দে লো য়া র  জা হি দ ::

চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যখন একটি নতুন শীতল যুদ্ধের ধারণার জন্ম দিচ্ছে, যখন ভারত-চীন সম্পর্ক স্থিতিশীল করতে এবং তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সীমান্তকে শান্ত করার চেষ্টা চলছে, যখন চলছে আঞ্চলিক বিরোধ সমাধানের জন্য ধীরগতির সংলাপ, যখন ভূরাজনীতিতে একটি উত্তেজনাপূর্ণ অচলাবস্থায় ঠিক তখন সমসাময়িক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তিত কাঠামোতে কানাডার মতো দেশ ও বিগত বৈদেশিক নীতি অনুশীলনের কৌশলগত প্রয়োজনীয়তাগুলিকে পুনর্নির্মাণ শুরু করছে। প্রশ্ন হলো, একবিংশ শতাব্দীতে ভূ-অর্থনীতি এবং ক্ষমতার রাজনীতিতে ইকোনমিক স্টেটক্রাফ্টের এ পুনরুজ্জীবনে বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে? আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপর আন্তঃনির্ভরতার কথিত স্থিতিশীল প্রভাবের উপর ভিত্তি করে কোনো ভিত্তিহীন আদর্শবাদের কাছে নতি স্বীকার না করার নীতি বাংলাদেশ । এটি একটি কঠিন কৌশলগত অনুশীলন এবং একটি উদ্ভাবনী ও সময়োপযোগী বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতি যা ভূ-অর্থনীতি সম্পর্কে আমাদের বোঝার পথকে সুগম করবে ।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো চীনের বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। চীন যেভাবে বাণিজ্যিক স্বার্থকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোকে একে অপরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে, তা ঠেকাতেই ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।গত শনিবার প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।…কানাডার প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, চীন পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোকে একে অপরের বিরুদ্ধে ‘খেলাচ্ছে’। চীনের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা প্রত্যাশী পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিযোগিতাকে কাজে লাগানোর অভিযোগ করেছেন .ট্রুডো।…গ্লোবাল টেলিভিশনকে ট্রুডো বলেছেন, ‘আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি আর চীন সময়ে সময়ে মুক্তবাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ উপায়েই খুব চালাকির সঙ্গে আমাদের একে অপরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে খেলছে।’…ট্রুডো আরও বলেন, ‘আমাদের একসঙ্গে কাজ করার জন্য এবং শক্তিশালী হয়ে দাঁড়ানোর জন্য আরও ভালোভাবে কাজ করতে হবে, যাতে চীন কোনো গোপন অভিপ্রায় নিয়ে খেলতে না পারে এবং আমাদের একে অপরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে বিভক্ত না করতে পারে।’(চীনের বিরুদ্ধে ঐক্যের ডাক/প্রথম আলো,  ২৬ ডিসেম্বর ২০২১).

বাংলাদেশের ভূ-রাজনীতিতে, ভারত সবসময়ই কেন্দ্রে থাকে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হয়। চীনের মতো অন্যান্য আঞ্চলিক পরাশক্তি বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী । বাংলাদেশের সাথে ভারতের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সম্পর্ক রয়েছে যা ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল ও গুরুত্বপুর্ণ । যৌথভাবে উপমহাদেশ হিসাবে পরিচিত এ ভারত, পাকিস্তান ও  বাংলাদেশ যদিও ভারতের আধিপত্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং জবরদস্তিমূলক অনেক কৌশল বাংলাদেশকে চীন বলয়ের দিকে ঠেলে দেয় তা স্বত্বেও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে চীনের অহস্তক্ষেপের মডেলের সাথে বাংলাদেশ নিজেকে অনেকটা মানিয়ে নিয়েছে।  কোনো বিকল্প না থাকায় ভারতকে ও তা মেনে নিতে হচ্ছে।

১৯৮২ সালে পিয়েরে ট্রুডো বিশ্বে কানাডার জন্য একটি স্বাধীন পথ অনুসরণ করেছিলেন, বিচ্ছিন্নতাবাদ তার নীতি ছিল না  । তার সরকার কানাডিয়ান সংবিধানকে “দেশপ্রাণ” দিয়ে কানাডার স্বাধীনতার অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করে; দেশের সর্বোচ্চ আইন – সংবিধান – ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কর্তৃত্ব থেকে কানাডার পার্লামেন্টে স্থানান্তর করা ও ছিলো তার স্মরণীয় একটি কাজ । ব্রিটিশ উত্তর আমেরিকা আইন, ঔপনিবেশিক অতীতের একটি অবশিষ্টাংশ, সংবিধান আইন, ১৯৮২তে তা আপডেট করা হয়েছিল। কানাডিয়ান অধিকার ও স্বাধীনতার সনদ এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ট্রুডো একবার ওয়াশিংটন, ডিসি-তে একটি বক্তৃতায়   যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, আমেরিকার সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী হওয়া মানে “একটি হাতির সাথে ঘুমানো…” ট্রুডো আমেরিকান রাষ্ট্রপতিদের বিরক্ত করতে ইচ্ছুক ছিলেন এবং তিনি প্রায় তা করতেন।

