বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ এক গৌরবময় অধ্যায়। বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ বাঙালি মূল্যবোধের সুকুমারবৃত্তি-বেষ্টনীতে লালিত স্বপ্নের ফলশ্রুতি। সন্দেহ নেই, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই মুক্তিযুদ্ধে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও সন্নিহিত এলাকা প্রাধান্য পেয়েছে। কেননা যে কোনো ঘটনায় স্থান ও কালের অবস্থানগত ভূমিকা থাকে। তবে এ কথাও জোর দিয়ে বলা যায় যে, এই জনপদের ঐতিহ্যগত বৈপ্লবিক ধারা, শৈল্পিক চেতনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা রয়েছে- যা স্বাধীন রাষ্ট্রযন্ত্র, গর্বিত পতাকা আর বুকজোড়া মানচিত্র অর্জনের সংগ্রামে জীবন ও সম্পদ উৎসর্গে আপামর জনসাধারণকে যথাসময়ে অনুপ্রাণিত করেছিলো।
দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ বাঙালি জাতির অর্জিত সম্পদ। এই অনন্য-ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে চুয়াডাঙ্গার অবদান অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকার চাইতেও বেশি। ১৬ এপ্রিল ’৭১ পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা ছিলো সদ্য স্বাধীনতা ঘোষিত বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানী আর ১৭ এপ্রিল ’৭১-এ মুজিবনগরে (আসল নাম বৈদ্যনাথতলা) বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার শপথগ্রহণ করে।
কিন্তু এই আনুষ্ঠানিকতার পটভূমি খুঁজতে গেলে আমাদেরকে আরেকটু পিছিয়ে যেতে হবে। বুঝতে হবে, প্রতিরোধের প্রথম প্রহরে মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা তথা বৃহত্তর কুষ্টিয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট। কেননা বিজয় ছিনিয়ে আনার চূড়ান্ত লড়াইয়ে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর তথা বৃহত্তর কুষ্টিয়াবাসী নিজেদেরকে কোনো গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখেননি, বরং প্রতিরোধ পর্ব থেকে শুরু করে সার্বিক যুদ্ধে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন জাতীয় পরিচিতির গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে। যদিও স্বাধীনতার পর চুয়াডাঙ্গাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া হয়নি। উপরন্তু নানা বিতর্ক উত্থাপন করে বিভ্রান্তির অপচেষ্টা চলছে।
চুয়াডাঙ্গা তথা বৃহত্তর কুষ্টিয়ার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক ও দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের প্রধান উপদেষ্টা ডা. আসহাব-উল হক এবং উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট ইউনুস আলী তাঁদের স্মৃতিচারণমূলক লেখায় ও বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে চুয়াডাঙ্গাকে কেন, কোন অবস্থায় স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করা হয়েছিল আর কেনই-বা অস্থায়ী রাজধানী মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (যা এখন মুজিবনগর নামে পরিচিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মুজিবনগর নামটির প্রস্তাবকও ডা. আসহাব-উল হক) স্থানান্তর করতে হয়েছিল, তার বিস্তারিত বিবরণ ও ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যা বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় পত্র-পত্রিকা এবং বইয়ে ছাপা হয়েছে। এছাড়াও যেসব তথ্য-প্রমাণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, সবকিছু একত্রিত করতেই এই লেখার অবতারণা।
মেহেরপুরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গবেষক ও কথাশিল্পী রফিকুর রশিদ ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : মেহেরপুর জেলা’ গ্রন্থে লিখেছেন : ‘১০ এপ্রিল পর্যন্ত ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর সার্বিক তত্ত্ব্বাবাধানে সড়ক পথে ভারতীয় সামরিক সাহায্য চুয়াডাঙ্গায় এসেছে চেংখালি চেকপোস্টের মাধ্যমে। ১০ এপ্রিলের পরে মেহেরপুরের সীমান্ত চেকপোস্ট বেতাই বি.ও.পি থেকে মেহেরপুরে সামরিক সরঞ্জাম ও রিলিফসামগ্রী এসেছে। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, এই সময় শত শত ভারতীয় ও বিদেশি সাংবাদিক, টেলিভিশন সংস্থা আমাদের সাক্ষাৎকার নেন এবং এই মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করেন। তাঁদের সবার একই প্রশ্ন ছিল যে, তোমাদের সরকার কোথায়?
