ইমা এলিস/ বাংলা প্রেস, নিউ ইয়র্ক ::
যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের ফিলাডেলফিয়ায় প্রায় ২০ হাজার ধর্মপ্রাণ প্রবাসী মুসলমানদের অংশ গ্রহণে শেষ হলো ৩ দিন ব্যাপী মানবতার জন্য কোরআনের নির্দেশিকা শীর্ষক মুসলিম উম্মাহ অব নর্থ আমেরিকার (মুনা)’র ষষ্ঠ সম্মেলন। তিন দিনের উক্ত সম্মেলনে মানবতার জন্য কোরআনের নির্দেশিকা বিষয়ক আলোচনায় পরপর দু’দিন তরুণ বক্তা ও ইসলামিক বিদ্বান ড. মিজানুর রহমান আজহারী অংশ নেন। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কোরআনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করার সময় পূর্ণ মিলনায়তনে প্রায় ২০ হাজার ধর্মপ্রান প্রবাসী মুসলমানদের মাঝে ছিল পিন পতন নীরবতা। মঞ্চে ওঠা-নামার সময় মুনা’র একদল তরুণ সদস্য আজহারীকে কড়া নিরাপত্তা প্রদান করেন। যুক্তরাষ্ট্রের বাংলা সংবাদমাধ্যম বাংলা প্রেস এ খবর জানিয়েছে।
স্থানীয় সময় শনিবার (১৯ আগষ্ট) সন্ধ্যায় মানবতার জন্য কোরআনের নির্দেশিকা শীর্ষক আলোচনায় ড. মিজানুর রহমান আজহারী বলেছেন, আল কোরআন আল্লাহর সৃষ্টি নয়, কোরআন হচ্ছে আল্লাহর শিফা (আরোগ্য ও নিরাময়)। কোরআন হচ্ছে একটি কালজয়ী অলৌকিক ঘটনা (টাইমলেস মিরাক্কেল)। মহান রাব্বুল আল্লাহ তা’লার যেমন লয় নাই ক্ষয় নাই তেমনি কোরআনেরও কোন লয় নাই ক্ষয় নাই। তিন দিনের এ সম্মেলনে প্রায় ২০ হাজার ধর্মপ্রান মুসলমান অংশ নিয়েছেন বলে মুনা’র কর্তৃপক্ষরা জানিয়েছেন।
মুনা সম্মেলনের আয়োজকরা জানান, ড. মিজানুর রহমান আজহারী এই প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্দেশ্যে কোরআন ও হাদিসের আলোকে আলোচনা এবং মুনা সম্মেলনে অংশ নিলেন।
সম্মেলনে ইসলামি চর্চা ও আলোচনা ছাড়াও ছিল সেমিনার, ছোটদের অনুষ্ঠান, মহিলাদের জন্য আলাদা অনুষ্ঠান, বাচ্চাদের খেলাধুলা, কালচারাল প্রোগ্রাম ও ইয়ুথ প্রোগ্রাম। ৪টি মহাদেশ থেকে ইসলামিক বিদ্বানরা উক্ত সম্মেলনে যোগ দেন।
মুনা কনভেনশনের চেয়ারম্যান আরমান চৌধুরী সিপিএ ও আনিসুর রহমানের যৌথ সঞ্চালনায় শনিবারের আলোচনায় অংশ নেন- ড ওমর সুলাইমান, ড আলতাফ হোসেন, হারুণ ও রশিদ ও সাইখ আব্দুল নাসির জাগদা।
বাংলা ভাষাভাষি তরুণদের শ্রদ্ধার পাত্র ড. মিজানুর রহমান আজহারী আরও বলেন, কোরআন না থাকলে পৃথিবীতে আমাদের আসার উদ্দেশ্য কি তা জানতে পারতাম না। ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াতাম। খেতাম, কাজ করতাম, পৃথিবী আবাদ করতাম, উন্নয়ন হতো কিন্তু পৃথিবীতে আমাদের আসার উদ্দেশ্য কি? তা কখনই জানতে পারতাম না। কোরআন আমাদেরকে সেটা পরিস্কার করেছে।
তরুণ বক্তা ও ইসলামিক বিদ্বান আজহারী বলেন, কোরআন ব্যতীত সকল ধর্মগ্রন্থই নবীদের উপর একবারেই নাজিল হয়েছে। কিন্তু কোরআন নাজিল সম্পন্ন হতে সময় লেগেছে ২৩ বছর। কোরআন আমাদের আলোকিত জীবনের সন্ধান দেয়, উন্নতির দিকে নিয়ে যায়। অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানো মানবতাকে আলোকিত করে। কোরআন বিশ্লেষন করে দেখা যায় একটি ভূ-খন্ডের অক্ষর জ্ঞানহীন জাতি ও গোষ্টির পুরো জীবনধারাকে পাল্টে দিয়েছিল এই কোরআন।
