কলিট তালুকদার, পাবনা

কাজির হিসেবের খাতায় আছে, গোয়ালে নেই। এই রূপ অবস’া পদ্মা নদীর। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পদ্মা নদীর পানি বন্ঠন চুক্তি  ১৫ বছর পার করে গত ১ জানুয়ারি ১৬ বছরে পড়েছে। কিন’ এই দীর্ঘ সময়েও পানির ন্যায্য হিস্যা  থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। চুক্তির পর থেকে প্রতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে চলে পানি পরিমাপ কার্যাক্রম। এ বছরও ১ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন গঙ্গার পানি পরিমাপ শুরু করেছে যা চলবে আগামী ৩১ মে পর্যন-।

গত ১ জানুয়ারি বিকালে পাবনার ঈশ্বরদীর পাকশী পদ্মা নদীর হার্ডিঞ্জ সেতু পয়েন্টে এ কাজ শুরু হয়। ওইদিন ভারত- বাংলাদেশের ৫ সদস্যের একটি পর্যবেক্ষক দল পাকশী ও ভেড়ামারার বিভিন্ন পয়েন্টে পানি পরিমাপ করেন। এই দলে ছিলেন ভারত সরকারের পানি কমিশনের ডেপুটি ডিরেক্টর ভবগত জাদব, এ্যসিস্টেন্ট ডিরেক্টর অনিল কুমার ভার্মা । আর বাংলাদেশের পক্ষে উত্তরাঞ্চলীয় পানি পরিমাপ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ধীরেন্দ্র নাথ সরকার, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী এসএম আলী মর্তুজা ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোফাজ্জল হোসেন ।

সুত্র মতে, বাংলাদেশ- ভারত পানি চুক্তির ১৫ বছরেও চুক্তি অনুযায়ী পানি পায়নি বাংলাদেশ। এবারও বাংলাদেশ পদ্মা নদীর পানি ৮-১০ হাজার কিউসেক কম পেয়েছে।  ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে পদ্মা গড়াই নদীসহ বাংলাদেশের ১৮টি নদী পানি শূন্য হয়ে পড়েছে। পদ্মা নদীতে এখন শুধু ধু-ধু বালুর চর। পানিহীন পদ্মা নদীর বালুর বুকে হার্ডিঞ্জ ব্রীজের ১১টি স্প্যান দাঁড়িয়ে আছে। বৃহত্তর কুষ্টিয়ায় পানির অভাবে কৃষি আবাদে দেখা দিয়েছে বিপত্তি। পাবনা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, মাগুড়া ও যশোর জেলার ১৩টি উপজেলার ১ লাখ ১৬ হাজার হেক্টর জমির কৃষি আবাদ হুমকির মুখে পতিত হয়েছে।

পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী কবিবুর রহমান জানান, ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পদ্মাপানি (গঙ্গা নদী) চুক্তি অনুযায়ী জানুয়ারির প্রথম দিন থেকে মে মাসের শেষ দিন পর্যন- ভারত ফারাক্কা পয়েন্টে এই চলি−শ বছরের গড় হারে বাংলাদেশ পানি পাওয়ার কথা। এছাড়াও শুষ্ক মৌসুমে প্রতি সেকেন্ডে ৩৫ হাজার ঘনফুট পানি প্রবাহের কথা রয়েছে।

বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলকে মুরুকরণের হাত থেকে রক্ষার জন্য ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের সাথে বাংলাদেশের ৩০ বছরের পানি চুক্তি হয়। সে সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেব গৌড়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে হায়দারাবাদ হাউজে বাংলাদেশের জন্য পানি প্রাপ্তির কোন গ্যারান্টি ক্লজ ছাড়াই ৩০ শালা পানি চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশকে ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন- ৩৬ হাজার কিউসেক পানি দেয়ার কথা। কিন’ থাকলে কি হবে; পানি চুক্তির ১৫ বছর অতিক্রম করলেও বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা কোন দিনই পায়নি।  দু’দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকেই ভারত বাংলাদেশকে কম পানি দিয়ে আসছে। পানির অভাবে হার্ডিঞ্জ ব্রীজ ও লালন শাহ সেতুর নিচে জেগে উঠেছে বিশাল চর। পানি শূন্যতার কারণে চাষাবাদসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মরুময়তা দেখা দিয়েছে।

