলো। এই চোরকারবারীদের নিকট থেকে কোন রকম টাকা পয়সা নেয়ার প্রশ্নই উঠেনা। পুলিশ প্রশাসন এ বিষয়ে কোন অভিযোগ পেলে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা গ্রহন করবে।
শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন কিছু ভেজাল হচ্ছে বিষয়টি স্বীকার করে জানান, ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে নগরবাড়ী-বগুড়া মহাসড়কের জুংলিদহ নামক স্থানে ভেজাল করার সময় বেলাল হোসেন নামের একজনকে হাতে নাতে আটকের পর তাকে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ডাদেশ দেয়া হয়। এর পর থেকে ভেজাল এবং চোরকারবারীদের উপর অভিযান অব্যহত রয়েছে।
ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/সুজন সরকার/সিরাজগঞ্জ