তিনি দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মৃত্যু নিয়ে বলেন, কিছুদিন আগে আমরা প্রিয় আল্লামাকে হারিয়েছি। আমরা এই ভেবে বুকে আশা বেঁধে রাখি যে, এই দুনিয়ায় তাঁকে সাময়িকভাবে হারিয়েছি। কিন্তু কেয়ামতের দিনে জান্নাতে এই কোরআনের বুলবুলির কন্ঠে আমরা আবার কোরআন শুনতে পাবো। একইভাবে বাবা-মা, বন্ধুকেও হারিয়েছি। এ বিচ্ছেদ সাময়িক। আমরা তাদেরকে জান্নাতে একদিন পাবো।
পরদিন দুপুর ১২টার দিকে ড. মিজানুর রহমান আজহারী পুঃনরায় কোরআনে উল্লেখিত মানব জীবনের রিযিক নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেন। তিনি সূরা যারিয়াত, সূরা বাকারা, সূরা হুদ, সূরা বনী ইসরাইল ও সূরা রহমানের বিভিন্ন আওয়াতের অর্থ ব্যাখ্যা করে রিযিক নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন।
তিনি বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ হলেন তিনি, যিনি রিযিকদাতা এবং মহাশক্তিধর ও মহাপরাক্রমশালী। আল কোরআনে আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছেন, তিনি হলেন রিযিকদাতা। আল্লাহ আমাদের রিযিক দান করেন। কিন্তু রিযিক নষ্ট করতে বলেন নি। আপনাকে আল্লাহ অনেক রিযিক দান করেছে? তাহলে আপনি সাবধান হোন। কারণ, এটা একটি পরীক্ষা।
আজহারী ২০১০ সালে ইসলামি গজল ও কিরাত দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি একটি বাংলা টিভিতে ইসলামি অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। ২০১৫ সালের শুরুর দিকে তিনি ওয়াজ-মাহফিল নিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি অল্প কয়েক বছরেই সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেন। বর্তমানে যে ক’জন ইসলামি চিন্তাবিদ রয়েছেন, তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
মিজানুর রহমান তার নাম। তবে মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার কারণে তার নামের সাথে ‘আজহারী’ উপাধি যুক্ত হয়েছে। খুব অল্প সময়ে সুললিত কণ্ঠে কুরআন-হাদিসের সহজ-সাবলীল আলোচনা করে অসংখ্য মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। তার গবেষণাধর্মী আলোচনার কারণে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। তিনি বাংলা, আরবি, ইংরেজি ভাষায় খুবই দক্ষ। যে কারণে বিভিন্ন দেশের মানুষ তার আলোচনা বুঝতে পারে। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন এবং বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন।
দেশ বিরোধী বক্তব্যের অভিযোগ এনে দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁর মাহফিল একাধিকবার নিষিদ্ধ হয়। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ১২ জন ভারতীয় হিন্দু অবৈধ ভিসায় বাংলাদেশে এসে তার হাতে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হলে তিনি গণমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচিত হন। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে তাকে দেশবিরোধী মন্তব্য প্রদানকারী বলে এক সাংসদ কর্তৃক দাবি করা হয়। একই সময়ে ‘ঘরে ঘরে সাঈদীর জন্ম হোক’ বলে মন্তব্য করায় বাংলাদেশের সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ তাকে ‘বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীর প্রোডাক্ট’ বলে অভিহিত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে মন্তব্য করেছিলেন।
