ড. আতিউর রহমান

ড. আতিউর রহমান :: বাংলাদেশ এখন সব সেক্টরেই দ্রুত এগিয়ে গেছে। শহর-গ্রাম সবখানেই তাই পরিবর্তনের চিহ্ন স্পষ্ট লক্ষণীয়। পল্লী-প্রান্তরে ব্যক্তিগত অবকাঠোমোর অভাবনীয় পরিবর্তন না দেখলে বুঝা কষ্ট বাংলাদেশের ভেতরে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে। একদম অঁজপাড়া গায়ে যখন শুনি গ্যাস সিলিন্ডারে রান্না হয়, তখন নিজেকেই যেনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।

অবকাঠামোর সাথে সাথে স্যানিটেশন, হাইজিন এগুলোতেও পরিবর্তন আসছে। করোনা আসার পর হাতধোঁয়ার বিষয়েও মানুষের মাঝে এক বড় সচেতনতা তৈরি হয়েছে। একসময় পল্লী-প্রান্তরের মানুষের মধ্যে স্যানিটেশন সচেতনতা অনেক কম ছিল। কিন্তু সরকারি এবং বেসরকারি নানা উদ্যোগ ও টেকসই কৌশলের কারণে গ্রামেও এখন স্যানিটেশন সচেতনতা অনেক অনেক বেড়েছে। সেই সচেতনতাকে আরও এগিয়ে নিতে এবং সবার জন্য সব সুবিধা নিশ্চিতকরণের জন্য এ বছরে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে বাংলাদেশে পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন সেক্টরের জন্য ‘দরিদ্র সহায়ক কৌশলপত্র ২০২০’ সংশোধিত সংষ্করণ বের করা হয়েছে। আমার মতে এটি অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ পথনকশা, যা আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করবে।

একটু পেছনে ফিরে দেখি।গত বছর ২০১৯, অক্টোবরে ন্যাশনাল একাডেমি ফর প্লানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট বাংলাদেশ পানি ও স্যানিটেশন সেক্টরের জন্য দরিদ্র সহায়ক কৌশলপত্র ২০১৯-এর সংশোধিত খসড়ায় মন্তব্য ও পরামর্শ প্রদানের জন্য আয়োজিত কর্মশালায় আমারও কিছু কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে এ সব বিষয়ে আমি কিছু সুনির্দিষ্ট মতামত দিয়েছিলাম। সেদিন আমি এই সেক্টরের ধারাবাহিক অগ্রগতি, সাফল্য এবং আগামীতে করণীয় ও কর্মকৌশলের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরেছিলাম। ভাল লেগেছে যে, বাংলাদেশে পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন সেক্টরের জন্য ‘দরিদ্র সহায়ক কৌশলপত্র ২০২০’ -এ আমার বেশিরভাগ সুপারিশকে অন্তুর্ভুক্ত করা হয়েছে।

২০০৫ সালে প্রথমবারের মত ‘পানি ও স্যানিটেশন সেক্টরের জন্য দরিদ্র সহায়ক কৌশলপত্র’ প্রণয়ন করেছিল স্থানীয় সরকার বিভাগ। মোটা দাগে এই কৌশলপত্র- এর মূল উদ্দেশ্য ছিল পরবর্তী ৫ বছরের মধ্যে নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সুবিধা বঞ্চিত অতিদরিদ্র পরিবারগুলোকে নিরাপদ পানি সরবরাহ ও লাগসই স্যানিটেশন সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে সাহায্য করা।

সে সময় মূলত দুটি বিষয়ের উপর দৃষ্টি রেখে এমন একটি কৌশল পত্র প্রণয়ন করা হয়েছিল। প্রথমত, প্রবৃদ্ধির সুবিধা হতদরিদ্ররা সেভাবে পাচ্ছিলো না। সুতরাং দারিদ্র্যকে সরাসরি মোকাবেলা করার একটা তাগিদ ছিল। দ্বিতীয়ত, ১৯৯৮ সালের নিরাপদ পানি সরবারাহ ও স্যানিটেশন নীতিমালায় ক্রমান্বয়ে ভর্তুকি হ্রাস করার পরিকল্পনার কারণে, অতিদরিদ্রদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা ব্যাবস্থা গ্রহণ করা জরুরী ছিল।