পাবনা জনস্বাস’্য প্রকৌশল বিভাগ ও পানি উন্নয়নবোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, ভূগর্ভস’ পানির স-র প্রায় ৮০ ফুট  নিচে নেমে গেছে। নলকূপে পানি পাচ্ছে না। বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কৃষি আবাদে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এতে সেচ প্রকল্পের অধীনে ১ লাখ ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে কৃষি আবাদে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যে পাবনা জেলাসহ ৫ জেলায় মরুকণন দেখা দিয়েছে।

পদ্মা নদীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানি কমতে কমতে পদ্মা এখন শীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ১৫টি পিলারের মধ্যে ১১টি পিলারের নিচে পানি নেই। পানি শুকিয়ে নদীতে জেগে উঠেছে ছোট বড় অসংখ্য চর। আর সেই বালু চরে চলছে চাষ আবাদ। ধু ধু বালুচরের একপাশ দিয়ে স্রোতহীন পদ্মার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মার শাখা উপশাখা নদীগুলোর অবস’া আরো ভয়াবহ। পদ্মা নদীর বাস-ব অবস’া পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমিশনের (জে আরসি) ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পয়েন্টে পানি পর্যবেক্ষণ করছেন। এই প্রতিনিধি দল আগামী মে মাস পর্যন- অবস’ান করে হার্ডিঞ্জ ব্রীজের নিকট পদ্মা নদীর পানি পর্যবেক্ষণ করবেন।

জানা গেছে, পানি চুক্তির ১৬ বছর চলছে। প্রথম মাসের প্রথম সপ্তাহে গড়ে প্রতিদিন ৬৭ হাজার ৬৫০ কিউসেক পানি পাওয়ার কথা রয়েছে। কিন-ু চুক্তি অনুযায়ী পানি পাচ্ছে না বাংলাদেশ। তারা উপাত্ত সংগ্রহ করে ঢাকায় জেআরসি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে। ভারতের প্রতিনিধি দলের মত বাংলাদেশের ৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ভারতের ফারাক্কা বাঁধ এলাকায় পানি প্রবাহ পর্যবেক্ষন করছেন । তবে তাদের দাবি এবার বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা অনুযায়ী পানি পাবে।
অপর একটি সূত্র মতে, বাংলাদেশ-ভারতের পানি চুক্তির ১৬ তম বছরের প্রথম সাইকেল গত ১০ জানুয়ারি অতিক্রম  করেছে। ১ থেকে ১০ জানুয়ারি প্রথম সাইকেলে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পদ্মার পানির স্তর কমেছে প্রায় ৮-১০ হাজার কিউসেক। এখানে ১ জানুয়ারিতে পানির স-র ছিল প্রায় আট মিটার। ১০ জানুয়ারি বিকালে একই পয়েন্টে পানির স-র মাত্র চার মিটারে এসে দাঁড়িয়েছে বলে সংশি−ষ্ট সূত্র দাবি করছে। ১০ দিনের প্রথম সাইকেল পরিমাপের শেষদিনে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ থেকে ১০ হাজার মিটার ভাটিতে ভারত-বাংলাদেশ পানি পর্যবেক্ষণ টিম পানির প্রবাহ ও পানির স-র পরিমাপ করে। পরিমাপ অনুযায়ী এবারও বাংলাদেশ পদ্মা নদীর পানি ৮-১০ হাজার কিউসেক কম পেয়েছে।

পরিমাপ দলের সদস্য মোফাজ্জল হোসেন জানান, আগামী ৩১ মে পর্যন- পর্যায়ক্রমে এই পানি পরিমাপ কার্যক্রম চলবে। তবে পানি চুক্তি করেও বাংলাদেশের কোন লাভ হয়নি। পানি চুক্তির ১৫ বছর অতিক্রম করলেও পানির ন্যায্য হিস্যা পায়নি বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে ভারতের তাঁবেদারী আওয়ামী সরকার ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারনে হিস্যামতে পদ্মা নদীতে পানি না পাওয়ায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল মরুময়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে।

