ট্রান্সফার

    দুঃখানন্দ মণ্ডল 

১.

বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঋদ্ধিমান বাড়ি ফিরে ঠাম্মাকে বলে; ঠাম্মা তুমিই বলো তো; এই যে আমি কত আনন্দ করতে করতে ভিজে এলাম স্কুল থেকে, সেটা কি হতো যদি সামনের স্কুলে পড়তাম? সোনু আগে জামা প্যান্ট তাড়াতাড়ি খুলে ফেল ঠান্ডা লেগে যাবে। ঋদ্ধিমানকে তার ঠাম্মা সোনু বলে ডাকে। কে কার কথা শোনে! গোটা ঘরময় ভেজা পোশাকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সোনু আরে ঘর যে পুরোপুরি ভিজে গেল। এইবার তো খুলে ফেল! ঠাম্মা আমি কি বিছানায় উঠেছি? সব জল শুকিয়ে যাবে। তুমি একটু দাঁড়াও। আমি এখনি আসছি। আবার ছাদের গেট খুলে ভিজতে চলে যায় সে। সোনু এইবার মার খাবি কিন্তু। ছাদ থেকে আয় বলছি! তুমি আমাকে মারবে আর আমি তোমাকে ভিজিয়ে দিবো হা হা হা। উফফ আমি আর পারিনা আজ তোর মা বাবা ফিরুক তারপর যা বলার বলবো। ঠাম্মা খুব খারাপ হচ্ছে কিন্তু। তুমি কিছু বলবে না। আচ্ছা ঠিক আছে, তবে তুই চলে আয়। তুমি না বদমাইস আছো, আমাকে একদম আমার মতো থাকতে দাও না।

এই বছর ঋদ্ধিমান পাঁচ ক্লাসে উঠল। কাঁকন ঐ স্কুলে রাখতে চায় না তাকে। ঋদ্ধিমানের মা কাঁকন। পেশায় একজন শিক্ষিকা। তাই তার পক্ষে বোঝাটা বেশ সোজা, কতটা পেসার পড়ে বাচ্চাদের উপর এই বাস জার্নি। আবার নিজের সন্তান যদি হয়। সেইকারনে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে। বাড়ি থেকে বেশ অনেকটা দুরেই স্কুল। ছেলেটা ফিরে হাঁপিয়ে পড়ে। তাই বাড়ি কাছে নিউ সেটেলম্যান্টে নিয়ে চলে আসতে চায়। ছেলের পড়াশোনা নিয়ে এতো বেশি কিচিরমিচির হয় যে, কখন কখন তার ঠাম্মা চিৎকার করে বলে বসে; তোরা কি ওকে ওর মতো করে বড় হতে দিবি না! বাবাই এটা হলো না, ওটা করবে না, সাইকেল নিয়ে বেরোনোর আগে গিটার বাজাও, তিনটা ছবি আঁকার আছে, প্রিয়া মিসের পড়া হয়েছে কিনা, ড্রইং এর খাতায় তিনটা ছবিতে রং হয়নি ইত্যাদি ইত্যাদি। এতো চাপ দেয় কেউ বাচ্চাকে! সোনু আমি বলছি যা খেলতে যায়। খেলাধূলা করলে শরীর সুস্থ থাকে। আনন্দ কোনো কথা না!  চায়ে চুমুক দিয়ে চলেছে। ঋদ্ধিমানের বাবা আনন্দ। সব শুনে আর হাসি। এ দিকে কাঁকন রাগে গরগর করে। তুমি একেবারে ছেলেটাকে নিয়ে ভাবছো না। কবে থেকে বলেছি একটু খবর নাও কোন পদ্ধতিতে ট্রান্সফার হবে। ঠিক আছে আগামীকাল দুপুরে ক্লাস টিচার্সের সাথে কথা বলবো। এখন ওকে ছেড়ে দাও। পোটো তুমি তাড়াতাড়ি খেলে আসবে। আনন্দ তার ছেলেকে পোটো বলে ডাকে। আর নতুন দাদুকে বলবে বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে যেতে খেলার শেষে। আনন্দের পাশেই একজন বাড়ি করেছেন। তাকে পোটো নতুন দাদু বলে ডাকে। কারণ তিনি নতুন এসেছেন এই কলনিতে।

২.

হ্যালো কাঁকন। বলো। এইমাত্র ক্লাস টিচার্সের সাথে কথা হলো। কি বললেন? উনি বললেন কি কারণে ট্রান্সফার নিতে চাইছি। আমি বললাম সমস্ত কিছু। উনি বললেন গ্রুপে নোটিশ দেওয়া হবে। অফিস থেকে ফর্ম সংগ্রহ করতে হবে। নোটিশে নিয়মাবলি দেওয়া থাকবে। আচ্ছা! কবে হবে নোটিশ এমন কিছু বললেন? গরমের ছুটির আগেই হবে। আচ্ছা। ঠিক আছে রাখো আমি ক্লাসে যাবো। ফোনটা কেটে যায়। আনন্দ কাজে মন দেয়।