ইতিপূর্বে ভারতের টুঙ্গী বি.ও.পি-তে তাজউদ্দিন আহমদ ও ব্যরিস্টার আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জানানো হয়, অতি শিগগিরই বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করা হবে। অবশেষে ১০ এপ্রিল সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করা হয়। নবগঠিত এ সরকার অচিরেই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম মুক্তাঞ্চলে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণ করবেজ্জ এ খবরও আকাশবাণী থেকে প্রচারিত হয়। এর ফলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিশেষ মনোযোগ আকৃষ্ট হয় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের মুক্তাঞ্চলের দিকে।’
গতিধারা প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগরের ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, এম.পি.এ, এম.এন.এ যাঁরা ভারতে পৌঁছেছেন, তাঁদের খুঁজে বের করার জন্য জহুর আহমেদ চৌধুরীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কলকাতায় তাঁদের এক বৈঠকে ৫ জন এম.পি.এ উপস্থিত ছিলেন। সহযোগী নেতাদের সন্ধানে তাজউদ্দিন আহমদ প্রথমে আসামের গোয়ালপাড়ায়, পরে আগরতলায় যান। সেখানে প্রবাসী সরকার গঠনের জন্য আওয়ামী লীগ এম.পি.এ ও নেতাদের বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
১০ এপ্রিল আগরতলায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে ২৮ জন এম.পি.এ উপস্থিত ছিলেন। ওইদিনই কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থার অফিসগুলোতে তাজউদ্দিন আহমদের একটি বার্তা পাঠানো হয়। কুষ্টিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুল হক বাদশা ওই বার্তার কপি সকল অফিসে পৌঁছে দেন। তাতে বলা হয় : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে অস্থায়ী সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। শুধু একটি কথাই উল্লেখ না করে গোপন রাখা হয় যে, শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলের চুয়াডাঙ্গা শহরকে অস্থায়ী রাজধানী মনোনীত করা হয়েছে।
তৎকালীন আলমডাঙ্গা থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি শাফায়েত-উল ইসলাম লিখেছেন: ‘১০ এপ্রিল দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের প্রধান উপদেষ্টা ডা. আসহাব-উল হক টেলিফোনে আলমডাঙ্গা কন্ট্রোলরুমকে জানান, বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকারের ক্যাবিনেট ঘোষণা করা হয়েছে। এর পরপরই সকল কন্ট্রোলরুমে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে প্রচারের জন্য একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়: ‘আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড লড়াই করে শত্রুদেরকে সাড়া ব্রিজ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। উত্তরে সাড়া ব্রিজ থেকে দক্ষিণে লেবুতলা, বারোবাজার, সোনাবাজার ও ঝিকরগাছা লাইন পর্যন্ত আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আছে। যশোরের শত্রুসেনারা বর্তমানে তাদের ছাউনিতে আবদ্ধ রয়েছে। মুক্তিসেনারা আমাদের পাশে আছেন, আপনাদের ভয়ের বা পালিয়ে যাবার কোন কারণ নেই। এতদসত্ত্বেও যে-সব সরকারি, বেসরকারি কর্মচারী নিজ নিজ কর্মস্থল ছেড়ে অন্যত্র কোথাও পালিয়ে যাচ্ছেন বা যাবেন, তাদেরকে কোনোদিন এই বাংলার এই পবিত্র মাটিতে ফেরত আসতে দেওয়া হবে না। দেশের এবং জনসাধারণের মুক্তির জন্যে যাঁরা জীবনপণ যুদ্ধ করে যাচ্ছে, তাঁরা এই ভীরু পলাতকদের ক্ষমা করবে না। ইনশাল্লাহ জয় আমাদের সুনিশ্চিত। জয়বাংলা।’
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবরেও চুয়াডাঙ্গাকে বাংলাদেশের রাজধানী বলে উল্লেখ করা হয়। ১৪ এপ্রিল নয়াদিল্লী থেকে টচও পরিবেশিত খবরে বলা হয়: ‘ঞযব ঢ়ৎড়পষধসধঃরড়হ, নৎড়ধফপধংঃ নু ঃযব ৎবনবষ ঋৎবব ইবহমধষ জধফরড় ধহফ সড়হরঃড়ৎবফ যবৎব ংধরফ ঃযব পধঢ়রঃধষ ড়ভ ঃযব ইধহমষধফবংয (ইবহমধষর ঘধঃরড়হ) মড়াবৎহসবহঃ ড়িঁষফ নব ঈযঁধফধহমধ, ধ ংসধষষ ঃড়হি ১০ সরষবং ভৎড়স ঃযব নড়ৎফবৎ রিঃয ওহফরধ.’