২০২১ সালে অক্টোবরে লন্ডনে ‘আই অন টিভি’র আমন্ত্রণে ইসলামী কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও যুক্তরাজ্যে ‘হোম অফিস’ ধর্মীয়ভাবে অন্য ধর্মকে আঘাত করা ও ঘৃণা বক্তব্য ছড়ানোর অভিযোগে তাকে যুক্তরাজ্যে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। প্রবেশের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে মামলার করা হলেও ভিসা বাতিলের পক্ষে রায় দেয় আদালত।
২০২১ সালে অক্টোবরে লন্ডনে ‘আই অন টিভি’র আমন্ত্রণে ইসলামী কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও যুক্তরাজ্যে ‘হোম অফিস’ ধর্মীয়ভাবে অন্য ধর্মকে আঘাত করা ও ঘৃণা বক্তব্য ছড়ানোর অভিযোগে তাকে যুক্তরাজ্যে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। প্রবেশের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে মামলার করা হলেও ভিসা বাতিলের পক্ষে রায় দেয় আদালত।
পোস্ট-গ্রাজুয়েশন শেষ করে মালয়েশিয়ার ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে এমফিল এবং পিএইচডি করার সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৬ সালের মধ্যে এমফিলও শেষ করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘হিউম্যান এম্ব্রায়োলজি ইন দ্য হোলি কুরআন’। তারপর একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হন। ‘হিউম্যান বিহ্যাভিয়ারেল ক্যারেক্টারইসটিক্স ইন দ্য হোলি কুরআন অ্যান্ড অ্যানালিটিক্যাল স্টাডি’র ওপর পিএইচডি গবেষণা করছেন। তার এমফিল এবং পিএইচডির মাধ্যম ছিল ইংরেজি।
গত শুক্রবার সম্মেলনে বক্তব্য দেন মুনার ন্যাশনাল কমিটির সভাপতি হারুন ও রশীদ, মাওলানা মাহমুদুল হাসান, মাওলানা লুৎফর রহমান, আব্দুস সালাম আজাদী ও আহমেদ আবু ওবায়দুল্লাহ।
গত শুক্রবার সম্মেলনে বক্তব্য দেন মুনার ন্যাশনাল কমিটির সভাপতি হারুন ও রশীদ, মাওলানা মাহমুদুল হাসান, মাওলানা লুৎফর রহমান, আব্দুস সালাম আজাদী ও আহমেদ আবু ওবায়দুল্লাহ।
সম্মেলন শেষে সংবাদ সম্মেলন:
শনিবারের সম্মেলন শেষে রাত সাড়ে ১১টার দিকে এক সংবাদ সম্মেলনের আহবান করেন মুসলিম উম্মাহ অব নর্থ আমেরিকার (মুনা) কর্তৃপক্ষ। সংবাদ সম্মেলনের নানা ক্রুটি নিয়ে সাংবাদিকদের মতামত জানতে চান কর্তৃপক্ষ। অত্যন্ত সুশৃংখল একটি সম্মেলনের ভূয়সী প্রশংসা করে আগামী সম্মেলনে সকল সাংবাদিকের একই হোটেলে রুম বুকিং দেওয়ার আহবান জানান।
প্রধানবক্তা বা অতিথির সাথে আলাদা করে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সুযোগ সৃষ্টির জন্যও দাবি জানানো হয়। খাবার দাবারের সমস্যা, নিরাপদে হোটেলে যাতায়াত ও নানাবিধ সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করা হয়। আগামীতে কর্তৃপক্ষ এসব বিষয় ভেবে দেখবেন বলে আশ্বাস প্রদান করেন। সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন মুনা ন্যাশনাল কমিটির প্রেসিডেন্ট হারুন অর রশীদ, কনভেনশনের চেয়ারম্যান আরমান চৌধুরী সিপিএ, আব্দুল্লাহ আরিফ, আহমেদ আবু ওবায়দুল্লাহ, ড. রিয়াজুল ইসলাম ও ফকরুল ইসলাম মাসুম।