নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) এর প্যানেল মেয়র পদে নিজেদের পছন্দের কাউন্সিলারদের মনোনীত করতে তৎপর হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী দুই রাজনীতিক সহোদর। তাদের একজন হলেন নারায়ণগঞ্জ-৫ (শহর-বন্দর) আসনের এমপি ও জাতীয় পার্টির (এ) প্রেসিডিয়াম মেম্বার নাসিম ওসমান ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের সমর্থন পেয়েও বিপুল ভোটে পরাজিত আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমান।
অভিযোগ উঠেছে এ সহোদর চাইছেন, সিটি করপোরেশনে মেয়রের অবর্তমানে দায়িত্ব পালন করা প্যানেল মেয়র পদে নিজেদের কাউন্সিলার অধীষ্ট করে মেয়রের উপর চাপ প্রয়োগ করতে। তাদের পছন্দের কাউন্সিলরার ইতিমধ্যে অন্য কাউন্সিলারদের নানা ভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন। তাছাড়া এ দু’সহোদরের ঘনিষ্টজনেরাও এ ব্যাপারে বেশ আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছেন। তারা অন্য কাউন্সিলারদের সমর্থন ও ভোট নিশ্চিত করতে নানা ধরনের উপঢৌকন প্রদানের প্রস্তাব দিতে শুরম্ন করেছে। প্রসত্মাবকৃত উপঢৌকন এর মধ্যে রয়েছে মোটা অংকের নগদ অর্থ, মোবাইল সেট, ল্যাপটপ ইত্যাদি। প্যানেল মেয়র পদে আগ্রহী কাউন্সিলারা নিজেরা সরাসরি ও অনেক ক্ষেত্রে শুভাকাঙ্খী মাধ্যমে এসব উপঢৌকনের প্রস্তাব দিয়ে অন্যদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন।
গত ৩০ অক্টোবর সিটি করপোরেশন এর এ নির্বাচনের আগে শামীম ওসমানের বড় ভাই নাসিম ওসমান নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, ‘৩০ অক্টোবর নির্বাচনে রাত ৭ মধ্যেই ফলাফল হয়ে যাবে। এতে আইভী পাবেন মাইনাস ৫ হাজার ভোট আর শামীম ওসমান বিপুল ভোটে জয়ী হবেন।
নির্বাচনে বহু নাটকীয়তার পর আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছিলেন বহুল সমালোচিত নেতা শামীম ওসমান। কিন্তু তিনি এ নির্বাচনে বিপুল ভোটে পরাজিত হয় দলের বিদ্রোহী প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াত আইভীর কাছে। নির্বাচনের আগে শামীম ওসমানের ভোট বাড়াতে এমপি নাসিম শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেরি সার্ভিস, গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা সহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড করে নির্বাচন কমিশনের শোকজের শিকার হন।
আগামী ২৭ ডিসেম্বর প্যানেল মেয়র পদে ৩ জন মনোনীত হবে। পৃথক ৩টি প্যানেল মেয়র পদে ৯জন প্রতিদ্বন্দীতা করছেন। একের অধিক প্রার্থী হওয়ায় সিটি করপোরেশন এর ২৭টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলার ও সংরড়্গিত ৯টি নারী আসনের ৯ জন কাউন্সিলার গোপন ভোট দিয়ে ৩ জন প্যানেল মেয়র মনোনীত করবেন। ৩টি প্যানেল মেয়র এর মধ্যে প্যানেল মেয়র-১ ও প্যানেল মেয়র-২ এ থেকে একজন করে ২ জন কাউন্সিলার ও প্যানেল মেয়র-৩ এ একজন নারী কাউন্সিলার মনোনীত হবেন। ২৭ ডিসেম্বর সিটি করপোরেশন এর প্রথম সভায় এ প্যানেল মেয়র পদে এ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হবে। এ সভার ৭ নাম্বার এজেন্ডায় প্যানেল মেয়র নির্বাচনের বিষয়টি রাখা হয়েছে।