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্থাপন মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ার, কুষ্টিয়া’-এ স্বাধীনতা সংগ্রামে চুয়াডাঙ্গার ভূমিকা প্রসঙ্গে বলা হয় : ‘চুয়াডাঙ্গা স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী বলে ঘোষিত হলে শুরু হয় হানাদার বাহিনীর বিমান হামলা।’ চুয়াডাঙ্গাকে রাজধানী করার সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে কুষ্টিয়ার ইতিহাস গবেষক শ. ম. শওকত আলী সাপ্তাহিক বিচিত্রায় লিখেছেন : ‘চুয়াডাঙ্গায় অস্থায়ী রাজধানী করে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়।’
তথ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশিত স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র পঞ্চদশ খণ্ডে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেছেন : ‘মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক শপথের জন্য ১৪ এপ্রিল দিনটি নির্ধারণ করা হয়েছিল। শপথের স্থানের জন্য আমরা চুয়াডাঙ্গার কথা প্রথমে চিন্তা করি। কিন্তু পাক হানাদার বাহিনী সেখানে বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করে। আমরা চুয়াডাঙ্গাকে রাজধানী করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, শেষ পর্যন্ত তা আর গোপন থাকেনি।’
ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুন লিখেছেন: ‘১৪ এপ্রিল ঠিক হয়েছিল চুয়াডাঙ্গায় শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হবে। কিন্তু পাকিস্তানিদের কাছে সে খবর পৌঁছে গেল। চুয়াডাঙ্গায় সাংঘতিকভাবে বোমাবর্ষণ করা হলো। তারপর ঠিক হয় মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হবে।’ পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসবিদ, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক মোহিত রায় লিখেছেন: ‘চুয়াডাঙ্গার দেশপ্রাণ তরুণদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের ফলেই ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা মুক্ত স্বাধীন ছিল, পেয়েছিল প্রথম অস্থায়ী রাজধানীর মর্যাদা।’
মুক্তিযুদ্ধকালীন নয়াদিল্লীতে পাকিস্তান দূতাবাস ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেন কূটনীতিক কে. এম. শিহাবউদ্দিন। তিনি তাঁর ঞযবরৎ ্ ইধপশ অমধরহ, অ উরঢ়ষড়সধঃবং ঞবষষ বইয়ে লিখেছেন: ‘রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকার বিষয়টি তখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। একটি বৈধ ও প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠন ছাড়া অনেক কিছুই সম্ভব হয়ে উঠছিল না। তাজউদ্দিন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তাঁরা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দখলমুক্ত এলাকা কুষ্টিয়ার চুয়াডাঙ্গায় জাতীয় পরিষদের সভা ডাকেন। মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা করতে ও আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে সেখানকার একটি আমবাগানে বাংলাদেশ সরকারের সরকার পরিচালনার স্থান নির্বাচন করা হয়। এই স্থানটিকে পরে বঙ্গবন্ধুর নামে মুজিবনগর নামকরণ করা হয়।’
মুক্তিযুদ্ধকালীন ৮নং সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী লিখেছেন : ‘চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী হিসাবে আখ্যায়িত করা হয় এবং ১০ এপ্রিল গঠিত স্বাধীনবাংলা মন্ত্রিপরিষদকে চুয়াডাঙ্গায় শপথগ্রহণ করানো হবে বলেও প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।’ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গবেষক ড. সুকুমার বিশ্বাস লিখেছেন : ‘১০ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করে চুয়াডাঙ্গাকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী বলে ঘোষণা করা হয় বলে আকাশবাণীর খবরে জানা যায়। এই ঘোষণার পরপরই পাকিস্তান বিমানবাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলো চুয়াডাঙ্গার ওপর ব্যাপকভাবে হামলা চালাতে থাকে।’
