পহেলা বৈশাখের ইতিকথা

স্টাফ রিপোর্টার :: বাঙালির ঐতিহ্যের অন্যতম বড় উৎসব পহেলা বৈশাখ। বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবে পালন হয় এটি। সারা দেশ উৎসবের আমেজে ছেয়ে যায়। একদিনে আমাদের এই উৎসব উৎযাপনে আজকের ভাবধারা তৈরি হয়নি। সেটি বলতে গেলে ইতিহাসেরও ইতিহাস।

আর একটি পয়লা বৈশাখ পার হবো  আমরা। গোটা বছরটায় বাঙালিয়ানা অনেকেই আমরা বজায় না রাখতে পারলেও ঐ দিনটি কিন্তু আপাদমস্তক বাঙালিয়ানার দিন। তা পাঞ্জাবী-শাড়ি  দিয়েই হোক অথবা রবি ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ’ গেয়েই হোক। অথচ এই নববর্ষের দিন কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আজ তারিখ কত? উত্তর মিলবে, সে কি! আজ তো পয়লা বৈশাখ। আর সালটা বলুন তো? তখনই উত্তরে দ্বিধা– ঐ তো ১৪-শ, ১৫-শ বা ১৬-শ কিছু একটা হবে। অত কি আর মনে থাকে?

বঙ্গদেশ বা বাংলা বহু প্রাচীন। বাংলা ভাষাও কয়েক শতাব্দীর পুরোন। কিন্তু পয়লা বৈশাখকে বাংলা নববর্ষ হিসেবে পালনের ধারা ততদিনের নয়। এবার ১৪২২ শেষ হচ্ছে । কিন্তু এই সালের গণনা কি অতকাল আগে থেকে চলছে? বহু গবেষণা হয়েছে এবং এখনও চলছে এ নিয়ে। তবে কোন গবেষকই যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ সহ এর সূচনাকাল বলতে পারেন নি এখনও পর্যন্ত। তবে বিভিন্ন গবেষকের মত থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে বাংলা সনের গণনা শুরু হয়েছে অনেক পরে। কিন্তু গণনার শুরু ঠিক কোন সনে সেই সংশয় দূর হয় নি। কারও কারও মতে, সপ্তম শতাব্দীতে জুলিয়ান ক্যালেণ্ডার মতে সোমবার ১২-ই এপ্রিল বা গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডার মতে ১৪-ই এপ্রিল ৫৯৪ সনে গৌড়ের রাজা শশাঙ্কই (৫৯৩-৬৩০ খ্রীষ্টাব্দ) বাংলা সনের বা বঙ্গাব্দের প্রবর্তক। অন্য এক দল গবেষকের মতে, এই কৃতিত্ব সুলতান শাহ্ অথবা ভারত সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রীষ্টাব্দ)। তবে আকবরের পক্ষেই মত দেন বহু গবেষকই।

তাঁরা নিশ্চিত যে তাঁর সময় থেকেই বাংলা সন গণনা শুরু হয়। এটাকে সম্রাটের খেয়াল বা মর্জি হিসেবে ভাবা হয় না। বরং এর মধ্যে তাঁর বিজ্ঞানমনস্কতা, সংস্কারমুখী মন ও প্রজাদরদেরই পরিচয় মেলে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতো ব্যক্তিত্বও এই মতই সমর্থন করায় বিষয়টি অন্য গুরুত্ব পেয়েছে।১৯৯৮ সালে দিল্লীতে এক ভাষণে বিগত শতাব্দীর মূল্যায়ণ প্রসঙ্গে তিনি আকবরকেই বাংলা সনের প্রবর্তক বলে মেনে নেন। সম্রাট আকবরের রাজ্যাভিষেকের বছর থেকেই বাংলা সন গণনা শুরু হয়। আবুল ফজলের আইন-ই- আকবরী গ্রন্থে ইলাহী অব্দ সম্পর্কে লেখা আছে যে আকবর বহু দিন ধরে হিন্দুস্থানের বিভিন্ন অঞ্চলে দিন গণনার সমস্যাকে সহজ করার উদ্দেশ্যে নতুন বছর ও মাসের প্রবর্তন করতে চান। তিনি হিজরী অব্দ ব্যবহারের বিরোধী। আকবরের পরামর্শদাতা ও তাঁর দরবারের সবচেয়ে বড় জ্যোতিষশাস্ত্র বিশারদ আমির ফতেউল্লা সিরাজির চেষ্টায় এই নতুন অব্দ বা সনের প্রবর্তন হয়।

মুঘল আমলে হিজরী অব্দ অনুসারে রাজ দরবারে কাজকর্ম হ’ত। কিন্তু হিজরী অব্দের দিণক্ষণ, মাস ইত্যাদি চাঁদের বা চন্দ্রকলার হ্রাস বৃদ্ধির ভিত্তিতে গণনা করা হ’ত। তার ফলে সূর্যের গতির ভিত্তিতে বা সৌর পদ্ধতিতে গণনার সঙ্গে প্রতি বছর অনেকটা ফারাক থেকে যেত। একটি চান্দ্র সাল এক বছর অন্তর ১০ থেকে ১১ দিনে পিছিয়ে যায়। তার ফলে প্রতি ৩২ থেকে ৩৫ বছরে একটি ক’রে বছর বাড়তি হয়ে যায়। হিজরী সালের এই দুর্বলতার জন্য রাজস্ব বা খাজনা আদায় সহ বিভিন্ন কাজে সমস্যা হ’ত। মূলত এই কারণেই আকবরের এক সময় অনাস্থা জন্মায় এই হিজরী অব্দ অনুযায়ী রাজকার্য পরিচালনায়। তাঁর রাজত্ব কালে হিজরী সাল সহস্রাব্দের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল।