২০১৫ সালের পর থেকে সারা বিশ্বেই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-কে কেন্দ্র করে উন্নয়ন ভাবনায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশ সরকারও এর সাথে তাল মিলিয়ে তার কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। যার ফলে কৌশলপত্রটিতে, স্বীকৃত আগের দুটি বিষয়ের সাথে নতুন আরেকটি বিষয়কে যুক্ত করা হয়েছে। সেটি হল: এসডিজি-৬ এর লক্ষামাত্রা অর্জনে ‘কাউকে পিছনে রেখে নয়, সকলের জন্য সব সময়’ টেকসই ও মানসম্পন্ন নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন ব্যাবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ।

এসডিজি-র এই মূলমন্ত্র নিশ্চয়ই কৌশলপত্রটিকে আরো কার্যকর করেছে। দেশে ২০১৬ সালে শতকরা ২৪.৩ ভাগ দরিদ্র এবং ১২.৯ ভাগ অতিদরিদ্র ছিলেন। এখন কমে তা ২২% এবং ১১% হয়েছে। তবে করোনাকালে এই দারিদ্র্য চিত্রের হেরফের হয়েছে। আসলে অতিদরিদ্রের বড় একটি অংশকে বিশুদ্ধ পানির জন্য নির্ভর করতে হয় ব্যাক্তিমালিকানাধিন নলকূপ অথবা কমিউনিটি নলকূপের উপর। বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন এর সুযোগের অভাবে অতিদরিদ্রদের মধ্যে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। সেদিন আমি বলেছিলাম দরিদ্র সহায়ক সেক্টরে গতানুগতিক বিনিয়োগ করার পরিবর্তে সব চেয়ে পেছনের ব্যাক্তিটিকে সামনে এনে, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন ব্যাবস্থাপনা নিশ্চিত করার মাধ্যমে দারিদ্র্যকে সরাসরি মোকাবেলা করতে এই কৌশল পত্রটি সাহায্য করবে।

সেদিন আমার পরামর্শ ছিল-পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন সেক্টরে গৃহিত দরিদ্রবান্ধব কর্মসূচির উপকারভোগি যথাযথভাবে চিহ্নিত করতে প্রথমেই নির্ধারণ করা দরকার অতিদরিদ্র বলতে কাদেরকে বোঝানো হবে। অতিদরিদ্র পরিবারকে সংজ্ঞায়িত করতে, National Household Database (NHD) তৈরি হবার জন্য অপেক্ষা না করে মানবিক সহায়তা কর্মসূচী বাস্তবায়ন নির্দেশিকা, ২০১২-১৩ অনুসরণ করা নিঃসন্দেহেই একটি ভাল উদ্যোগ। কিন্তু National Household Database (NHD) তৈরি হবার পর সেখান থেকে Proxy Mean Test- Formula (PMTF) এর মাধ্যমে প্রতিটি পরিবারের আর্থ-সামাজিক অবস্থার নির্দেশক স্কোর দিয়ে এসব পরিবার সনাক্ত করলে তা আরও সুনির্দিষ্ট হবে। সেদিন আমার পরামর্শ ছিল-কৌশলপত্রের খসড়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম, চর, হাওড়সহ আরও যে কয়টি জায়গায় অতিদরিদ্র চিহ্নিতকরণের শর্ত শিথিল করার কথা বলা আছে তার সাথে আমি একমত। কিন্তু সেই সাথে খরাপ্রবণ এলাকা ও নগর অঞ্চলের দরিদ্রদের জন্যও শর্ত শিথিল করার কথা ভাবা যেতে পারে। এসডিজি-র নির্দেশনায় পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশনের যেসব ন্যূনতম মৌলিক সেবার উল্লেখ আছে মাঠ পর্যায়ে সেগুলো হুবহু নাও থাকতে পারে অথবা অন্যভাবে থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে এসডিজির সাথে সামঞ্জস্য রেখে আরও কিছু নির্দেশনা রাখা যেতে পারে। ‘দরিদ্র সহায়ক কৌশলপত্র ২০২০’ সংশোধিত সংস্করণে এটি সুস্পষ্ট করা হয়েছে।