মেহেরপুরের ইতিহাস গবেষক সৈয়দ আমিনুল ইসলাম লিখেছেন : ‘১০ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।’ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গবেষক, সাংবাদিক ফজলুল বারী লিখেছেন : ‘আগরতলার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় চুয়াডাঙ্গা হবে স্বাধীন বাংলা সরকারের সদর দপ্তর।’ প্রোব বার্তা সংস্থার মুক্তিযুদ্ধ ‘৭১ কলকাতার স্মৃতি শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয় : ‘চুয়াডাঙ্গায় এই মন্ত্রিসভার (অস্থায়ী সরকারের) শপথ অনুষ্ঠান আয়োজন করার চিন্তা ছিল। কিন্তু গোপনীয়তার অভাবে পরিকল্পনা পণ্ড হয়ে যায়।’
১৯৯৪ সালের ২৪ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশনের ভরা নদীর বাঁকে অনুষ্ঠানের চুয়াডাঙ্গা পর্বে উপস্থাপক মোস্তাফা জামান আব্বাসী চুয়াডাঙ্গাকে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী বলে উল্লেখ করেন। ১৯৯৭ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত মুজিবনগর সরকার অনুষ্ঠানে চুয়াডাঙ্গাকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী উল্লেখ করে বলে হয় : ’চুয়াডাঙ্গাকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করা হয়েছেজ্জ এই খবর প্রচারিত হওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনী বিমান হামলা চালায়। ফলে চুয়াডাঙ্গায় মন্ত্রিসভার যে শপথ অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল, তা পরিবর্তন করে মুজিবনগরে নেওয়া হয়।’ ১৯৯৮ সালের ২৩ এপ্রিল বাংলাদেশ টেলিভিশনে আবেদ খান উপস্থাপিত ঘটনার আড়ালে অনুষ্ঠানের মুজিবনগর পর্বেও চুয়াডাঙ্গাকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানী বলে উল্লেখ করা হয়।
চুয়াডাঙ্গাকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী করার সিদ্ধান্তের কথা তাজউদ্দিন আহমদ গোপনে ডা. আসহাব-উল হককে জানান। যুদ্ধের আগেই চুয়াডাঙ্গায় নতুন হাসপাতাল ভবন তৈরি শেষ হয়েছিল। ডা. আসহাব-উল হক সেখানে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু সে খবর গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়ে গেলে চুয়াডাঙ্গা পাকিস্তানি বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয়। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে মেহেরপুরের মুজিবনগরে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়।
চুয়াডাঙ্গা থেকে ‘দৈনিক প্রথম রাজধানী’ নামে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের সরকারি ছাড়পত্র রয়েছে। এছাড়া প্রথম অস্থায়ী রাজধানী স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে ১৯৯৩ সালে ১৪ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়; যে স্মৃতিসৌধটি চুয়াডাঙ্গার শহীদ হাসান চত্বরে নির্মাণাধীন রয়েছে।
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার যে, চুয়াডাঙ্গায় অস্থায়ী রাজধানীর কোনো আনুষ্ঠানিক কার্যালয় ছিলো না। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল অস্থায়ী সরকার গঠনকালে চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করা হয় এবং পরে নিরাপত্তাজনিত কৌশলগত কারণে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়; যদিও অস্থায়ী সরকারের যাবতীয় কার্যক্রম মুজিবনগরের নামে কলকাতা থেকেই পরিচালিত হয়েছে। তথাপি কলকাতা নয়, মুজিবনগরই অস্থায়ী রাজধানীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। একইভাবে সার্বিক প্রস্তুতি, নবগঠিত সরকারের সিদ্ধান্ত ও ঘোষণার সুবাদে চুয়াডাঙ্গা প্রথম অস্থায়ী রাজধানীর মর্যাদার দাবিদার। এ নিয়ে কোনোরূপ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সংশয় বা বিভ্রান্তির অবকাশ নেই। চুয়াডাঙ্গাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা হলে সেটা হবে ইতিহাসের চরম সত্যকে অস্বীকার করার শামিল।
রাজিব আহমেদ : মুক্ত সাংবাদিক ও চুয়াডাঙ্গা জেলার আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক