ফেসবুক বিহীন ক’টি দিন: যেন এক বিরান ভূমিতাহমিনা শিল্পী :: “কোন কোনদিন বাজানের সঙ্গে হাট হইতে ইলিশ মাছ কিনিয়া বাড়ি ফিরিতাম। পথে ফিরিতে যাহার সঙ্গে দেখা হইত, সেই মাছের দাম জিজ্ঞাসা করিত। দাম শুনিয়া কেহ কেহ বলিত, মাছটি বেশ জিতিয়া কিনিয়াছেন। আমার খুব ভাল লাগিত। এখনও দেশে যাইয়া মাঝে মাঝে বাজার হইতে ইলিশ মাছ হাতে ঝুলাইয়া বাড়ি ফিরি। যে দেখে দাম জিজ্ঞাসা করে। উত্তর দিতে আমার তেমনই ভাল লাগে”।

যারা ফরিদপুরে কবি জসীম উদ্দীনের পৈত্রিক বাড়িতে গিয়েছেন, তারা নিশ্চই কবির বাড়ির কাচারী ঘরের (বসার ঘর বা বৈঠকখানা) দেয়ালে টানানো এই লেখাটি দেখেছেন! আর যারা এখনও যাননি তারাও হয়তবা বিষয়টি অনুমান করতে পারছেন।

জসীম উদ্দীন ১৯৬৪ সালের কোন একদিন তাঁর নিজস্ব অনুভুতি এভাবেই প্রকাশ করেছিলেন এবং তিনি এটাও চেয়েছিলেন যে তাঁর এই অনুভুতি সবাই জানুক। তাই তিনি ছবি ফ্রেমে লেখাটি বাঁধাই করে কাচারী ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন।

ভেবে দেখুন সেই তখনও মানুষ চাইত, তার অনুভুতি, অবস্থা এবং অবস্থান প্রিয় মানুষ, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদেরকে জানাতে। যেহেতু মানুষ সামাজিক জীব। তাই এই চাওয়াটা মানুষের ন্যায্য অধিকার। যাহোক প্রযুক্তির অতোটা উন্নয়ন তখনও হয়নি বলে হয়তবা তখনকার মানুষ তাৎক্ষনিক জানাতে পারতেন না। তবে দেরী হলেও জানানোর কোন না কোন উপায় কিন্তু তারা ঠিকই বের করে নিয়েছিলেন। যারা কাছাকাছি অবস্থান করতেন তদের সাথে গল্পের ছলে। আর যাদের অবস্থান দূরে তাদের কাছে চিঠি লিখে অনুভুতি প্রকাশ করতেন এবং তথ্য পাঠাতেন।

তবে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে তথ্য প্রযুক্তির আধুনিকায়নের ফলে আমরা আজ আমাদের অনুভুতি, অবস্থা এবং অবস্থান প্রিয় মানুষ, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদেরকে তাৎক্ষনিক জানাতে পারছি এবং প্রয়োজনীয় তথ্যও দ্রুত আদান প্রদান করতে পারছি। সেইসব আধুনিক প্রচলিত এবং জনপ্রিয় মাধ্যমগুলো হচ্ছে-ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ভাইভার, টুইটার, স্কাইপি এবং হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি।

সামাজিক জীব হিসাবে মানুষ সঙ্গী ছাড়া চলতে পারেনা। তাই তার প্রয়োজন হয় বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও প্রিয় মানুষদের সঙ্গ এবং তাদের সাথে নিয়মিত তথ্য ও ভাবের আদান-প্রদান এবং প্রয়োজন হয় দেশ ও বহির্বিশ্বের সাম্প্রতিক খবরা খবর জানা।

মৌলিক চাহিদা না হলেও এটা মানুষের সামাজিক ও মানবিক চাহিদা বলেই বিবেচিত। কিন্তু বর্তমানকালের ব্যাস্ততা ও সময়ের অভাবে সকলের পক্ষে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়ে উঠেনা। কিন্তু এই ব্যাস্ততম সময়ের ফাঁকে যারা স্বল্প সময় বের করে একটু ফেসবুকে ঢু মারতেন। তারা কিন্তু এখানেই আড্ডা, যোগাযোগ, আদান-প্রদা্নের সব চাহিদাই পুরন করতেন।

সম্প্রতি আমাদের দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারী নির্দেশে বিটিআরসি ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ভাইভার, টুইটার এবং হোয়াটসঅ্যাপ এই চারটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখার ঘোষনা দিয়েছে। তাতে করে এই মাধ্যমগুলো ব্যাবহারকারীসহ সকল শ্রেনী পেশার মানুষদের মধ্যে নানান ধরনের জনমত তৈরী হয়েছে।

এসকল জনমতের মধ্যে এই সিদ্ধান্তের প্রতি নেতিবাচক মতামতের সংখ্যাই বেশী। তবে মানুষ আগেও যেমন বিকল্প পথ খুঁজে বের করত। এখনো কিন্তু তেমনভাবেই বিকল্প উপায় খুঁজে বের করে ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার ব্যবহার অব্যাহত রাখছে এবং আস্তে আস্তে ব্যবহারকারীর সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলছে। এতে করে দেশের নিরাপত্তার কোনপ্রকার ব্যঘাত ঘটছে কিনা তা না বুঝতে পারলেও এটা কিন্তু পরিষ্কার যে, এই সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো দেশবাসীর কাছে কতোটা প্রয়োজনীয় এবং জনপ্রিয়। যারা বিকল্প উপায়ে ফেসবুকে আসতে পারছেন তাদের কিছু স্টাটাস দেখলেই এর সত্যতা নিশ্চিত ভাবে বোঝা যাবে। যেমনঃ-

