বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের উদ্যোগে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে দেশী-বিদেশী ছয় জন পাখি বিশেষজ্ঞ মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার হাইল হাওরের ‘বাইক্কা বিল অভয়াশ্রমে’ পাখি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা শুরম্ন করেছেন। বার্ড ক্লাবের সভাপতি পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হকের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ দলটি চলতি বছরের ৩ ডিসেম্বর থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যনত্ম পাখি নিয়ে গবেষণা করেন। এ বছরই প্রথম বাংলাদেশের নামাঙ্কিত রিং পাখির পায়ে পড়িয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশের নামাঙ্কিত রিং ইংল্যান্ড থেকে নিয়ে আসার পর বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব বাইক্কা বিল অভয়াশ্রমে প্রথম এ গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা এবং পাখির পায়ে রিং পড়িয়েছে। ৬দিনে দেশী ও পরিযায়ী মিলে ২৮ প্রজাতির মোট ২শত ১০টি পাখির পায়ে রিং পরানো হয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়, সমন্বিত সংরক্ষিত এলাকা সহ-ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (আইপ্যাক) এবং স্থানীয় বড়গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠনের সার্বিক সহায়তায় এবারের গবেষণা ও রিং পড়ানো কার্যক্রমে ইনাম আল হকের নেতৃত্বে অংশ নেন ইংল্যান্ডের পাখি বিশেষজ্ঞ নিক্‌ ডায়মন্ড, থাইল্যান্ডের মাহিদল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ফিলিপ রাউন্ড, বার্ড ক্লাবের সদস্য প্রাণী বিদ্যায় স্নাতকত্তোর ডিগ্রীধারী সামিউল মোহসেনিন, মোহাম্মদ ফয়সাল ও সায়াম চৌধুরী।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সভাপতি পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হকের কাছে বাইক্কা বিলে গিয়ে দেখা যায়, হাইল হাওরের বাইক্কা বিল অভয়াশ্রমে গত ৬দিনে ২৮ প্রজাতির মোট ২শত ১০টি পাখির পায়ে রিং পড়ানো হয়েছে। এ ২৮ প্রজাতির মধ্যে ১২ প্রজাতির পাখি বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বাস করে। বাকি ১৬ প্রজাতির পাখি পরিযায়ী। রিং পড়ানো ১২ প্রজাতির পাখির মধ্যে উলেস্নখযোগ্য তিলা-ঘুঘু, পাতি-মাছরাঙ্গা, করম্নণ-পাপিয়া, খয়রা-শিকরেপ্যাঁচা, সবুজ-সুইচোরা, ল্যাঞ্জা-লাটোরা, বাংলা-বুলবুল, ঝুটি-শালিক, পাকড়া-শালিক, কালা-ফিঙ্গে। পরিযায়ী পাখির মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো বাচাল-নলফুটকি, উদয়ী-নলফুটকি, ধলাপা-চুনিকণ্ঠী, মেটে-লাটোরা, হলদেভ্রম্ন-ফুটকি, তাইগা-ফুটকি, কালাভ্রম্ন-চুটকি, মেটে-চুটকি। পারিযায়ী এসব পাখি সুদুর চীন, হীমালয়ান তিব্বত, সাইরেবিয়া থেকে আসে বাংলাদেশে। ৬দিনে যেসব পাখির পায়ে রিং পড়ানো হয়েছে এর মধ্যে সবচেয়ে বড় পাখি খয়রা-শিকরেপ্যাঁচার ওজন ২৫২ গ্রাম ও সবচেয়ে ছোট পরিযায়ী পাখি হলদেভ্রম্ন-চুটকির ওজন মাত্র ৫ গ্রাম।

জিপিও ২৪২৬ লেখা সম্বলিত ও ক্রমিক নম্বর দেয়া এসব রিং পাখির পায়ে পড়ানোর পর পাখিগুলো যে দেশেই যাক না কেন বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব রিং পড়ানো পাখির সব তথ্য জানতে পারবে। সারা বিশ্বেই পাখি সম্পর্কে গবেষণার জন্য অথ্যনত্ম সক্রিয় সংগঠন রয়েছে। রিং পড়া কোন পাখি বিশ্বের যে কোন দেশেই ধরা পড়ুক না কেন তার ক্রমিক নাম্বারসহ সমূদয় তথ্য ই-মেইলে রিং পড়ানো দেশের সংগঠনকে জানানো হয়ে থাকে।