অপর একটি সূত্র জানায়, ৩০ বছরের পানি চুক্তি ১ জানুয়ারি ১৬বছরে পার দিয়েছে। এ বছরের প্রথম সাইকেলেই প্রায় ১০ হাজার কিউসেক পানি কম পেয়েছে ।

যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) এ টিমে আরও ছিলেন ভারতীয় পানি ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের দুই সদস্য । তারা হলেন ভারতীয় পানি কমিশনের উপ-পরিচালক শ্যাম নারায়ণ সিং ও সহকারী পরিচালক সুনিল কুমার সিনহা। অন্যদিকে বাংলাদেশের তিন সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলীয় ওয়াটার হাইড্রলজি বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কবিবুর রহমান।

হাইড্রলজি বিভাগ সূত্র জানায়, দুই সদস্যের ভারতীয় টিম ৫০ দিনব্যাপী পর্যায়ক্রমে পদ্মার পানি পর্যবেক্ষণ করবে। ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন- শুষ্ক মওসুম। প্রতি ১০ দিনকে একটি ব−ক বা সাইকেল হিসেবে ধরা হয়। আর প্রতি ৩০ দিনকে তিনটি চক্রে ভাগ করা হয়েছে। চুক্তির ১৬ বছরের প্রথম সাইকেলে গত ১০ দিনে কী পরিমাণ পানি দিয়েছে তা হাইড্রলজি বিভাগ এখনো জানাতে পারেনি।

চুক্তির প্রথম বছর অর্থাৎ ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির স-র ছিল সাত দশমিক ২৫০ মিটার। এ পয়েন্টে প্রতি বছর পানির স-র কমে আসছে। শুষ্ক মওসুমে পানির স-র তিন মিটারে নেমে আসে। আশঙ্কাজনক হারে পদ্মায় পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় পাবনার ২০-২৫টি নদী ইতোমধ্যে তার নাব্যতা হারিয়েছে। চুক্তির প্রথম বছরে ১ থেকে ১০ জানুয়ারি সাইকেলে বাংলাদেশের পানি পাওয়ার প্রাপ্যতা ছিল ৬৭ হাজার ৫১৬ কিউসেক। সেখানে পাওয়া যায় ৭০ হাজার ১২২ কিউসেক।

শর্তানুযায়ী চুক্তির প্রথম বছরের প্রথম সাইকেলে পানি পাওয়া কিছুটা বেশি হলেও পরে ভারত বাংলাদেশকে এক তরফা পানি কম দিয়ে আসছে । গত বছরের জুলাই মাসে পদ্মায় পানির স-র ছিল সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৮০ মিটার।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, হিমালয়ের বরফগলা পানিতে গঙ্গা নদীর অববাহিকার আয়তন ৮ লাখ ৬১ হাজার ৪০৪ বর্গ কিলোমিটার। পদ্মা থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রজেক্টে পানির জোগান প্রতি বছর দাঁড়ায় ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনমিটার। পানি প্রবাহের হার ৪ লাখ ৪২ হাজার ১৭০ ঘনমিটার প্রতি ২ কিলোমিটারে। ২ হাজার ৫২৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের গঙ্গা নদীর অববাহিকায় ভারত ১ কোটি ৩০ লাখ হেক্টর জমিতে সেচের ব্যবস’া করেছে। অন্যদিকে দেশের বৃহত্তম গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে প্রজেক্ট) সেচ প্রকল, পাবনা সেচ ও পল−ী উন্নয়ন প্রকল্প, পানাসি (পাবনা-নাটোর ও সিরাজগঞ্জ) প্রকল, বরেন্দ্র প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পের হাজার হাজার একর জমিতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও পাম্প ব্যবহার করেও সেচ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। জিকে প্রজেক্টে ১ লাখ ৯৭ হাজার একর জমি রয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার একর আবাদি জমি। যে জমিতে এখন ইক্ষু, বাদাম (যে ফসলে পানির প্রয়োজন কম হয়) চাষে ব্যস- রয়েছেন নদীপাড়ের কৃষক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here