থাকবে নাগরদোলা সহ উৎসবের আমেজ। দোকান পাট বসিয়ে সেখানে নানা ধরনের পসরা বিক্রি হবে। নানা বয়সী লোকজনের ঢল থাকবে। মেলা বলতে অনেকেই এ চিত্রকেই বুঝায়। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে এখন বদলে গেছে মেলার সে চিত্র। এখানে মেলার নামে চলছে বেহালস্নপনা সহ অশস্নীল কাজ আর জুয়ার রমরমা আসর। এখানকার মেলায় এখন চলছে লটারীর নামে নিম্নবিত্তদের কাছ থেকে টাকা চুষে নেওয়া, পুতুল নৃত্যের নামে নারীদের অশস্নীল দেহ প্রদর্শন সহ নানা কিছু। তবে এতকিছুর মধ্যেও বিশেষ দিনে জেলার কয়েকটি স্থানের কিছু মেলা এখনো সে ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। তবে সে ঐতিহ্যও হারিয়ে যেতে বসেছে বর্তমানের আধুনিক বেহালস্নাপনার মেলার ভীড়ে।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে প্রায় সময়েই জেলার বিভিন্ন স্থানে চলছে বেহালস্নপনার মেলা। অনেকে এ মেলাকে অশস্নীলতার হাট বলে মনত্মব্য করেন। এসব মেলা আয়োজকরা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে প্রকাশ্যে চালাচ্ছে মেলার কার্য্যক্রম। এ ধরনের মেলার বিরম্নদ্ধে এলাকার লোকজন সোচ্চার হলেও প্রভাবশালীদের ভয়ে তাদের নতজানু হয়ে থাকতে হচ্ছে। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইল এলাকায় চলছে জমজমাট মেলা। অভিযোগ রয়েছে, এ মেলা থেকে পুলিশ ও জেলা প্রশাসন প্রতিদিন মোটা অংকের টাকা আদায় করে নিচ্ছে।
বৃহস্পতিবার রাতে মেলায় সরজমিনে দেখা গেছে, মেলার প্রবেশ পথে ১০-১২টি বিভিন্ন ধরনের দোকান রয়েছে। তবে এখানে নেই ক্রেতাদের কোন ভীড়। সকলে ছুটছে মেলার ভিতরের দিকে। সেখানে দেখা গেছে ৭-৮টি ঘরের ভেতর ও বাইরে প্রচুর মানুষের ভীড়। কাছে গিয়ে দেখা গেল, এসব ঘরের বাইরে কাপড়েরর বেষ্টনী দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। ভেতরে জুয়ার বোর্ড বসিয়ে চলছে রমরমা আসর। প্রায় ২০ মিনিট সেখানে অবস্থান করে দেখা গেছে, প্রতিটি বোর্ডে হাজার হাজার টাকা দিয়ে জুয়া খেলছে বিভিন্ন বয়সী পুরম্নষ। তাদের বেশীরভাগই শ্রমজীবি।
কাশেম মোলস্না নামের এক রিকশাচালক জানান, তিনি গত ৩দিন প্রায় ২ হাজার টাকা নষ্ট করেছেন এ জুয়া খেলে। তার প্রত্যাশা ছিল পরের বার জুয়া খেলে টাকা ফেরত পাবে। এ আশাতেই একে একে তার ২ হাজার টাকা খরচ গেছে।
কথা হয় একটি গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক আলেক মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, মেলার মূল আকর্ষণ এ জুয়া খেলা। প্রতিদিন বিকেল থেকে গভীর এমনকি ভোর রাত পর্যনত্ম চলে এখানে জুয়ার আসর।
মেলায় বাদাম বিক্রেতা আশরাফ জানান, এ মেলায় প্রতিদিন অনত্মত ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার জুয়া খেলা হয়। অনেকে টাকা পাওয়ার আশায় এখান থেকে সর্বশানত্ম হয়ে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।
এদিকে মেলার একদিকে চলছে পুতুল নৃত্য। এ নৃত্য মঞ্চের বাইরে শত শত মানুষের ভীড়। তাদের কয়েকজন জানান, প্রতিদিন তারা এ নৃত্য দেখতে আসে। তারা জানান, ২০ টাকার টিকেটে মঞ্চে প্রবেশ করতে হয়। মঞ্চে প্রথম দিকে পুতুল নৃত্য দেখানো হলেও পরে চলে নারীদের অশস্নীল নৃত্য। শর্ট পোশাক পড়ে বিভিন্ন বয়সী নারীরা গানের সঙ্গে নেচে গেছে বেহালস্নাপনা করে। প্রদর্শন করে তাদের নগ্ন শরীর।
মেলার এক দোকানদার জানান, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ নৃত্য দেখতে মানুষের ভীড় বাড়তে থাকে। গভীর রাতে চলা নৃত্যগুলোতে সবচেয়ে বেশী অশস্নীলতা হয়।
