আরিফ চৌধুরী শুভ :: হারিয়েছি না হেরে গেছি আমরা? আ্যাম্বুলেন্স চলছে সারেইন বাজিয়ে। নি:স্তব্দ আ্যাম্বুলেন্সের ভেতর শুয়ে আছেন স্যার। কারো মুখে কোন কথা নেই। আ্যাম্বুলেন্সের সারেইনের শব্দটাই শুধু কানে আসছে। চোখ ভিজে যাচ্ছে সহস্র স্মৃতি আর মায়াভরা সেই দিনগুলো ভেবে। মনে হচ্ছে এইতো সেদিনই মাটির আইল ভেঙ্গে ভেঙ্গে রোদ বৃষ্টি ঝড় উপেক্ষা করে, কালো ছাতা হাতে স্যার আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে স্কুলে যাচ্ছেন। কি নি:শব্দ সেই হাঁটা।

আমি অপেক্ষায় থাকতাম স্যার কখন আসবেন, আমাকে নাম ধরে ডাকবেন ‘আরিফ স্কুল যাবে না?’ সব স্যারেরা কি শিক্ষার্থীদের এমন মায়াভরা কণ্ঠে ডাকেন?

স্কুল ছুটির আগে সব ক্লাসে স্যার নামতা পড়াতে বলতেন আমাকে। এই কাজটি করতে আমি যেমন আনন্দ পেতাম তেমনি আমার হাতে দায়িত্ব দিয়ে স্যারও নিশ্চিন্ত থাকতেন। শিক্ষার্থীদের সমসুরে নামতার শব্দ শুনে মা বাড়ি থেকেই বুঝতে পারতেন, স্কুল ছুটির সময় হয়েছে। ছেলে আসবে। খেতে দিতে হবে। রান্না বসাতে হবে।

আমাদের গঞ্জের বাজারে কোন হোটেল ছিল না দুপুরে খাবারের জন্য। দুপুরবেলায় আমরা সবাই কিছু না কিছু খেতে পারলেও সারাদিন কলা রুটি খেয়েই স্যারকে থাকতে হতো।স্যারের খাবারের সমস্যার কথা মাকে বাড়ি ফিরে বললে মা স্যারের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেন। যতদিন আমি এবং পরবর্তীতে আমার ছোটবোন ফরাশগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম, ততদিনই মা দুপুরের খাবার রান্না করে রাখতেন স্যারের জন্যে। স্যার আমাকে লেইজারের ১০ মিনিট আগে ছেড়ে দিতেন। আমি বাড়ি এসে স্যারের জন্যে খাবার নিয়ে যেতাম। খাবার যত খারাপই হতো না কেন, খেয়ে একটা মায়ামাখা হাসি দিতেন। এটাই ছিল তৃপ্তি। কোনদিন ভাত একটু বেশি সিদ্ধ হলে স্যার মজা করে বলতেন, আজ বুজি তোর মা ধান সিদ্ধ করেছে বাড়িতে। সত্যি তাই হতো।

আমরা প্রাইমারি পড়া শেষ করার পরে স্যারের দুপুরের খাবারে যতেষ্ঠ অনিয়ম হয়ে যায়। স্যারের খাবারের প্রতি গ্রামের আর কোন পরিবার খেয়াল রাখেননি। আবারো সেই কলা রুটিতে স্যারের দুপুরের লাঞ্চ হতো। খাবারের অনিয়মের কারণে স্যারের শরীরে লিভার সিরোসিসের মতো কঠিন রোগ বাসা বাঁধে ধীরে ধীরে। আহ! কি যুদ্ধই না করলেন মৃত্যুর সাথে। হাসপাতালের বিচানায় স্যারের কন্টকশষ্যাময় পরিস্থিতি নিজ চোখে দেখে মনে হলো, একদিন মৃত্যুবরণ করার জন্যে মানুষ কতোদিন বাঁচে! আহা জীবন!

