শাহীদুল ইসলাম আপন :: আঠারো আমার চেতনা, আঠারো আমার প্রেরণা।এই স্লোগানে গড়ে উঠেছিলো স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন।আর এই আন্দোলনই ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ছাত্র আন্দোলন। আজ ২৯ জুলাই সেই আন্দোলনের ২য় বছর পূর্ণ হলো। আঠারোর সেই রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের পর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়ে ওঠে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন – নিসআ। এটি একটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক নিরপেক্ষ ছাত্র সংগঠন। আজ মনে পড়ে যায় আমিও সেই আন্দোলনকারীদের একজন ছিলাম। আজ থেকে ঠিক দুই বছর আগে শহীদ রমিজ উদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের সামনে এমইএস বাস স্টপে জাবালে নূর বাসের রেষারেষিতে প্রাণ যায় রাজীব, দিয়া নামের দুই শিক্ষার্থীর। আমার কলেজের ছোট ভাই-বোনের মৃত্যুর কথা আমার মনে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল সে সময়। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। ভাই-বোনের মৃত্যুর বিচারের দাবীতে সকলের সাথে আমিও শামিল হয়েছিলাম সেদিন।
.
দিয়া-রাজীব হত্যার ঘটনার বিচার চেয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দাবী জানিয়েছিল। তাদের সেই দাবীগুলোকে একত্রিত করে ৩০ জুলাই জাতির উদ্দেশ্যে গণমাধ্যমের সামনে ঐতিহাসিক ৯ দফা দাবী জানিয়েছিলাম। তারপর থেকেই সারাদেশে সকল শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমে গিয়েছিল ভাই-বোন হত্যার বিচারের দাবীতে। আমাদের ৯ দফা ছিলো সর্বজনগ্রাহ্য। খোদ প্রধানমন্ত্রী সহ সকল রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ আমাদের ৯ দফা দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন। আমাদের দাবীগুলোর মূল পয়েন্ট একটাই ছিলো সড়কের নিরাপত্তা। সড়ক কীভাবে নিরাপদ রাখা যায়, কীভাবে সড়কে প্রাণহানি কমানো যায় সেদিকটা ভিত্তি করেই ছিল আমাদের সব দাবিদাওয়া।
.
কিন্তু আজ আন্দোলনের দুই বছর পর এসেও মনে হচ্ছে আসলে শিক্ষার্থীরা যে নিরাপদ সড়কের জন্য লড়াই করেছিল, যে সড়কের বিশৃঙ্খলা কমানোর জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল, সে সড়ক আজও অরক্ষিতই রয়ে গেছে। সড়ক আন্দোলন চলাকালীন সময়ে কোমলমতী শিক্ষার্থীদেরকে থামানোর জন্য এক শ্রেনীর সন্ত্রাসীরা বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছিল। সেই হামলায় আহত হয়েছিল অনেক ছাত্র-ছাত্রী। কেউ কেউ আবার পঙ্গুত্বও বরণ করেছিল। সেই সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে গণমাধ্যমে বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনোরকম আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অথচ ঠিকই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেরকে বিনা অপরাধে মামলার পর মামলা দিয়ে তাদের জীবন বিষিয়ে তোলা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন সেসব মামলা আজও চলমান।
.
সড়কে যাদের প্রভাব সবচেয়ে বেশী তারা হচ্ছেন পরিবহন শ্রমিক। তারা চাইলেই সড়কে চলাচলকারী যাত্রীদের দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। আবার তাদের অদক্ষতার কারণেই পিষে ফেলতে পারেন যাত্রীদের। আন্দোলনের সময় পরিবহন শ্রমিকরা তাদের লাইসেন্স চেক করার কারণে সারাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল করে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় সাধারন যাত্রী থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের মুখে আলকাতরা মাখিয়ে দিয়েছিলেন তাদের অব্যবস্থাপনার নিয়ে কথা বলার কারণে। সারাদেশে ৭০ লক্ষ পরিবহণ শ্রমিক ড্রাইভিং পেশার সাথে জড়িত। কিন্তু আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে চালকদের দক্ষ করে তোলার জন্য কোনো প্রশিক্ষণ ইনস্টিউট গড়ে তোলা হয়নি। তাদের তদারকি করার জন্য কোনো মহল থেকে উপর্যুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এ দায়ভার আসলে কাদের !