এ দোকানদার আরো জানান, প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই চলছে এ মেলা। এ কারণেই কোন সমস্যা হচ্ছে না। সরজমিনে এ অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। রাত পৌনে ৯টায় জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের এক কর্মকর্তাকেও সাদা পোশাকে মেলায় প্রবেশ করতে দেখা। তাকে পরে মেলা কর্তৃপড়্গের সঙ্গে কথা বলতেও দেখা যায়।
মেলায় প্রতিরাতে চলছে জমজমাট লটারী। ১০ টাকার লটারী কিনতে মানুষ ভীড় করছে মেলা প্রাঙ্গনে। তাছাড়া রিকশায় মাইকিং করেও চলছে মেলার লটারী বিক্রি। মেলায় লটারী বিক্রেতারা জানান, এখানে প্রতিদিন কমপড়্গে ২ থেকে ৩ লাখ টাকার লটারী বিক্রি হয়। সাধারণ মানুষ এসব লটারী কিনছে। লটারীতে পুরস্কার হিসেবে কখনো দেওয়া হচ্ছে নগদ টাকা, কখনো বা দেওয়া হচ্ছে দামী অনেক পুরস্কার।
মেলায় লটারী কিনতে আসা গৃহিণী হেলেনা বেগম জানান, প্রথম পুরস্কারের ২০ হাজার টাকার লোভে তিনি ২০০ টাকার লটারী কিনেছেন।
স্থানীয়া জানান, লটারীর নামে মানুষের টাকা পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে। পুলিশ এ কাজে সরাররি সহায়তা করছে বলে অভিযোগ করে এলাকাবাসী। তিনি বলেন সারারাত উচ্চ শব্দে মাইক চালিয়ে মানুষকে ভোগানিত্মতে ফেলছে। এ মেলার অদুরেই অবস্থিত গোদনাইল এনায়েতনগর প্রাথমিক বিদ্যালয় ও এলিগেন্স কিন্ডারগার্টেন। মেলার মাইকিংয়ের কারণে এ দু’স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের লেখা-পড়া দারম্নণভাবে বিঘ্ন ঘটছে।
এদিকে যে স্থানে মেলা আয়োজন করা হয়েছে তার চারদিকে রয়েছে আবাসিক এলাকা। মেলায় মাইকের আওয়াজে এসব এলাকার লোকজনদের পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ আর বিড়ম্বনা। মেলার স্থল লগোয়া মানুষের দুর্ভোগ সবচেয়ে বেশী। এক গৃহিনী জানান, বিকেল হলেই মেলায় শুরম্ন হয় মাইকিং। সঙ্গে চলে গানবাজনাও। এতে করে সাধারণ মানুষের কষ্ট হচ্ছে। রাতে অশস্নীল কথার গান বাজার কারণে উঠতি বয়সী ছেলেদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া।
তবে এলাকাবাসীর যেন কিছুই করার নেই। এলাকার এক যুবক জানান, যেখানে প্রশাসন ম্যানেজ সেখানে তাদের মত সাধারণ মানুষের কিছুই করার নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৭দিন ধরে সিদ্ধিরগঞ্জের গোদানাইল এনায়েতনগর বালুর মাঠ এলাকায় ঈদ আনন্দমেলা নামে মেলার আয়োজন করে সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইল ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি এম এ বারী।
মেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রশাসনকে ম্যানেজ করতে তাদের দৈনিক খরচ দিতে হচ্ছে প্রায় ১ লাখ টাকা। টাকার একটি অংশ যাচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছেও। এ কারণেই তারা কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে না।
এদিকে সমপ্রতি এলাকাবাসী এ মেলায় চলা অশস্নীল নীত্য ও জুয়া খেলা বন্ধ করতে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের বরাবরে আবেদন করেছেন। কিন্তু প্রশাসন অনেকটা রহস্যজনক কারণে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হচ্ছে না।
সিদ্ধিরগঞ্জের পাশাপাশি রূপগঞ্জেও চলছে এ ধরনের মেলা। সমপ্রতি বন্দরে এ ধরনের একটি মেলা পন্ড করে দিয়েছে এলাকাবাসী।
নারায়ণগঞ্জ শহর উন্নয়ন কমিটির আহবায়ক এটিএম কামাল জানান, মেলার সেই ঐতিহ্য এখন বিলীন হতে চলেছে। এর মূল কারণ বাণিজ্যিকরণ। কারণ এখন প্রশাসন সুবিধা আদায় করতে অশস্নীলে ভরা মেলাগুলোরও অনুমোদন দিচ্ছে। এতে করে আমাদের উঠতি বয়সী ভবিষ্যত প্রজন্ম বিপদগামী হচ্ছে।
ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/মাকসুদুর রহমান কামাল/নারায়ণগঞ্জ