নিরাপদ পানি সরবরাহ এবং স্যানিটেশন সুবিধা দেবার ক্ষেত্রে অতিদরিদ্র Target group খুঁজে বের করা একটি জটিল ব্যাপার। সেদিন বলেছিলাম খসড়া কৌশলপত্রটিতে যে গাণিতিক পদ্ধতির কথা বলা আছে সেটি ঠিকমত পরিচালনা করা গেলে আমরা সঠিক Target group কে খুঁজে বের করতে পারব বলে আমি মনে করি। এ কৌশলটি স্থানীয় সরকার এর Policy Support Branch, PSB ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন পর্যায়ে বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিবে। উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানসমূহের চেয়ারম্যান, মেম্বার ও কাউনসিলররাও এসবের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকবেন। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রভাব খাটিয়ে Target group এর বাইরে থেকে কেউ যাতে উপকারভোগী হিসেবে আসতে না পারে তা নিশ্চিত করার জন্য একটি মনিটরিং মেকানিজম কৌশলপত্রটিতে থাকা উচিত।

ভর্তুকি পরিচালনার ক্ষেত্রে National Cost Sharing Strategy for Water Supply and Sanitation in Bangladesh, 2012 অনুযায়ী প্রকল্পের সকল উপকারভোগীর মূল বিনিয়োগের ১০ শতাংশ ব্যয় বহন করার কথা। কিন্তু খসড়া কৌশলপত্রের প্রস্তাবনা অনুসারে গুচ্ছ বসতিতে বসবাসরত অতিদরিদ্রদের তা আর করতে হবে না। বরং সরকার সংশ্লিষ্ট প্রকল্প বা বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ, অতিদরিদ্রদের পক্ষে শতভাগ ভর্তুকি পরিশোধ করবে। এটি নিঃসন্দেহেই একটা ভাল উদ্যোগ। অবকাঠামো কি রকম হবে বা কি ধরনের প্রযুক্তি ব্যাবহার হবে সে ক্ষেত্রে বলা আছে এটা স্থানীয় বাস্তবতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। তবে এক্ষেত্রে শহরাঞ্চল, গ্রামাঞ্চল ও অন্যান্য বিশেষ এলাকার জন্য নূন্যতম স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করে দেয়া যেতে পারে।

বর্তমান কৌশলপত্রে অতিদরিদ্র পরিবারে প্রতিবন্ধী সদস্য থাকলে সে পরিবারকে ওয়াশ সুবিধা দেবার ক্ষেত্রে ওই পরিবারকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা আছে। এটি পুরো প্রস্তাবনাকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করেছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে কমিউনিটি ল্যাট্রিনগুলোতে প্রতিবন্ধীদের প্রবেশ ও ব্যবহারের উপযুক্ত ব্যবস্থা করার বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত। সে ক্ষেত্রে টার্গেট গ্রুপ নির্ধারণ করার সময়ই চাহিদা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

পানি ও স্যানিটেশনের সুবিধাগুলো পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ উপকারভোগী নিজেরাই করবে। এর ফলে রক্ষণাবেক্ষণ ভাল ও টেকসই হবে বলে আশা করছি। জন অংশগ্রহণের মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতায়নও হবে। কিন্তু কৌশলপত্রে পাড়ার বা মহল্লার যে নেতা এটি নিশ্চিত করবেন এবং রক্ষাণাবেক্ষণের জন্য যে চাঁদা তোলা হবে, তাঁরা যেন সেক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যাবহার না করেন তা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় মনিটরিং দরকার হতে পারে।কৌশলপত্রে যে সব এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন সুবিধা পৌঁছায়নি অর্থাৎ পৌঁছালেও সবাই পায়নি, সেসব এলাকায় স্যানিটেশনের জন্য স্বল্প সুদে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

নতুন সংশোধিত কৌশরপত্রে পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশনের মৌলিক সেবার নূন্যতম স্তর, ভর্তুকি পরিচালনা পদ্ধতি, অতিদরিদ্র পরিবার ও গুচ্ছ বসতি চিহ্নিতকরণে যে সুস্পষ্ট গাইড লাইন দেওয়া হয়েছে তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। আমরা খুবই আশাবাদী যে বাংলাদেশ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন সেক্টরের জন্য ‘দরিদ্র সহায়ক কৌশলপত্র ২০২০’ নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন সুবিধা বঞ্চিত অতিদরিদ্রদের কাছে উক্ত সুবিধাগুলো পৌঁছে দিতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

এদিকে আমরা একটা বিষয় খেয়াল প্রতি অর্থবছরেই জাতীয় বাজেটে পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিন খাতে বরাদ্দ বাড়ছে। এই বৃদ্ধিটা আরও দরকার বলে মনে করি। বিশেষ করে পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিন সুবিধা দেশের দুর্গম অঞ্চলগুলোতে নিশ্চিত করতে বাজেটের আরও অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন রয়েছে।

 

 

লেখক: বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। Email: dratiur@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here