.
আপনারা অনেকেই জানেন সম্প্রতি লকডাউনে সবচেয়ে বেশি কষ্টে ছিলেন পরিবহন শ্রমিকরা। সড়ক আন্দোলনকারীদের সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম নিসআ নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। সারাদেশে পরিবহন শ্রমিকদের দরজায় পৌঁছে দিয়েছি খাবারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। অথচ বছরের পর বছর তাদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া শ্রমিক নেতাদের দেখা মেলেনি এই সময়ে। বরং শ্রমিকদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তারা। কিন্তু যখন ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টা এলো, তখন কোন অজানা গর্ত থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এলো সব নেতা। এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে পরিবহন শ্রমিকদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বছরে ২০০০ কোটি টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। চিন্তা করতে পারেন অনানুষ্ঠানিক এমাউন্ট কতো হবে! তাও শ্রমিকদের দুরবস্থার সময় তথাকথিত শ্রমিকনেতাদের নির্লিপ্ততা আমাদের অবাক করেছে। আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করেছি। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা কিছুই ছিলো না।
.
নিসআতে শিক্ষার্থীরা নিজেদের হাত খরচের টাকা জমিয়ে দেশের নিরাপদ সড়ক বিনির্মানে কাজ করে যাচ্ছে। যাদের একমাত্র চাওয়া হচ্ছে সড়কের নিরাপত্তা। সড়কে বাসের রেষারেষি বন্ধ করতে মরিয়া হয়ে কাজ করে যাচ্ছে তারা। যদি কেউ আসলে তাদের জিজ্ঞেস করেন, কি লাভে বা কিসের আশায় তারা এ কাজ করে যাচ্ছে, একটায় উত্তর পাবেন সড়কের নিরাপত্তা। তাদের আর কোনো ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন কাউকে যেন আর সড়কে যানবাহনের অসুস্থ প্রতিযোগীতায় বলী হতে না হয়, সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে।
.
এ দেশের যত বড় বড় সমস্যার সমাধান হয়েছে তা ছাত্রদের দ্বারাই সম্ভব হয়েছে। দেশের সড়কের নিরাপত্তা বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের চাওয়া। এবং সেই লক্ষেই দেশের সড়ক নিরাপদ করণে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমরা বিশ্বাস করি আমরা যদি সঠিকভাবে সড়কের আইন মেনে নিজেরা সচেতন হয়ে রাস্তায় চলাচল করি তাহলে একদিন না একদিন ঠিকই আমাদের সড়ক নিরাপদ হবে।
.
প্রতিনিয়ত সড়কে যাদের প্রাণ হারাতে হচ্ছে, যারা সড়কের ভয়াল ছোবলে পঙ্গুত্ব বরণ করছে আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে তাদের স্মরণ করছি। সড়কে যেন আর কোনো ভাই/বোনের প্রাণ হারাতে না হয় সেটাই আমাদের একমাত্র চাওয়া।
.
পরিশেষে একটি কথায় বলতে চাই, আমরা সড়কের জন্য আন্দোলন করলেও আমাদের প্রাপ্তির থেকে অপ্রাপ্তির পাল্লায় বেশী ভাঁড়ি। তাই আসুন আমরা সবাই দেশের নিরাপদ সড়ক বিনির্মানে কাধে কাধ লাগিয়ে একসাথে কাজ করি। দেশের সড়ক নিরাপদ করে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলি।
.
.
.
লেখক: যুগ্ম আহব্বায়ক, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন (নিসআ)-২০১৮