যথা সময়ে বাস এসে দাঁড়ায়। বিল্টু জেঠু দাঁড়িয়ে আছে। ঋদ্ধিমানকে নিয়ে আসে বিল্টু জেঠু। জানো জেঠু মনে হচ্ছে আর তোমার সাইকেলে আমার আসা হবে না! কেন বাবু? আজ ক্লাস টিচার্স ছুটির সময় বলছেন আমাকে নাকে অন্য স্কুলে দেবে! আমার ভালো লাগছে না জানো। তুমি একবার মায়ের সাথে কথা বলবে। আমি তোমার সাইকেলেই আসতে চাই। আমি বন্ধুদেরকে হারাতে পারবো না। ও জেঠু তুমি একটু বলো না মাকে। ঠিক আছে বাবু আমি বলবো। শিশু মনের চাওয়া-পাওয়াগুলি বুঝতে পারে বিল্টু। অন্যান্য দিনের মতো আজ আর দুষ্টুমি করলো না বাবু। বিল্টু বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। একটা গভীর মায়া জড়িয়ে আছে তার সাথে। প্রখর রোদেও যেমন ক্লান্তি আসে না তেমন ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতেও বাবুর সাথে ভিজতে কষ্ট হয়না। বাস থেকে নামা আর বাড়িতে পৌঁছানো এর মাঝে হাজার কথা, হাজার আবদার। আসলে এ এক ভালোবাসা। যার মধ্যে মনের সুখ লুকিয়ে আছে। সাইকেল থেকে নামতে নামতে জেঠুর কানে কানে বলে; জেঠু আজ তুমি দাদুকে সব বুঝিয়ে বলে যেও। দাদু যেন মা আর বাবাকে বলে।

কি ব্যপার বিল্টু? কি কানে কানে বলছে? আসছি দাদা সব বলবো। সাইকেলটা ইলেকট্রিক খু্ঁটিতে ঠেকিয়ে দিয়ে সব কিছু বলতে থাকে বিষ্ণুকে। বিষ্ণু ঋদ্ধিমানের দাদু। দাদা বুঝতে পারছি ওর অনেক কষ্ট হয়। কিন্তু স্কুলের স্যার আজ বলার পর থেকে কেমন উদাস হয়ে গেছে। ওর শিশু মনে এই প্রভাবও এসে পড়েছে যে; আমি আর তাকে আনতে যাবো না। কারণ বাড়ির সামনে থেকেই গাড়ি পিকাপ করবে। ও মাথায় এও এসে গেছে যে; সমস্ত বন্ধু তার হারিয়ে যাবে। আর টিফিনে ভাগ করে খাওয়া হবে না তাদের সাথে। আরো কত কি বলতে বলতে বাড়ি এসেছে। শুধু একটা কথা বারবার বলে চলেছে; জেঠু তোমার সাইকেলে আর আসা হবে না। দাদা জানেন অনেক মায়া পড়ে গেছে ওর প্রতি!

ঠাম্মা চলো আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে। আজ খেলতে যাবো না। নতুন দাদু যদি ডাকতে আসে তুমি বলে দিও ও ঘুমিয়ে গেছে! ঠাম্মার দিকে পিছন করে মাথার নিচে হাত দিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘরের ছায়া লম্বা হয়ে পড়েছে নারকেল গাছে কাছ পর্যন্ত। ঋদ্ধিমান সজনেগাছের ডালে বসে থাকা পাখিটার দিকে তাকিয়ে আছে। সে জানে না পাখিটা নাম কি! সে জানে না তার মা কোথায়! সে জানে না ওর কতজন বন্ধু আছে বা কতজন বন্ধু নতুন বন্ধুদের কাছে গেছে! সে কিছুই জানে না! সোনু ঘুমিয়ে পড়। ঠাম্মা আমার কথা বাবা মা একটু বুঝলো না। আমি জানি আমার জন্য তোমাদেরকে অনেক ভোরে উঠতে হয়। আচ্ছা ঠাম্মা আমিও তো উঠি। আমাকেও ভালো লাগে না উঠতে তবু কিন্তু আমি উঠি। ও ঠাম্মা মাকে তুমি একটু বুঝিয়ে বলো না। আচ্ছা আচ্ছা আমি বলবো। তুই এখন ঘুমিয়ে পড়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ঠাম্মা তার ছোটবেলার গল্প বলতে থাকে।

৩.

