রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলায় শুধু এক মাসে তিনটি স্থানে চারটি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘঠেছে। এ নিয়ে জনমনের মাঝে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। এলাকাবাসীর কাছে বর্তমান আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্নবিদ্ধ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সচেতন মহল। পুলিশ এখনো এসব হত্যাকান্ডের সঠিক কোনো রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি। এ বিষয়ে পুঠিয়ার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়ে সহকারী পুলিশ সুপার কাজেম উদ্দিনসহ পুলিশের উদ্ধোর্তণ কর্তৃপক্ষ তদন্তের কথা বলে আসাস্ত করছেন মাত্র।
পুঠিয়া উপজেলার জাগিরপাড়া গ্রামে গত ১৪ ডিসেম্বর পরকীয়ার বলি গৃহবধূসহ চাঞ্চল্যকর জোড়া খুনের ঘটনা। এ ঘটনায় একই দিনে হত্যার শিকার হন সে এলাকার মৃত নওশেদ আলীর ছেলে ব্যবসিক আলম (৫০) ও একই গ্রামের শামসুলের স্ত্রী শাহারা বেগম (৩৮)। নিহত শাহারা বেগমের পিতা ইদ্রিস আলী ভাদু বাদী হয়ে ১৫ ডিসেম্বর পুঠিয়া থানায় হত্যামামলা রুজু করেন। এ মামলার তদন্ত কারী কর্মকর্তা পুঠিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি-তদন্ত) আসলাম হোসেন জোড়া খুনের বিষয়ে কোনো হদিস করতে পারেনি। এর রেশ কাটতে না কাটতেই সাত দির পর ২২ ডিসেম্বর পুঠিয়া তারাপুর গ্রামে আরেকটি হত্যাকান্ড। সে ঘটনায় শিকার হন ওয়ার্ড কৃষক লীগের সদস্য মৃত দানেশ প্রামাণিকের ছেলে কৃষক নূর ইসলাম (২৮)। কৃষক যুবককে নৃশংসভাবে জবাই ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তারপর বাড়ির গেটের দরজা ভেঙ্গে তার ঘর থেকে নগদ টাকা, স্বর্ণে গয়নাসহ বেশকিছু ঘরের আসবাবপত্র ও জিনিসপত্র লুটপাট করা হয়েছে। এতে নিহতের বড় ভাই শমসের আলী বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামী করে একটি হত্যামামলা দায়ের করেন। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেভাজন ব্যক্তি লিটনকে (২২) আটক করে থানায় সাজানো নাটকীয় কাহিনী তৈরি করে আসামী করা হয়েছে। উক্ত মামলায় পুলিশের বিরুদ্ধে সরকারী দলের নামে বানিজ্য করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। পুঠিয়ায় চারটি হত্যাকান্ডগুলোর ব্যাপারে পুলিশ এ পর্যন্ত ১৫ জনকে সন্দেহভাজন বরাতে আটক করে বানিজ্য করে ছেড়ে দিয়েছে বলে সূত্রে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পুঠিয়া থানার ওসি-প্রশাসন শেখ আতিয়ার রহমান পুঠিয়া থানা পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি স্বীকার করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার কথাও বলেন।
সমপ্রতি, আলোচিত গুপ্তত্যার ঘটনাটি ১৪ জানুয়ারি পুঠিয়া উপজেলার শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের বদপাড়া গ্রাম থেকে দুপুর আড়াইটার দিকে প্রার্থনার গুম করা গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। কোন প্রার্থনাই আর ফিরে আসবে না ‘প্রার্থনা’। প্রার্থনা- দশ বছরের এক শিশুকন্যার নাম। নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তার বাবা-মায়ের একটাই প্রার্থনা ছিল, তাকে ফিরে পাওয়ার। কিন্তু সব প্রার্থনা তিমিরেই থেকে গেলো। ধপ করে নিভে গেলো আরো একটি আশার প্রদীপ।
নিখোঁজ হওয়ার দুই মাস পর অবশেষে দশ বছরের শিশু প্রার্থনাকে উদ্ধার করা হয়েছে। তবে জীবিত নয়, পাওয়া গেছে তার নিথর ও পঁচা লাশ। এ ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে পুলিশ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
