মানুষ হয়ে মানুষের ওপর এমন বর্বর নির্যাতন করতে পারে তা শিশু রোমেলা খাতুন (৮) কে না দেখলে বোঝা যাবে না। পুলিশের এক উপপরিদর্শক (এসআই) ও তার স্ত্রীর নির্মম নির্যাতনে শিকার শিশু রোমেলা খাতুন পাবনা জেনারেল হাসপাতালে অসহনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ওই দম্পতি তার ওপর চালিয়েছে নির্মম নির্যাতন। গরম পানি ঢেলে পুড়িয়ে দিয়েছে রোমেলার পুরো শরীর। গরম খুনি-র ছ্যাঁকা দিয়েছে তার মুখে, পিঠে। নির্মম নির্যাতনের শিকার রোমেলার বাড়ি পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার কাশীনাথপুর ইউনিয়নের গোটেংরা গ্রামে।
এদিকে শিশু রোমেলাকে নির্যাতনের বিষয়ে থানায় অভিযোগ দিতে গেলে অভিযোগ গ্রহণ না করায় পাবনার সাঁথিয়া থানার এক এএসআই কে গত শুক্রবার রাতে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে। গতকাল শনিবার সাঁথিয়া থানায় রোমেনার বাবার দেওয়া অভিযোগটি গ্রহণ করে একটি সাধারন ডাইরী করে অভিযোগটি মামলার জন্য ঘটনাস’ল চট্রগ্রামের সিতাকুন্ড থানায় পাঠিয়েছে।
গতকাল শনিবার পাবনা জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে কথা হয় রোমেলার পিতা ইয়াজ উদ্দিন’র সঙ্গে।  তিনি জানান, তিনি পেশায় দিনমজুর স্ত্রী অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। তিন ছেলে মেয়ের মধ্যে রোমেলা সবার ছোট। অভাবের সংসারে সন-ানদের ঠিকমতো খাওয়াতে-পরাতে পারেন না। গত মার্চ মাসের প্রথম দিকে পাশের গ্রামের আনছার আলী তাকে এসে বলেন, তার দূরসম্পর্কের ভাই বেড়া উপজেলার নান্দিয়ারা গ্রামের শাহেদ আলী পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই)। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডু থানায় কর্মরত আছেন। তার বাড়িতে একটি কাজের মেয়ে দরকার। সেখানে তোমার মেয়েকে কাজে দিলে রোমেলা ভালই থাকবে।
মেয়ে আমার দুই বেলা পেট পুরে খেতে পারবে এ আশায় আমি আনছার আলীর কথায় রাজী হয়ে যায়। মার্চ মাসের শেষ দিকে (এসআই) শাহেদ আলী এসে মেয়ে কে সিতাকুণ্ডু নিয়ে যান।
রোমেলার পিতা আরো জানান, মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার পর গত সাত মাসে বিভিন্নভাবে মেয়ের খোঁজ জানার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পরে আনসার আলী পুলিশ দম্পতির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। সে সময় মেয়েকে  ফেরত চাইলে ওই পুলিশ কর্মকর্তা মেয়ে কে দিতে অস্বীকৃতি জানান। এসআই শাহেদ আলী তার পরিবার নিয়ে ঈদ করতে বাড়িতে আসেছে শুনে আমি শাহেদ আলীর কাছে গিয়ে মেয়েকে ফেরত চাইলে তিনি জানান তার মেয়েকে বাসায় (সিতাকুন্ড) রেখে এসেছে।
শাহেদ আলীর কথায় বিশ্বাস না করে বিষয়টি আমি গ্রাম্য প্রধানদের জানায়। পরে এলাকাবাসীর চাপে গত বুধবার সন্ধ্যায় পুলিশ কর্মকর্তা শাহেদ আলী আমাকে এক ফাঁকা জায়গায় ডেকে নিয়ে গিয়ে অসুস’ রোমেলাকে দিয়ে চলে যায়। পরে মেয়ের অবস’া দেখে এলাকাবাসীরা গত বৃহস্পতিবার দুপুরে মেয়েকে পাবনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়।
গতকাল শনিবার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, রোমেলার পুরো শরীরে ক্ষত। মাথার চুল উঠে গেছে। মুখ, পিঠ ও ঠোঁটসহ শরীরের বিভিন্ন স’ানে ঘা সৃষ্টি হয়েছে।