প্যানেল মেয়র-১ এর জন্য এখন পর্যন্ত ৩ জনের নাম শোনা যাচ্ছে। তারা হলেন- সদ্য বিলুপ্ত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্যানেল মেয়র ও সিটি করপোরেশন এর ১৬ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলার ওবায়েদ উলস্নাহ, সাবেক প্যানেল মেয়র ও সিটি করপোরেশন এর ১৩ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলার মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ ও ৪ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলার নূর হোসেন। এ ৩ জনের মধ্যে নূর হোসেন সাবেক এমপি শামীম ওসমানের ঘনিষ্টজন। গত ১০ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলড়্গ্যে শামীম ওসমানের শো ডাউনে নূর হোসেন বিপুল সংখ্যক লোক সমাগম করেছিল। বিগত আওয়ামী লীগ সময়ের দুর্ধর্ষ এ সন্ত্রাসী এবারও নিয়ন্ত্রন করছে সিদ্ধিরগঞ্জের বিভিন্ন সেক্টর। গত ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শণ সহ কালো টাকা ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে নূর হোসেনের বিরম্নদ্ধে। এছাড়া নূর হোসেন কাঁচপুর সেতুর নিচে অবৈধ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, শিমরাইল মোড়ে যানবাহন হতে চাঁদা আদায় সহ এলাকায় নানা অভিযোগ রয়েছে। সে এখন নিয়ন্ত্রন করেছ সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পরিবহন সেক্টর, আনত্মঃজেলা ট্রাক টার্মিনাল, নারায়ণগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের শিমরাইল অফিস, সিদ্ধিরগঞ্জ ইউপি পরিষদের সকল ঠিকাদার কাজ। সিদ্ধিরগঞ্জে মাদকের একটি বিশাল সেক্টর নিয়ন্ত্রনেও অভিযোগ রয়েছে। নূর হোসেনের বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লা থানায় বিভিন্ন অপরাধে ১৩টি মামলা রয়েছে। তবে বেশীরভাগ মামলায় তিনি জামিনপ্রাপ্ত। ২০০৭ সাল থেকে প্রার্থী নূর হোসেনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের রেড ওয়ারেন্ট জারি ছিল। গত মার্চ মাসে ইন্টারপোলে নূর হোসেনের বিরুদ্ধে থাকা ওয়ারেন্ট উহ্য করে নেয়।
প্যানেল মেয়র পদে আগ্রহীদের মধ্যে ওবায়েদ উল্লাহ বিলুপ্ত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্যানেল মেয়র ছিলেন। তার সঙ্গে এমপি নাসিম ওসমানের ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। তাছাড়া আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী একটি অংশের সঙ্গেও ওবায়েদ উলস্নাহর রয়েছে গভীর সম্পর্ক। তারা চাচ্ছেন ওবায়েদউলস্নাহকে প্যানেল মেয়র করতে। প্রসঙ্গত ২০০৪ সালে ডা. সেলিনা হায়াত আইভীর বিরুদ্ধে বিলুপ্ত পৌরসভার ৯জন কাউন্সিলার ও ৩ নারী কাউন্সিলারের মধ্যে ১০ জন-ই অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিলেন। এ ১০ জনের নেতৃত্বে ছিলেন ওবায়েদ উলস্নাহ। তখন ওবায়েদ উলস্নাহ বিভিন্ন পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে আইভীর তীব্র বিষোদগার করে বলেছিলেন, আইভী একজন চরম দুর্নীতিবাজ। তার অধীনে নারায়ণগঞ্জ শহরের উন্নয়ন কোনভাবেই সম্ভব না। দীর্ঘদিন ওবায়েদ উল্লাহ মন্ত্রনালয় সহ বিভিন্ন স্থানে আইভীর বিরম্নদ্ধে অভিযোগ দিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন ওবায়েদ উলস্নাহ। প্রসঙ্গত ২০০৩ সাল হতে গত জুন পর্যনত্ম বিলুপ্ত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা এলাকায় বিপুল উন্নয়ন হয়েছে।
