
৭১ এ নিউইয়র্কের ম্যাডিসন সেন্টারে কনসার্ট ফর বাংলাদেশে গান গাইছেন জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান ও লিওন রাসেল।
রবীন্দ্র নাথ পাল :: ১৯৭১ সন। স্বাধীনতার দাবীতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ডাকে এ দেশের লাখো লাখো সাধারন মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল। আমাদের সেই মহান মুক্তিযুদ্ধে অনেক দেশই আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে সমর্থনতো দেয়ইনি,বরং হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সব ধরনের সমর্থন জুগিয়ে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন নসাৎ করতে চেয়েছিল। কালের বিবর্তনে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিরোধিতাকারীরাই এখন আমাদের বন্ধু। ইতিহাস বলে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকা ও চীন শুধু বিরোধিতাই করেননি, আমরা যেন মুক্তির স্বাদ পেতে না পারি তার জন্য নানাভাবে চক্রান্তে মেতেছিল। এ দুটি দেশের সরকার আমাদের স্বাধীনতা না চাইলেও সাধারন জনগন ছিল আমাদের পক্ষে। এ রকম অনেক ইতিহাস আছে, যা অনেকের জানা, আবার অনেকেরই অজানা।
সম্প্রতি জাতীয় দৈনিকে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক। অর্থাৎ যেই আমেরিকা আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলন স্তব্ধ করতে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে অস্ত্র ও নৈতিক সমর্থন দিয়ে নির্বিচারে বাঙ্গালী হত্যায় মাতলেও সে দেশের জনগন পাক বাহিনীর নির্মম অত্যাচার খুন,ধর্ষণ করে বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। যার ফলে অনেক দেশই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ্য সমর্থন দিয়ে আমাদের স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। ‘বব ডিলান ও দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ ছিল তেমনই একটি অনুষ্ঠান।
আমেরিকা ও চীন আমাদের তীব্র বিরোধিতা করলেও খোদ আমেরিকাতেই আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে জনমত তৈরীর লক্ষো বল ডিলান ১লা আগষ্ট’৭১ নিউ ইয়র্কের, ম্যাডিসন স্কয়ারে অয়োজন করা হয়‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট পণ্ডিত রবিশংকর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বজনমত গড়ে তোলা এবং শরণার্থীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য শিল্পী জর্জ হ্যারিসনকে নিয়ে এই অবিস্মরণীয় কনসাটের্র আয়োজন করেছিলেন। ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন বব ডিলান। কনসার্ট ফর বাংলাদেশে গান গেয়েছেন জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান ও লিওন রাসেল।
গত ৩০ আক্টোবর১৭ইং একটি জাতীয় দৈনিকে শিরোনাম ছিল ‘একাত্তরে ঝড় তোলা সেই গিটার’ নিলামে। ঐ খবরে বলা হয় সাহিত্যে নোবেলজয়ী বল ডিলানের ৭১ এ কনসার্টে যে গিটার দিয়ে স্বাধীনতা কামীদের সপক্ষে যে গিটার বাজিয়েছিলেন সেটি নিলামে তোলা হবে। আগামী ১১ নভেম্বর সেই গিটারটি যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে হেরিটেজ অকশনস সেটি নিলামে তুলবে। আয়োজকদের আশা ১৯৬৩ সালে তৈরী
মার্টিন ডি ২৮ অ্যকিুষ্টিক গিটারটি প্রায় আড়াইকোটি টাকায় বিক্রির সভাবনা রয়েছে। পরে ৭৭ সনে বব ডিলান‘গিবসন’ গিটার বাজানোর সিদ্ধান্ত নেন।ববের গিটারের রক্ষনাবেক্ষন করতেন ল্যারি ক্রেগ। ডিলনের ঐতিহাসিক গিটারটি তিনি ৫শ ডলারে কিনে নেন।১৯৬০ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত বব ডিলান এ গিরাটটি বাজিয়েছেন বব ডিলান। এটির ঐহিহাসিক মুল্য রয়েছে। ল্যারি ক্রেগ বলেন, আমার বয়স হয়েছে।এমন একজন মালিক খুঁজছি যিনি বব ডিলানের মত এটির যতœ নিবেন। কারন এটি বাজিয়েই তিনি কনসার্ট ফর বাংলাদেশ মাতিয়েছিলেন।