চিকিৎসাধীন রোমেলা জানায়, নিয়ে যাওয়ার পর প্রথম কিছুদিন কোনো কিছু বলতো না। কিছুদিন পর থেকেই তার ওপর শুরু হয় নির্যাতন।
রোমেলা বলে, ‘দারোগার বউ সুইটি ম্যাডাম কথায় কথায় আমাকে খুব মারতো। প্রায় ১৫ দিন আগে তার হাত থেকে কাচের একটি প্লেট পড়ে ভেঙে গেলে দারোগা শাহেদের স্ত্রী সুইটি বেগম তাকে বেদম মারধর করে। তার সারা শরীরে গরম খুন্তির ছেঁকা দেওয়া হয়। খুনি- ও চামচ গরম করে পেটাত। কয়েকবার আমার গায়ে গরম পানি ও গরম তরকারি ঢেলে পুড়িয়ে দিয়েছে। পাবনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ফাইরোজা বেগম জানান, দীর্ঘদিন ধরে শিশুটির ওপর শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। তাপজনিত কারণে মেয়েটির শরীরে ঘা তৈরি হয়েছে। তার শরীরের ক্ষতচিহ্নগুলোও খুব গভীর। শিশুটির সুস’ হতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। সে সুস’ হয়ে গেলেও তার ক্ষত চিহ্ন থেকেই যাবে।
গতকাল শনিবার সকালে এসআই শাহেদ আলীর সঙ্গে তার মোবাইল ফোনে অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগ করলে  তিনি তার এবং তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বিকার করে বলেন, ‘মেয়েটিকে কোনো নির্যাতন করা হয়নি। ঈদের কয়েক দিন আগে বাজার থেকে বাসায় ফেরার পথে দুর্ঘটনায় সে আহত হয়। এ ছাড়া পানি গরম করার সময় গরম পানি পড়ে তার শরীর পুড়ে যায়।
এদিকে এ ঘটনায় গত শুক্রবার বিকেলে সাঁথিয়া থানায় অভিযোগ দিতে গেলে পুলিশ অভিযোগ গ্রহণ করেনি। রোমেলার চাচা আজিজল খাঁন অভিযোগ করে বলেন, সাঁথিয়া থানায় অভিযোগ দিতে গেলে কর্তব্যরত ডিউটি অফিসার এএসআই আইয়ুব আলী অভিযোগ নেননি। যে থানায় ঘটনা সেই থানায় গিয়ে মামলা করার কথা বলে তিনি আমাদের ফিরিয়ে দেন। এ বিষয়ে গত শুক্রবার রাতে পাবনার পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর হোসেন মাতব্বরের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভিযোগ গ্রহণ না করার অভিযোগে সে সময় থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিউটি অফিসার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আয়ুব আলীকে শুক্রবার রাতে প্রত্যাহার করে পাবনা পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে।
পুলিশ সুপার আরো জানান, শিশু রোমেলাকে নির্যাতনের বিষয়ে রোমেলার পিতার দেওয়া অভিযোগ গতকাল শনিবার সকালে সাঁথিয়া থানা গ্রহণ করে থানায় সাধারন ডাইরী করে (ডাইরী নম্বর ৪৩৪) মামলা দায়েরের জন্য সেটি চট্‌্রগ্রামের সীতাকুন্ডু থানায় পাঠানো হয়েছে। ওই থানাতেই মামলা হিসেবে নথিভূক্ত হবে।
মামলার বিষয়ে সীতাকুন্ডু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরমহাম্ম জানান, পাবনার সাঁথিয়া থানা থেকে পাঠানো অভিযোগটি গতকাল শনিবার বিকেলে পাবার পর সেটি মামলা হিসেবে নথিভূক্ত করা হয়েছে। মামলা নম্বর ১২। মামলায় সীতাকুন্ডু থানার পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) শাহেদ আলী ও তার স্ত্রী সুইটি বেগমকে আসামী করা হয়ে।

কলিট তালুকদার, পাবনা

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here