সোহানুর রহমান :: দুর্যোগে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ এবং সহিংসতার শিকার নারীর সুরক্ষার লক্ষ্যে তৃণমূলে কর্মরত উন্নয়ন সংস্থাগুলোর দক্ষতাবৃদ্ধিতে দেশব্যাপাী বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ’র আয়োজনে বরিশালে প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মধ্য দিয়েই এ উদ্যোগ আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছে। চলতি বছরেই আরো ৪টি স্থানে সরকার ঘোষিত দুর্যোগপ্রবণ ২২টি জেলায় কর্মরত বেসরকারি সংগঠনের কর্মকর্তাদের নিয়ে এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ধারাবাহিকভাবে আয়োজন করা হবে।
প্রতিবছরই বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙ্গন এবং ঘূর্নিঝড়ের মত নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে বাংলাদেশের জনগণ । আর দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন দেশের দরিদ্র ও গ্রামীণ নারীরা। এসময়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেয়া নারী ও কন্যাশিশুদের নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। অধিকাংশ আশ্রয়কেন্দ্রে শৌচাগারে ও বাথরুমের পৃথক ব্যবস্থা না থাকায় নানা স্বাস্থ্যগত সমস্যায় আক্রান্ত হন তারা।
ইউরিন ইনফেকশনসহ বিশেষত রজ:স্বলা নারীরা নিজেদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে যত্ন নিতে না পারায় বিভিন্ন রোগে ভুগে থাকেন। পুরুষদের সাথে একই কক্ষে নারী ও কিশোরীরা গাদাগাদি করে থাকতে গিয়ে যৌন হয়রানি থেকে শুরু করে কখনো ধর্ষণের মতো অনভিপ্রেত লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার হন তারা। লোকলজ্জা, অশিক্ষা ও নানা কুসংস্কারের কারনে মানবিকবিপর্যয়ের মুখোমুখি এসব ভিকটিম নারী ও কিশোরীদের নির্যাতনের কথা লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। বন্ধ থাকে প্রতিকারের পথ। এতে দুর্যোগকালীন সংকেত পেলেও নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেক নারীরাই আশ্রয়কেন্দ্রমুখী হতে অনীহা প্রকাশ করেন।
যার দরুণ দুর্যোগে পুরুষদের তুলনায় নারীদের মৃত্যু ঝুঁকি বেশি থাকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ৮৭ শতাংশ নারী জীবনের কোন না কোন সময়ে কোন না কোনভাবে নিজ গৃহে সহিংসতার শিকার হন। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্যোগের কারণে ক্ষতির শিকার মানুষের মধ্যে ৪ শতাংশ অন্তঃসত্তা নারী। গর্ভকালীন জরুরি পরিষেবার অভাবে সন্তান প্রসবকালে অনেক নারী ও কিশোরীর মৃত্যু হয়। অনেকে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত হন।
অ্যাকশনএইড বলছে, স্বাভাবিক সময়ে বিভিন্ন বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার নারীদের সংকট দুর্যোগ পরিসি’তিতে আরো বাড়ে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মেয়েশিশুদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে বাল্যবিয়ের হারও বেড়ে যায়। আর দুর্যোগে মানবিক বিপর্যস্ত এলাকায় লিঙ্গভিত্তিক সহিসংতার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে থাকে। তবে এক্ষেত্রে নারীরাই বেশি সহিংসতার শিকার হন। পক্ষান্তরে দুর্যোগে নারীর ঝুঁকি ও বিপদপন্নতা সবচেয়ে বেশি থাকলেও দুর্যোগ মোকাবিলায় নারীর সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়াতে যথেষ্ট উদ্যোগ নেয়া হয় না। যেকোন পরিস্থিতিতে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে নারীর ক্ষমতায়নের বিকল্প নেই। আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নারীদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়গুলো বিশেষ বিবেচনায় রাখা উচিত। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিশেষ পদক্ষেপের পাশাপাশি এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সমন্বয় প্রয়োজন বলে মনে করছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মীরা।
জানতে চাইলে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ’র ব্যবস্থাপক কাশফিয়া ফিরোজ বলেন, দুর্যোগের সময় নারীরা নানাভাবে সহিংসতার শিকার হন। এমনকি ত্রাণ সংগ্রহের সময়ও সহিংসতার শিকার হন তারা। তাই দুর্যোগে সাড়া প্রদানে আমরা যারা কাজ করি তাদের পরিকল্পনার মধ্যে এই বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। এতে দুর্যোগে নারীকে তার প্রয়োজন অনুযায়ী সহায়তা করা সম্ভব হবে।
অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ বিশ্বাস করে, উদার, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র্র গঠনের জন্য ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ ও নারীর প্রতি সহিংসতামুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। এই বিশ্বাস থেকেই আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী কিভাবে দুর্যোগের সময় নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করা যায় সে বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কর্মরত তৃণমূলের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং এর কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই দুর্যোগকালীন লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধ বিষয়ক এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে সহযোগিতা প্রদান করছে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)।
এরই অংশ হিসেবে বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় ও দুর্যোগপ্রবণ চারটি জেলার (বরিশাল, পটুয়াখালি, ভোলা এবং বরগুনা) অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে ৫ দিনব্যাপি প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে । ১৪ টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ২৪ জন ব্যবস’াপনা পর্যায়ের কর্মী এই কর্মসূচিতে অংশ নেন। গত ৩০ সেপ্টেম্বর সকালে উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বরিশাল জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহানারা পারভীন শিল্পী।
এসময় তিনি বলেন, দুর্যোগে নারীদের সমস্যাগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে তার প্রতিকার করতে হবে। কারণ আমরা এমন সমাজ ও পরিবেশ চাই যেখানে নারী-পুরুষের অবাধ চলাচল ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
বরিশাল প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি আমজাদ হোসেন বলেন, দুর্যোগের বিভিন্ন ধরন ও প্রকার রয়েছে। অঞ্চলভেদে দুর্যোগের পার্থক্যও আছে। সেটা বুঝে সেই অনুযায়ী নারীদের সুরক্ষিত করতে আমাদের যথাযথ পরিকল্পনা করতে হবে। এজন্য আমাদের সকলকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। আর তার জন্য এখনই প্রকৃষ্ট সময়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক আবু সৈয়দ মোহাম্মদ হাশিম জানান, নারীর নিরাপত্তা ছাড়া দেশের উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী নারী-পুরুষ সমান সুবিধা পাবে। আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতিমালায় দুর্যোগে নারী ও কন্যাশিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও জোর দেয়ার কথা বলাহয়েছে। এছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলোতেও নারীদের যুক্ত করতে হবে। জাতীয় পর্যায়ের আলোচনা ও নীতিনির্ধারণে এই বিষয়গুলো নিয়ে আসতে হবে। নতুন করে যেসব আশ্রয়কেন্দ্র হতে যাচ্ছে সেখানে আমরা নারী ও পুরুষদের জন্য পৃথক ব্লক এবং টয়লেট ব্যবস্থা রাখছি। দুর্যোগকালীন সময়ে নারীর প্রতি হয়রানি ও সকল প্রকার সহিংসতা বন্ধে সকলকে একজোট হয়ে দেশজুড়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যুব সমাজ এক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে। এছাড়া নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে নারীদেরও আরো সোচ্চার এবং সচেতন হতে হবে। সমন্বিত প্রচেষ্টায় দুর্যোগকালীন সময়ে নারীর প্রতি সবধরনের সহিংসতা প্রতিরোধ করা সম্ভব।