মাকছুদুল আলম খোরশেদ নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুবদলের সাধারণ সম্পাদক। তিনি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে সরে দাঁড়ানো জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকারের ছোট ভাই। ২০০৪ সালে আইভীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের ঘটনায় খোরশেদ ঘোর বিরোধীতা করে আইভীর পড়্গে নিয়েছিলেন। এছাড়া শহরের নিতাইগঞ্জ এলাকায় অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ড উচ্ছেদ ও পৌর সম্পত্তি অবৈধ দখলমুক্ত করার নানা ঘটনার ঘটনার অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন তিনি।
প্যানেল মেয়র -২ এর জন্য চেষ্টা করছেন ১৮ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলার মো: কামরম্নল হাসান মুন্না, ২ নং ওয়ার্ডের নজরম্নল ইসলাম ও ২৪ নং ওয়ার্ডের আফজাল হোসেন। তাদের মধ্যে নজরুল ইসলাম সিদ্ধিরগঞ্জের আলোচিতদের একজন। সে সাবেক এমপি শামীম ওসমানের ঘনিষ্টজনদের একজন। গত মে মাসে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এর গেজেট প্রকাশের পর হাইকোর্টে একটি রিটের বিরোধীতা করে নজরম্নল শহরে শামীম ওসমানের পক্ষে শো ডাউন করে। র্যাব আর পুলিশের খাতায় নজরুল একজন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। সে একটি হত্যা মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী। তবে সে মামলাটি বর্তমানে আদালতে স্থগিত রয়েছে। সিদ্ধিরগঞ্জের আলোচিত এ ব্যক্তি গত ফেব্রুয়ারীতে মানবজমিনের স্টাফ রিপোর্টার বিল্লাল হোসেন রবিনকে মারধর ও তাকে পিস্তল ঠেকিয়ে হত্যার চেষ্টা করেছিল। সিদ্ধিরগঞ্জে অবস্থিত আদমজী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (এইপিজেড) সহ বিভিন্ন স্থানে নজরুল প্রভাব বিস্তার করছে। তার বিরুদ্ধে হত্যা সহ বিভিন্ন আইনে ১২টি মামলা রয়েছে। তবে সবগুলো মামলায় সে জামিনপ্রাপ্ত।
প্যানেল মেয়র প্রার্থী আফজাল হোসেন জাতীয় পার্টির (এ) বন্দর উপজেলা নেতা। সে নারায়ণগঞ্জ-৫ (শহর-বন্দর) আসনের এমপি ও জাতীয় পার্টির সভাপতি মন্ডলীর সদস্য নাসিম ওসমানের ঘনিষ্টজন। কামরুল হাসান মুন্না ২০০১ সালের ১৬ জুন চাষাঢ়ায় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বোমা হামলায় নিহত ছাত্রলীগ নেতা সাইদুল ইসলাম বাপ্পীর আপন ছোট ভাই। সে আইভীর ঘনিষ্টজন হিসেবেই পরিচিত।
আর প্যানেল মেয়র-৩ (নারী) এর জন্য চেষ্টা করছেন ৫ নং আসনের শারমিন বিন্নী, ৬ নং আসনের খোদেজা খানম নাসরিন ও ৮ নং আসনের ইসরাত জাহান খান স্মৃতি। তাদের মধ্যে স্মৃতি নারায়ণগঞ্জ জেলা মহিলা লীগের নেত্রী। সে শামীম ওসমানের আস্থাভাজন।
প্রসঙ্গত গত ৩০ অক্টোবর সিটি করপোরেশন এর নির্বাচনে বহু নাটকীয়তার পর আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছিলেন বহুল সমালোচিত নেতা শামীম ওসমান। কিন্তু তিনি এ নির্বাচনে বিপুল ভোটে পরাজিত হয় দলের বিদ্রোহী প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াত আইভীর কাছে। এ নির্বাচনে ২৭টি ওয়ার্ডে ২৭ জন কাউন্সিলার ও ৯টি সংরক্ষিত নারী আসনে ৯ নারী কাউন্সিলার নির্বাচিত হয়েছেন।
ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/মাকসুদুর রহমান কামাল/নারায়ণগঞ্জ