২০১৮ সালে কানাডার পুলিশ যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ভিত্তিতে  চীনা কোম্পানি হুয়াওয়ের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকর্তা (সিএফও) মেং ওয়ানঝুকে আটক করার পর থেকেই বেইজিংয়ের সঙ্গে অটোয়ার সম্পর্কে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। চীন বেইজিং পরে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে মাইকেল স্প্যাভর ও মাইকেল কোভরিগ নামের দুই কানাডীয়কে আটক করে। একে কানাডা ‘জিম্মি কূটনীতি’ আখ্যা দিলেও চীন তা উড়িয়ে দেয়। দক্ষিণ এশীয় ভূ-রাজনৈতিক আলোচনায়, বাংলাদেশ-এখন একটি প্রভাবশালী খেলোয়াড়, নিজস্ব যোগ্যতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ বড় ভূ-রাজনৈতিক মূল্য তৈরী করেছে যা ভারত বা অন্য কোনো দেশ থেকে আলাদা। অনেক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক একসময় বাংলাদেশকে  দেখতেন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দারিদ্র্য এবং অতিরিক্ত জনসংখ্যার একটি দেশ হিসেবে। সে দেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সাফল্য বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং সম্প্রতি বাংলাদেশের কৌশলগত তাৎপর্য সম্পর্কে একটি দরকারী অনুস্মারক প্রদান করেছেন তাতে তিনি সতর্ক করেছিলেন যে ঢাকা কোয়াডে যোগ দিলে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটি একটি অনানুষ্ঠানিক গ্রুপ যা বেইজিংকে ভারসাম্যহীন করার লক্ষ্যে কাজ করে বলে ও বেজিং মনে করে।

ভারতের সবচেয়ে বিশ্বস্ত, বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ চীনা বিনিয়োগ নয়াদিল্লিকে অনুভব করায় যে তারা পিছিয়ে যাচ্ছে। সে অনুভব থেকে ভারত ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জন্য $৫ বিলিয়ন ঋণ ঘোষণা করে, যা বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় পরিমাণ।দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে অন্যদিকে চীন ও ভারত উভয়েই বাংলাদেশে বিনিয়োগকে তাদের প্রভাব বিস্তারের উপায় হিসেবে দেখতে চায় । বাংলাদেশ ও এ সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে এবং চীন ও ভারত উভয়কেই ব্যবহার করে তার এফডিআই এর ঘাটতি পূরণ করছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এবং পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদসহ সংস্থাটির ছয়জন বর্তমান ও সাবেক এক শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের অপর এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কমেছে। বোদ্ধামহল মনে করেন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক পরিবেশে যুক্তরাষ্ট্রের যে নেতৃত্ব এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নিরাপত্তা বিষয়ে, বিশেষ করে তাদের সঙ্গে সহযোগিতার যে জায়গা তাকে তারা আরও সমৃদ্ধ করতে চায়।

বাংলাদেশ চীন সম্পর্ক নিয়ে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার অবস্থান এখন খুবই পরিষ্কার। বাংলাদেশকে সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কারো সংগে বৈরীতা নয় তা বজায় রাখাতে হবে। ভবিষ্যত সংকটে বাংলাদেশ যদি চীন বা ভারতের পক্ষ নেয়, বা কূটনৈতিক বা সামরিক যেকোনো ভূমিকা পালন করে, তাহলে এ অঞ্চলের জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী ভূ-রাজনৈতিক পরিণতি হবে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রে ছিল বিশ্ব শান্তির চেতনা বাংলাদেশকে তা সর্বদা সমুন্নত রাখতে হবে।

লেখক : দেলোয়ার জাহিদ, সাবেক রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবা, (সেন্ট পলস কলেজ) কানাডা, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কানাডা ইউনিট কমান্ড নির্বাহী, প্রাবন্ধিক ও রেড ডিয়ার (আলবার্টা) নিবাসী।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here