ইনাম আল হক জানান, বাংলাদেশে ২০১০ সালে বার্ড ক্লাবের যাত্রা শুরম্ন হয়। পাখি নিয়ে তাদের গবেষণা দীর্ঘমেয়াদী। এ গবেষণার মাধ্যমে পাখির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, খাদ্যাভ্যাস, আয়ুষ্কাল- এসব সম্পর্কে জানা যাবে। দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে হলে দেশে বনের উন্নয়ন ও বন রড়্গা করা অত্যাবশ্যক। আর বন রক্ষা করতে হলে পাখি সংরক্ষণ সর্ব প্রথম কাজ। কারণ প্রাকৃতিক বন পাখিদের মাধ্যমেই সৃষ্ট।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে এমনকি সারা বিশ্বে ছোট পাখি নিয়ে গবেষণা কম। ছোট পাখি সংরড়্গণ করার প্রয়াসে বার্ড ক্লাব গত বছর থেকে এ কার্যক্রম শুরম্ন করে। ইংল্যান্ডের পরজানা নামক একটি কোম্পানী থেকে পাখি ধরার জন্য সুড়্গ জাল এবং নাম্বারযুক্ত চুড়ির মতো রিং এনে গত বছর সোনাদিয়ায় শুরম্ন হয় বার্ড ক্লাবের কার্যক্রম। সে বছর দেশের আরো বেশ কটি স্থানে পাখির পায়ে রিং পড়ানো হয়। গত বছর যেসব পাখির পায়ে রিং পড়ানো হয়েছিলো সে রিং গুলোতে বাংলাদেশে নামাঙ্কিত ছিলো না। দেশের নাম রিং-এ না থাকায় পাখি নিয়ে গবেষণা কাজে বার্ড ক্লাব সমস্যায় পতিত হয়। চলতি বছরের শুরতেই বার্ড ক্লাব সরকারের সংশিস্নষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেড়্গে দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে সেপ্টেম্বর মাসে ইংল্যান্ড থেকে বাংলাদেশের নামাঙ্কিত নাম্বারযুক্ত রিং নিয়ে আসে। মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার হাইল হাওরের বাইক্কা বিলে এ বছর পাখির পায়ে বাংলাদেশের নামাঙ্কিত রিং পড়ানোর মাধ্যমে বার্ড ক্লাবের নবযাত্রা শুরম্ন হলো ।

সূত্র মতে পাখির ওপর পরিবেশের ভারসাম্য অনেকটা নির্ভরশীল। পৃথিবীর সব দেশে প্রাকৃতিক বন সৃষ্টি ও রড়্গা করে পাখিরা। তাই পাখির তথ্য জানা অত্যাবশ্যক। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শত বছরের বেশি সময় ধরে পাখি নিয়ে গবেষণা ও রিং পড়ানোর কাজ চলছে। প্রতি দেশের জন্য আলাদা আলাদা রিং রয়েছে। ফিনল্যান্ডে ১৯০৫ সাল থেকে এবং ইংল্যান্ডে ১৯০৯ সাল থেকে পাখির পায়ে রিং পড়িয়ে দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা শুরু করা হয়েছিল। যা এখনো অব্যাহত আছে। ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ১০০ কোটি পাখির পায়ে রিং লাগানো হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে গত বছর থেকে দীর্ঘমেয়াদী গবেষণার কাজ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে শুরম্ন করে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন এ ক্লাবের পাখি নিয়ে গবেষণাধর্মী কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। আগামীতে সিলেটের টাঙ্গুয়া ও পাসুয়াতে পাখি নিয়ে গবেষণা ও রিং পড়ানোর কাজ শুরম্ন হবে বলে জানা গেছে। এ দুটি স্থানে দেশী-বিদেশী ১০ জন পাখি বিশেষজ্ঞ গবেষণা ও রিং পড়ানোর কাজ করবেন।

বাইক্কা বিলে পাখির আধিক্য সম্পর্কে পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক বলেন, ‘বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলে বিপুল পরিমাণ ডুল কলমী গাছ রয়েছে। যেখানে ডুল কলমী গাছ আছে সেখানে বিভিন্ন প্রকার পোকা-কীট পতঙ্গ বসবাস করে। পৃথিবীতে ১০ হাজার জাতের পাখি রয়েছে। এর মধ্যে ৮ হাজার ৭শত জাতের পাখিই পোকা খায়। ফলে ডুল কলমী যেখানে আছে সেখানে পাখিদের মেলা বসে। হাইল হাওরের বাইক্কা বিলে প্রচুর পরিমাণে ডুল কলমী গাছ রয়েছে। তাই বাইক্কা বিলে পাখিদের আনাগোনা বেশি।’ এতো ডুল কলমী গাছ থাকা সত্ত্বেও আগের তুলনায় বাইক্কা বিলে পাখির সংখ্যা কমে যাবার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘হাইল হাওরের বাইক্কা বিলে এক সময় মাইলের পর মাইল ডুল কলমী গাছ ছিল। হাওর পাড়ের মানুষ অজ্ঞতাবশত ডুল কলমী গাছ কেটে শুকিয়ে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করছে। শতকরা ৭৮ শতাংশ পাখিই ডুল কলমী ঝোপের পোকা খেয়ে বেঁচে থাকে। ডুল কলমী না থাকলে পাখিরা ধ্বংশ হয়ে যাবে। তাই যত পরিমাণ ডুল কলমী গাছ কমবে তত পরিমাণ পাখি কমবে।’ তিনি ডুল কলমী গাছ নষ্ট না করার জন্য হাওর পাড়ের বাসিন্দাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/সজলদেব/মৌলভীবাজার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here