পুঠিয়া থানার ওসি শেখ আতিয়ার রহমান বলেন, গত দুই মাস আগে পুঠিয়ার বদপাড়া গ্রামে নিখোঁজ হয় দশ বছরের শিশুকন্যা প্রার্থনা। এর আগে একই গ্রামের প্রধান আসামী নাজমুল হক গালিব জামাতের সহযোগী তাকে পথে-ঘাটে কু প্রসত্মাব দিতো।
পুলিশ বলছে, এ ঘটনার সাথে গালিব ছাড়াও তার বন্ধু রতন ও পরিবারের সদস্যরা জড়িত থাকতে পারে।
বরং নাটকী কায়দায় হত্যাকান্ডের ঘটনাগুলো ধামাচাপা দিয়ে সরকারদলী স্থানীয় নেতাদের নামে বানিজ্য করে চলছে পুঠিয়া থানা পুলিশ। এ নিয়ে এলাকার সকল শ্রেনীর মানুষের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে। গত একমাসে পুঠিয়া উপজেলায় চারটি হত্যাকান্ড ছাড়াও চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি ও ডাকাতির ঘটনায় থানা পুলিশের নীরবতায় আতঙ্কে পড়েছেন এলাকাবাসী।
উলেখ্য, গত ১১ জানুয়ারি এর আদালতে শুনানি থাকলেও পুঠিয়া থানা পুলিশ প্রধান আসামী গালিবে গ্রেফতার করতে পারেনি। পুঠিয়ার ওসি জানান, বর্তমানে প্রধান আসামী গালিবকে গ্রেপ্তার করতে সম্ভাব্য সকল স্থানে অভিযান চলছে।
গত ১৫ জানুয়ারি জামায়াত কর্তৃক পুঠিয়ার বর্তমান আইন শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতিতে কেন্দ্রের নির্দেশে বিক্ষোভ মিছিল ও নাশকতার ষড়যন্ত্রের প্রস্তিুতি সভা করার সময় পুলিশ দুইজন জমায়াত নেতা আটক করেছিল। আটককৃত ব্যক্তিরা বানেশ্বর ইউনিয়ানের জামাতের আমীর আলহাজ্ব মোস্তফা কামাল বদর (৬৫) ও সদস্য মকবুল হোসেন (৭০) উভয়ের বাড়ী উপজেলার বানেশ্বরে। পরে পুঠিয়া থানায় এনে আসামীদের ৫৪ ধারায় জেল হাজতে প্রেরণ করেন। পরে তারা জামিনে মুক্তি পায়। পুঠিয়া থানা পুলিশের পুরোনো কৌশলে মামলা বানিজ্য, উৎকোচের বিনিময়ে ফেন্সিডিল ব্যবসায়ীদের চালনে ছাড় এবং থানা থেকে আসামী খালাসের পক্রিয়ায় (টু-পাস-টু) কামায় চলছে। আর বর্তমানে পুঠিয়ার আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতি নিয়ে থানা পুলিশ জনসাধারণের “আই ওয়াশ” করেছে। বর্তমান দেশের ডিজিটাল প্রক্রিয়ার ডিজিটাল এ্যাক্ট ফোর পুলিশিং কায়দায় চলছে পুঠিয়া থানা। প্রতিনিয়ত রাতে থানা পুলিশ ওসিসহ টহলের নামে এলাকায় কিছু ব্যক্তিদের থানায় ধরে নিয়ে সকাল হতে হতে পুনোরো কায়দায় বানিজ্য করে ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াটি চরম আকার ধারণ করেছে।
এ পুঠিয়া উপজেলার পরিষদের সভাকক্ষে মাসিক আইন শৃঙ্খলা সমন্নয়কারী সভায় এক মাসে তিনটি স্থানে চারটি হত্যাকান্ডের ঘটনা চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি ও ডাকাতিসহ উপজেলার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও কমিটির সভাপতি একেএম তারেক। পুঠিয়া পুলিশ প্রশাসানকে সজাগ থাকার নির্দেশ করা হয়েছে বলেও জানান।
পুঠিয়া উপজেলার বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণ হিসাবে নাম জানাতে অনিচ্ছুক পুলিশের উদ্ধোর্তণ এক অফিসার বলেন, সদর উপজেলার মহা-সড়ক সংলগ্ন হওয়ায় পুঠিয়া থানার আয়তন বেশ বড়। তাই এলাকায় প্রতি রাতে পুলিশের টহল ও আসামী ধরার কাজে ব্যবহার হয়ে। তাতে আছে একটি মাত্র পিকাপ ভ্যান। অনেক ড়্গেত্রে পুলিশ টহলও আসামী ধরার কাজে গাড়ি রিকুইজেশন করতে হয়। এ সকল গাড়ির তেল ক্রয়, চালক-হেলপারদের হাতখরচ ও রাতের খাবার ও কনস্টেবলদের টিফিন খরচ, টহলের টিম প্রধানের ব্যবস্থা করতে হয়। গ্রেফতারকৃত ও রিমান্ডের আসামিদের কেউ অসুস্থ হলে তাদের চিকিৎসা, খাবার খরচ, আদালতে প্রেরণ খরচ পুলিশের এসআইদেরই বহন করতে হয়। বৈদ্যুতিক লোড শেডিং এর সময় বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় পুরো থানা ভূতরে হয়ে পরে। দৈনন্দিন পুলিশের