একই সঙ্গে পৃথিবীর অন্য সালগুলিরও সংস্কারের খবর আকবরের নজরে আসে। সেই মতো চান্দ্র সাল থেকে সৌর সাল অনুযায়ী গণনার সিদ্ধান্ত নেন তিনি, আর তা থেকেই বঙ্গাব্দের শুরু। যদিও বঙ্গাব্দ শব্দটির ব্যবহার অনেক পরে হয়। তখন ‘সন’ বলা হ’ত। ভারতবর্ষ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষকের ফসল ঘরে ওঠার উপরেই সরকারের রাজস্ব, খাজনার আদায় নির্ভর করত। কিন্তু হিজরী অব্দ চন্দ্রের গতি প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল বলে সব সময় কৃষিকার্যের সঙ্গে দিন ক্ষণ মিল’ত না। ফলে যে মরশুমে সে ভাবে ফসলই ফল’ত না তখনও খাজনা বা কর দেওয়ার জন্য প্রজাদের বাধ্য করা হ’ত। সেই অবস্থা থেকেই মূলত কৃষকদের রক্ষা করার অভিপ্রায় নিয়েই সৃষ্টি হয় বঙ্গাব্দ। তাই ফসল ওঠার সময়টিকেই বছরের সূচনা কাল স্থির করা হয়। এই জন্য নতুন অব্দকে ‘ফসলী সন’ নামেই লোকে বেশী চিনত।

এবার আসি এপ্রিল মাসে বাংলা বছর শুরুর ইতিহাসে। ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দে আকবরের রাজ্যাভিষেক হয়। অনেক গবেষকের মতে, ১৪-ই এপ্রিল, সম্রাট আকবরের রাজ্যাভিষেকের দিনটিকে স্মরণীয় ক’রে রাখতেই ঐ দিনটিকে নতুন সনের প্রথম দিন ধার্য করা হয়। সনটি শুধু বাংলার জন্যই নয়, চালু হয়েছিল গোটা ভরতভূমির জন্যই। পরবর্তী কালে বাংলা বাদে বাকি অংশে এই সনের জনপ্রিয়তা হারিয়ে যায়।

যার ফলে আকবর প্রবর্তিত নতুন অব্দ বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ হিসেবেই গণ্য হ’তে থাকে। অর্থাৎ বাংলা সন গণনা চলছে মাত্রই সাড়ে চারশো বা ঠিক বলতে গেলে ৪৫৬ বছর ধরে ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দ থেকে হিসেব ধরে। তা হ’লে প্রশ্ন আমরা করতেই পারি এবার তা হ’লে ১৪২২ সন পেরলো কী করে? গবেষকরা জানাচ্ছেন ১৫৫৬ সালে নতুন সৌর সনের শুরু হ’লেও তার ভিত্তিবর্ষ ৯৬৩-৬৪ বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়। সেই সময়ে অর্থাৎ ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দের সঙ্গে তত্‍‌কালীন হিজরী অব্দের তফাতের (৫৯৩-৫৯৪ বছর) ভিত্তিতেই ঐ গণনা করা হয়েছিল। লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে খ্রীষ্টাব্দের সঙ্গে বঙ্গাব্দের তফাৎ ৫৯৩-৫৯৪ বছর।

কোন কোন গবেষক বলেন সম্রাট আকবরের রাজ্যাভিষেকের দিনটি ছিল ১৪-ই ফেব্রুয়ারী, ১৪-ই এপ্রিল নয়। তা হ’লে রাজ্যাভিষেকের দিনের স্মরণের যুক্তি খাটে না। তাঁদের মতে, সেই আমলে বঙ্গদেশে সৌর শকাব্দের প্রচলন ব্যাপকতা লাভ করেছিল। তার ফলে আকবরের প্রবর্তিত নতুন সনের বছর-পয়লা দিনটি ঐ শকাব্দের দ্বারা প্রভাবিত হ’য়ে পড়ে। শকাব্দ আরম্ভ হয় সূর্য মেষ রাশিতে যখন অবস্থান করে, অর্থাত্ মেষ সংক্রান্তির পর। সময়টা এপ্রিলের মাঝামাঝি বা বর্তমান বঙ্গাব্দের বৈশাখের গোড়ার দিক। সেই থেকেই নাকি বৈশাখের প্রথম দিনটিকে নববর্ষ হিসেবে ধরা হয়।

এই প্রসঙ্গে বলা যায়, ১-লা বৈশাখ মান্য হওয়ার অনেক আগে বাংলায় বৎসর-পয়লা বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম ছিল। একটা সময় অগ্রহায়ণই বা অঘ্রান মাসকেই মার্গশীর্ষ বা প্রথম মাস বলা হ’ত। ওই মাসেই অনুষ্ঠিত হ’ত গ্রাম বাংলার সব চাইতে আনন্দের উৎসব নবান্ন।
এই পয়লা বৈশাখ বা নববর্ষ উত্‍‌সবটি পালিত হ’য়  বাংলাদেশের জাতীয় উৎসব হিসেবে , যার সূচনা হয়েছিলো ১৯৬৫ সালে। ঢাকার রমনার ময়দানে আজও পালিত হ’য় একই আবেগে , একই আন্তরিকতার সঙ্গে। এটি আমাদের প্রাণের উৎসব। সারাদেশে ঘটা করে পালিত হয়। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা শুভ হোক, ভাল থাকুক সবার সুখস্বপ্ন, বেঁচে থাকুক আমদের সংস্কৃতি।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here