প্রথম আলো পত্রিকায় সম্পাদক মতিইর রহমান গত ১৫ই অক্টোবর’১৬ইং বব ডিলান ও দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ শীর্ষক একটি লেখায় বব ডিলান সর্ম্পকে লেখেন , আমরা জানি, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের জন্য তহবিল সংগ্রহে বিশ্বশ্রেষ্ঠ সেতারবাদক রবিশঙ্কর এক অনুষ্ঠান করতে বিটলস গায়ক জর্জ হ্যারিসনকে অনুরোধ করেছিলেন। জর্জ হ্যারিসনও তাঁর অনুরোধে সম্মতি জানান। তবে তাঁকে স্বল্প সময়ের মধ্যেই প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল এই অনুষ্ঠান করতে। অনুষ্ঠানের জন্য ১ আগস্ট ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন খালি পাওয়া যায়। তারপর একদিকে কনসার্টের নানা প্রস্তুতি এবং অন্যদিকে শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়ে যায়।
জর্জ হ্যারিসনের ভাবনায় ছিল যে এই সময়টাই সঠিক। কারণ, প্রতিদিন হাজার হাজার শিশু মারা যাচ্ছিল এবং মার্কিন সরকার পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠাচ্ছিল। জর্জ হ্যারিসন যখন ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তখন বিটলস গ্রুপ ভেঙে গেছে। বিটলসের সহশিল্পীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বস্তিকর ছিল না। তা সত্ত্বেও জর্জ হ্যারিসন আত্মাভিমান ত্যাগ করে সহশিল্পী ও বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। বিটলসের ড্রামার রিঙ্গো স্টার রাজি হয়েছিলেন এককথায়। জনপ্রিয় গায়ক লিওন রাসেল ও বিল প্রেস্টন প্রথম প্রস্তাবেই সম্মতি জানান। এরিক ক্ল্যাপটন প্রস্তাবটি বিবেচনার আশ্বাস দেন। তবে সে সময়ের প্রবল প্রভাবশালী গায়ক বব ডিলান সম্মতি জানাতে সময় নেন।
বলা যায়, প্রায় শেষ সময় পর্যন্ত অনিশ্চয়তা ছিল বব ডিলানের অংশগ্রহণের বিষয়টি। তবে শেষ পর্যন্ত বব ডিলান অংশ নিয়েছিলেন। তাঁকে পেয়ে জর্জ হ্যারিসন আনন্দিত হয়েছিলেন।
জর্জ হ্যারিসনের বই আই-মি-মাইন থেকে জানা যায়, অনুষ্ঠানের আগে সব শিল্পীর পুরো রিহার্সেলও হয়নি। অনুষ্ঠানের আলোর ব্যবস্থা ভালো ছিল না। তথ্যচিত্র ধারণের ব্যবস্থাও পর্যাপ্ত ছিল না। এই সবকিছুর পর অনুষ্ঠানটি এক দিন দুবার হয়েছিল। কারণ, প্রথমটির সব টিকিট দ্রুতই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। জর্জ হ্যারিসন অনুষ্ঠানের হাজার হাজার শ্রোতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে শুরুতেই বলেন, ‘ভারতীয় সংগীত আমাদের চেয়ে অনেক গভীর।’ তারপর পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আলী আকবর খান ও সহশিল্পীদের পরিচয় করিয়ে দেন।
কনসার্টের শুরুতে পণ্ডিত রবিশঙ্কর বলেন, ‘প্রথম ভাগে ভারতীয় সংগীত থাকবে। এর জন্য কিছু মনোনিবেশ দরকার। পরে আপনারা প্রিয় শিল্পীদের গান শুনবেন। আমাদের বাদনে শুধু সুর নয়, এতে বাণী আছে। আমরা শিল্পী, রাজনীতিক নই। বাংলাদেশে অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশের পলীগীতির সুরের ভিত্তিতে আমরা বাজাব “বাংলা ধুন”।’ দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশের বড় আকর্ষণ ছিলেন বব ডিলান আর জর্জ হ্যারিসন। সে অনুষ্ঠানে বব ডিলান পাঁচটি গান গেয়েছিলেন। বব ডিলানের জনপ্রিয় গানগুলো শুনতে পেরে দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল।
তাঁর গানগুলো ছিল: ১. আ হার্ড রেইনস গনা ফল ২. ইট টেকস আ লট টু লাফ/ইট টেকস আ ট্রেন টু ক্রাই ৩. ব্লোইন ইন দ্য উইন্ড ৪. মি. টাম্বুরিন ম্যান এবং ৫. জাস্ট লাইক আ ওম্যান। প্রতিটি গানের সঙ্গে বব ডিলান অ্যাকুস্টিক গিটার ও হারমোনিকা বাজিয়েছিলেন। আর প্রতিটি গানের সঙ্গে জর্জ হ্যারিসন ইলেকট্রিক গিটার বাজান। বিটলসের আরেক সদস্য রিঙ্গো স্টার বাজিয়েছেন টাম্বুরিন। আর প্রতিটি গানের সঙ্গে বাস নিয়ে সঙ্গী ছিলেন লিওন রাসেল।