সারাদিন ক্লাস শেষ করে স্যার ৬ টা পর্যন্ত পড়াতেন পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষার্থীদের। এর জন্য কোন টাকা নিতেন না। তাদের একটু আলাদা কেয়ার করতেন স্কুলটি থেকে যেন অন্তত একজন শিক্ষার্থী হলেও বৃত্তি লাভ করতে পারে। আমাদের ইউনিয়নের গ্রাম্য স্কুলগুলোকে কেউ গোনায় ধরতো না। সুতরাং বৃত্তি ছিল সোনার হরিণ। স্যার এই সোনার হরিণটি ধরার চেষ্টা করতেন আমাদের মতো বর্ণমালা জানা শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করার মাধ্যমে। ১৯৭২ সালে এই স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকে স্যার আসার আগ পর্যন্ত কোন বৃত্তি পায়নি কোন শিক্ষার্থী। স্যারের পরিশ্রম  বৃথা যেতে দেইনি আমরা। আমি 2001 সালে প্রাথমিক বৃত্তিপরীক্ষায় কুমিল্লা অঞ্চলে প্রথম হয়েছি। আমার ফলাফল দেখে স্যার সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছেন। একজন নি:স্বার্থবান শিক্ষকের এমন অর্থহীন ভালোবাসায় দেখে সেদিন থেকেই আমার প্রিয় শিক্ষকের স্থানটি দখল করে আছেন শহিদ উদ্দিন মাস্টার। আপনাদের কি আছে আমার মতো এমন কোন স্মৃতি গর্ব করে বলার মতো?

শহর থেকে বৃত্তির ফলাফল নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে স্যার সেদিন আমাদের বাড়িতে এসে বৃত্তি পাওয়ার খবরটি দিয়েছেন আমাদের পরিবারকে। আমার জীবনে সফলতার গল্প অনেক। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমি হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের সাথে ট্যালেন্ট হান্ট প্রতিযোগীতা করে সেরা পাবলিক স্পিকার হিসেবে ক্যাম্পাস স্টারও হয়েছি, কিন্তু জীবনে আর কোন দিন কোন শিক্ষকে আমার সাফল্যে কাঁদতে দেখিনি। এভাবেই আমাদের প্রাথমিক স্কুলটিকে প্রায় অর্ধশতাধিক বৃত্তি উপহার দিয়েছেন স্যার নিজ হাতে। নিজের জীবনের সবটুকু সময় দিয়ে দিলেন একটি গ্রামকে আলোকিত করার জন্যে। ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ ছিল না স্যারের। শুধুমাত্র স্যারের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ফলেই স্কুলটি ডি ক্যাটাগরি থেকে এ ক্যাটাগরির স্কুলের মর্যাদা লাভ করলো।

কিন্তু স্যার কখনো  কোন পদক কিংবা বিশেষ সম্মাননা পাননি। শেষ বিদায়ের বেলায় যদি এমন শিষক্ষকদের রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় বিদায় দিতে পারতাম আমরা, তাহলে তাঁদের ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করা হতো বলে মনে করি।

স্যারের জন্য আজ আকাশটাও অঝোরে কাঁদছে। বহুদিন পরে আজ স্যার আবার সেই স্কুলের মাঠে যাবেন। আমরা স্যারকে বিদায় দিবো সেখানে দাঁড়িয়ে, যেখানে দাঁড়িয়ে স্যারের সাথে আমরা একসাথে জাতীয় সঙ্গিত গাইতাম আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি…। স্যার আপনাকে কোনদিন বলা হয়নি সত্যি আমি/আমরা আপনাকে কতটা ভালোবাসি।

জানি আপনি আর আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না, কিন্তু মনকে বুঝাতে পারছি না, আমরা কি আজ হারিয়েছি না হেরে গেছি? এ বিদায় মেনে নেওয়াটা সত্যি অনেক কষ্টের। কিন্তু প্রকৃতি ডাকলে কার সাধ্য আছে তা উপেক্ষা করার?

একদিন আমরাও চলে যাবো স্যারের মতো করে, কিন্তু এই সমাজ, এই রাষ্ট্র কি এমন মাটির সন্তানদের ঋণ মনে রাখতে পারবে? এই উশৃঙ্খল সমাজে আজ এমন শিক্ষকদেরই খুব বেশি প্রয়োজন।

আমাদের কোন ভুল হলে ক্ষমা করুন স্যার। ২০১৮ সালের আজকের এই দিনে আপনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আজ 2 বছর হতে চললো। আপনার অনুউপস্থিতি সত্যি অপূরণীয়। আপনার আত্মার শান্তি কামনা করছি।

 

 

লেখক: শিক্ষার্থী (মাস্টার্স), আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ডিপার্টমেন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। উদ্যোক্তা ও অন্যতম সংগঠক, নো ভ্যাট অন এডুকেশন আন্দোলন। প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, জাতীয় পাঠাগার আন্দোলন।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here