ডাক সংশিস্নষ্ট বিভাগে পাঠানোর ব্যয় তাদেরই মিটাতে হয়। তবে এড়্গেত্রে ৫/৬ মাস পরপর চাহিদার তুলনায় নামমাত্র কিছু টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। পুলিশের ব্যবহৃত রেজিষ্টার খাতা, কলম, কাগজ, আলপিন, সুতা, বোর্ড ও কার্বনসহ ষ্টেশনারি মালামাল নিজেদের টাকায় ক্রয় করতে হয়। এ সকল ব্যয় বহনের নামে প্রকাশ্যেই পুলিশ প্রশাসনের বাধ্য হয়ে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষের টাকার উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। একটি জিডি করতে আবেদনকারীর পরিচয়, পেশা ও কি বিষয়ে জিডি করা হবে সেদিক বিবেচনা করে দু’শ টাকা থেকে এক হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে। জমি সংক্রানত্ম বিরোধ, হামলা, মামলা মারামারি ও নোটিস করে উভয়পড়্গকে থানায় ডেকে সমঝোতা করে দেয়ার নামে বিপুল পরিমাণ টাকা আদায় করে। মামলা রম্নজু করা, আসামী গ্রেফতার করা, ওয়ারেন্ট তামিল করা, চার্জশীট থেকে আসামীর নাম বাদ দেয়া কিংবা সংযুক্ত করা, মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া, পুলিশী প্রতিবেদন করা, মামলায় পছন্দের ধারা নিশ্চিত করা থেকে শুরম্ন করে সকল কাজেরই পুলিশের সোর্স রয়েছে। এসকল সোর্স টাকা নির্ধারণে রফা-দফা করে থাকে।
পুঠিয়া থানা ভবনের সামনের গোলঘরে বসে অনেক সময় বাদী-বিবাদীদের মধ্যে চাপের মুখে পুলিশ সমঝোতা করে দেয়। এক্ষেত্রে বেশি টাকা প্রদানকারীর পড়্গেই সমঝোতার রায় দেয়া হয় অনৈতিক ভাবে। অবৈধ লছিমন-করিমন ও গভীর রাতে টহলের নামে পুলিশ চাঁদা আদায়ের পুরোনো রীতি এখনো চালু রেখেছে পুঠিয়া থানায়। মাদকের স্পটগুলোর মালিকদের সঙ্গে রয়েছে পুলিশের দহরম-মহরম সম্পর্ক। মাঝে মধ্যে লোক দেখানো আইওয়াস অভিযান চালানো হলেও কার্যত কোন ফল হচ্ছে না। এছাড়াও কিছু ওয়ারেন্টভুক্ত আসামীকে গ্রেফতার না করার ড়্গেত্রে রয়েছে পুলিশের আর্থিক সুবিধা। শত শত সমস্যার মাঝেও পুঠিয়া থানার পুলিশ বসে নেই। পুলিশের ভাল কাজের মূল্যায়ন করা না হলেও অন্যায় কাজের কারণে সাধারণ মানুষের ক্ষোভের শেষ নেই।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, পুঠিয়া থানায় টাকা কিংবা তদবির ছাড়া মামলা রুজু করা যায় না। সরকারদলীয় নেতার তদবির হলে টাকার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম লালে। বর্তমান ওসি ১ হাজার টাকা থেকে দেড় হাজার টাকায় বেশিরভাগ মালা রুজু করছে। তদনেত্ম নামে কালক্ষেপণ করা হয়। টাকা দিলে মিথ্যা ঘটনার মামলাও রুজু করা হয়। উর্ধ্বতন পুলিশের নামে এ সকল টাকা আদায় করা হচ্ছে। তবে হাউজিং প্রকল্পে লোকজন বাদী-বিবাদী হলে টাকার পরিমাণ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এ সকল টাকার ভাগ সংশিষ্ট বিভাগে পাঠাতে হয়। টাকা আদায়ের জন্য এসআইদের মধ্যে বেশি কৌশল জানে যে, তাকেই তাত বেশি মামলা দেয়া হয়। এ রকম নানা কৌশলে পুঠিয়া থানা পুলিশ ঘুষ বানিজ্য চালিয়ে আসছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ ব্যাপারে পুঠিয়ার অফিসার ইনচার্জ (ওসি-প্রশাসন) বলেন, জোড়া খুনের কোন রহস্য উদঘাটন করতে পারিনি। তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। খুব শীঘ্রই তা উদঘাটন হবে। অন্য দুটি খুনের রহস্য উদঘাটন করে আসামীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তিনি কোন মন্তব্য করেনি।
রাজশাহী জেলা পুলিশ সুপারের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, পুঠিয়ার খুনগুলির মামলার প্রতিবাদে খুব শীঘ্রই আদালতে চার্জসিট দাখিল করা হবে।
ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/মেহেদী/রাজশাহী