তবে বব ডিলানের শেষ গানটিতে কণ্ঠ দিয়ে সঙ্গী হয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন ও লিওন রাসেল। দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশের বব ডিলানের পাঁচটি গানই লং প্লেয়িং (এলপি) রেকর্ড ও বিশেষভাবে সিডিতে পাওয়া যায়। তবে ২০০৫ সালে নতুন করে প্রকাশিত দুটি ডিভিডিতে বব ডিলানের গান রয়েছে চারটি। শুধু ‘মি. টাম্বুরিন ম্যান’ গানটি নেই। ২০০৫ সালে পুনঃপ্রচারিত দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ ডিভিডি প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত পুস্তিকায় ইউএসএ ফান্ড ফর ইউনিসেফের সভাপতি চার্লস জে লিওনসের লেখা থেকে জানা যায়, কনসার্টের টিকিট বিক্রি থেকে সংগ্রহ হয়েছিল প্রায় আড়াই লাখ ডলার।
দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশের আয়োজন আর সংগীত আজও বিশ্বব্যাপী আলোচিত ও প্রচারিত। বব ডিলানের জন্ম ১৯৪১ সনের ২৪শে মে। তার পুরো নাম রবার্ট অ্যালেন জিমমারম্যান। ১৯৬০ সন থেকে তিনি নিয়মিত গান গেয়ে আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় গায়ক হিসেবে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘ ৫ দশক সেই সুনাম অক্ষুন্ন রয়েছে। তার গনগুলোতে রাজনৈতিক, সামাজিক, দার্শনিক,অংকন এবং সাহিত্য প্রভাব বিস্তৃত। একজন সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে ডিলান ১০০ মিলিয়নের বেশি রেকর্ড বিক্রি করে,তাকে সর্বকালের সেরা বিক্রি শিল্পীদের মধ্যে একজন করে তোলে। বব ডিলান এগারো গ্র্যামী অ্যাওয়ার্ডস,একটি গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার, একটি একাডেমী পুরস্কার সহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন।
২০০৮ সনে পুলিৎজার পুরস্কার,২০১২ সনে রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা থেকে রাষ্ট্রপতি পদক পেয়েছেন। ঐ সনেই ডিলান সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। ২০০৫ সালে নতুন করে ডিভিডির বিক্রি থেকে অর্থ সংগ্রহ করে দ্য জর্জ হ্যারিসন ফান্ড ফর ইউনিসেফ, যা হ্যারিসন পরিবার ও ইউএস ফান্ড ফর ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিশুদের জরুরি স্বাস্থ্য বিষয়ে সহায়তা দান করছে। এই ‘জর্জ হ্যারিসন ফান্ড ফর ইউনিসেফ’-এর প্রতিষ্ঠাতা জর্জের স্ত্রী অলিভিয়া হ্যারিসন ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিন দিনের জন্য ঢাকায় এসেছিলেন।
তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন, ওই কনসার্ট করতে গিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটা গভীর আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল জর্জ হ্যারিসনের। অলিভিয়া হ্যারিসন ঢাকায় অবস্থানকালে ইউনিসেফের সহযোগিতায় যেসব কাজ চলছে, সেগুলো দেখতে এসেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে শিশুদের জন্য কিছু কর্মসূচি চলে জর্জ হ্যারিসন ফান্ডের সহায়তায়। আরও কিছু কাজ নিয়েও তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল ঢাকার ইউনিসেফের অফিসের সঙ্গে। আসলেই, ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সংগৃহীত তহবিলের কাজ এখন চলছে বাংলাদেশে।
এটা বড় এক অনুপ্রেরণা। সে জন্যই আমরা আজ বিশেষভাবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বব ডিলানকে স্মরণ করছি। একই সঙ্গে স্মরণ করছি পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনকে। বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে তাঁরা অমর। অমর বব ডিলানের একাত্তরের সেই গিটারটি ১১ নভেম্বর নিলামে উঠবে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মুত্তিযুদ্ধ জাদুঘর অমর এ শিল্পীর গিটারটি ক্রয় করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে নিয়ে আসা হোক। সন্মান দেয়া হোক আমাদের আপনজন বব ডিলানকে।
৫/১১/১৭ইং
লেখক : রবীন্দ্র নাথ পাল, নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আজকের বাংলাদেশ, ময়মনসিংহ ও নির্বাহী সদস্য বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন(বিএফইজে)০১৭১৩-৮১৯২৯৪