“এক চিলতে জমি ছিলো আমার নিষ্কন্টক, যা কেবলই নিজের। বুনন করছিলাম সুন্দরের কিছু চারা। বিশ্বাস আর ভালবাসায় পরিচর্যার ছিল না কোন কমতি; হঠাৎ দানবীয় অবিশ্বাসের ঝড়ে এসে তছনছ করে দিল আমার সুন্দরের বাগান। অনেক কাঠখড় ব্যয় করে, ঘুরপথে আবার ফিরে পেলাম সেই জমিটুকুত। কিন্তু হায় এখন আমি এই বিরান ভূমিতে একা দাড়িয়ে, নিকট অতীতকে মনে করি”।

“শেষ পর্যন্ত ফেসবুকে আসতে পারলাম। ফেসবুকে এসে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। মনে হচ্ছে এখানে সেখানে ঘুরে বহুদিন পর নিজের বাড়িতে আসা গেলো। কিন্তু খালি খালি লাগছে। এ বাড়ির কারা কারা যেন কোথায় কোথায় বেড়াতে গেছে”।

“yaaaa hoo… Facebook চালাইতে পারা টা এখন ঈদ এর মত”। “FB ছাড়া কি থাকা যায় …? কারন FB ছাড়া Life ! Impassable”। “w00w man i m in Fb …… so সরকার যতই জাল পাতুক আমরা …… অনেক Smart ….. বন্ধুরা জ্বলে ওঠো আপন শক্তিতে …….” “মার্ক জুকার্বার্গ এর কপালে সবার পক্ষ থেকে চুমো…..”

এইরকম আরও কতো কি! আহা! সবটাই বুঝি প্রাণের আবেগ ঝরে পড়ছে। মন্তব্যের ক্ষেত্রেও কিন্তু নানা মতভেদ লক্ষ্য করা গেছে। যেমনঃ

“ভাই বাংলাদেশে আরো কতো কিছু দেখবেন এখোন তো fb off আরো কতো কিছু off হবে দেশটাতো আমাদের না দেশটা সরকারের”।

“সরকার এর দোষ দিয়া লাভ নাই ভাই …… আমরা ই ভাল না … আমরা অন্যায় এর প্রতিবাদ করতে পারি না …… মনে রাখবেন যে দেশের জনগন যেমন সাই দেশের সরকার ও তেমন হয় …… তাই আমরা যতদিন অনায় এর প্রতিবাদ করতে পারব না তত দিন এই দেশের পরিবরতন ও হবে না…”।

“তবে কি জানেনতো, ফিরে আসতে পারার আনন্দ প্রকাশের চেয়ে সামাজিক যোগাযোগের স্বাধীনতা হরন বিষয়ক ভাবনার প্রকাশটা জরুরি ছিল। তাই নয় কি?”

“সবার ক্ষেত্রে কার্যকর হলে কিন্তু কোন কথাই ছিলনা। স্বয়ং মন্ত্রীগণ, বিটিআরসির শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তা এবং আওয়ামীলীগ এর এফবি পেজে একটু পরপর আপডেট দেখলে কেউ বুঝতেই পারবেনা যে এই মাধ্যমগুলো দেশের সার্থে বন্ধ করা হয়েছে”।

“ফেসবুক, ভাইবার ও হোয়াটসঅ্যাপ নিয়ন্ত্রণের চেয়ে প্রস্তাবনামত বাংলাদেশকে ৯টি বিভাগে বিভক্ত করা হলে সন্ত্রাসবাদ,-জঙ্গীবাদ থেকে জনগণকে বেশী রক্ষা করা হতো এবং সরকারের জনসমর্থনও বাড়তো……”

এসবই হচ্ছে সকলের অভিমান আর সাময়িক ক্ষোভের প্রকাশ। ডিজিটাল যুগে এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়া প্রতিযোগিদের এই সময়ে সবার পক্ষেই চলা সত্যিই অসম্ভব। একবার প্রযুক্তির ছোঁয়া পেয়ে ফের পিছিনে ফিরে যাওয়া যায়না। তবে এই মাধ্যমগুলোকে কেউ কেউ কিম্বা কোন কোন সংগঠন ব্যবহার করে অপরাধমূলক কর্মকান্ড করছে এটা যেমন ঠিক, তেমনই আবার এইসব মাধ্যমের কারনেই অনেক অপরাধীকে সনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে এটাও কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না।

তবে সামাজিক বহল প্রচলিত ও সাধারন জনগনের চাহিদা ভিত্তিক এই যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গীবাদ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় নিশ্চই নয়। বাংলাদেশ সরকারের রয়েছে শক্তিশালী প্রশাসন এবং দেশের অনেক ইন্টেলিজেন্ট, স্পেশাল এবং জিনিয়াস লোক ও সংগঠন। যারা এই মাধ্যমগুলো বন্ধ না রেখেও সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গীবাদসহ যেকোন অপরাধ থেকে দেশ ও দেশের জনগনকে রক্ষা করার বিকল্প, অধিক কার্যকর ও ফুলপ্রসু উপায় বের করতে পারবে বলেই সবার বিশ্বাস। ততোদিন সবার শুধু একটু অপেক্ষায় থাকা।

লেখক: একজন গণমাধ্যম কর্মী, ইমেইল- tahmina_shilpi@yahoo.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here