দিনের দুটি সময় আনন্দরা বাড়ির সবাই মিলে চা খায়। ঐটুকু সময় বাড়ির কথাবার্তা হয়। খুব কম শব্দে টিভিটা চলছে। বিষ্ণু কিভাবে শুরু করবে খুঁজে পাচ্ছে না! বলতে গিয়েও মুখে ভাষা আসছে না। পড়ার ঘরে ঋদ্ধিমান ছবিতে রং করছে। চায়ের পরিমাণ ক্রমে কমে আসছে। চা খাওয়া শেষ মানেই আনন্দ ল্যাপটপ খুলে বসবে। তখন আর কারো কথা কানে দিবে না। আবার রাতে খাওয়ার টেবিলে। বিষ্ণু কিভাবে বলবে খুঁজে পাচ্ছে না! কাঁকন বলে বসে; বাবা তোমার কি কিছু অসুবিধা হচ্ছে? না না কাঁকন! বিষ্ণু কাঁকনকে বৌমা বলে ডাকে না, ডাকে কাঁকন বলেই। বলো চেপে রেখেও না রাতেভিতে। বাবা কি হয়েছে? আনন্দ জানতে চায়। না মানে একটা কথা বলার ছিল তোদের দুইজনকে! কিভাবে শুরু করবো বুঝে পারছি না! বলো না কি বলতে চাইছো? আমি তো আর বাঘ ভালুক নয়! বলো। মানে হলো তোরা কি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিস ঐ স্কুল থেকে কোচোকে অন্য স্কুলে নিয়ে আসার? কেন বাবা? দেখ তোদের দুইজনের থেকে ওর সাথে সময় কাটাই বেশি আমরা। কিছু কিছু কথা আছে ওর ছোট মনের মধ্যে তা হয়তো তোরা বুঝে ওঠার সময় পাশ না। সেইগুলো আমরা দু’জনে অনুভব করি। এমনকি ও ওর মনের কথা আমাদেরকে বলে। কারন সারাটা দিন ওর সাথে আমাদের কাটে। ও আমাদের কাছে অনেকটা পেস পায়। আমরা বেশ কাটাই। সারা দুপুর বল কিংবা সারা বিকেল। সেই জায়গা থেকে বলছি কোচো ঐ স্কুলেই থাক। ওর ছোট মনের মধ্যে আঘাত হানিশ না। আনন্দের মা একই কথা বলে! দেখ ও নিজে নিজে অনেক কষ্ট পাচ্ছে। ভয়ে তোদেরকে কিছু বলতে পারছে। কাঁকন বলে মা ওর ভালোর জন্যই তো করছি। দেখো কি ভালো কি খারাপ আমি বুঝিনা! শুধু এটুকু বুঝি ও কষ্ট পাচ্ছে। চায়ের শেষ চুমুক দিয়ে উঠে যায় আনন্দ। ঋদ্ধিমানের আঁকা শেষ পর্যায়ে এসেছে। এখনি প্রিয়া মিস এসে পড়বে! পড়া শেষ হতে হতে রাত্রি ১০.৩০ মিনিট। বিষ্ণু জোরে জোরে বলতে থাকে; ওর জন্য আমরা একটুও সময় দিচ্ছি না। আনন্দের কানে কথাগুলো ঢুকছে কিন্তু কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের কাজ মন বসায়। কাঁকন লক্ষ্য করলো তার শ্বশুর মশাই ছাড়ার পাত্র নয়। কি করবে খুঁজে না পেয়ে কিচেন রুমের দিকে এগিয়ে যায়।

রাতে খাওয়ার সময়ে ঋদ্ধিমানকে একটু কাটুন দেখতে দিতেই হয়। কিন্তু আজ তার কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। চুপচাপ নিজের মতো করে খেয়ে নিচ্ছে রাতের খাবার। হঠাৎ করে ঋদ্ধিমান বলে; পাপা আজ স্যার বলছিলেন আমি নাকি অন্য স্কুলে চলে যাবো! মুখের খাবার শেষ করে আনন্দ বলে; পোটো দেখো তোমার ভালোর জন্যই সব কিছু করছি। দেখো বাবু সামনের স্কুলে চলে এলে তুমি একটু রেস্ট নিতে পারবে। বিকেলে খেলতে পারবে। নতুন দাদুর সাথে মাঠে যেতে পারবে। সর্বপরি সাইকেল চালাতে পারবে। দাদুর সাথে সাইকেল নিয়ে বিকেলে বোম্বে রোডে যেতে পারবে। কিন্তু পাপা আমার স্কুল অনেক ভালো। আমার বন্ধুরা, আমার স্যার ম্যাডামরা সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে। এমনকি পাপা আমাদের স্কুলের সিকিউরিটি আঙ্কেল আমায় রোজ জিজ্ঞেস করে ঋদ্ধিমান আজ কি খেয়ে এসেছো? বলেই পেটে হাত বুলিয়ে দেয়। আর বাসের গেট আঙ্কেল রোজ সকালে বাসে ছাড়ার সময় তোমার কাছে কমপ্লেন করে তারপর বাস থেকে নামার সময় বলে দেয়; ঋদ্ধিমান স্কুলে বেশি দুষ্টুমি করবে না, সময় মতো জল খাবে, সব টিফিন খেয়ে নিও। কথাগুলো বলতে বলতে ঋদ্ধিমানের চোখদুটো ঘটঘটে লাল হয়ে উঠে। নিচের দিকে মুখ করে খেতে থাকে। কাঁকন সহ্য না করতে পেরে ছেলের কাছে উঠে আসে। বাবু কাঁদতে নেই। তুমি দেখো নতুন স্কুলে তোমার আবার নতুন বন্ধু হয়ে যাবে। একটা কথা শোনো প্রতি ক্লাসে নতুন নতুন বন্ধু হয়। এটি স্বাভাবিক। তোমারও হবে। আচ্ছা তুমি বলো ক্লাস ফোরে তোমার ক্লাসে যারা যারা ছিল তারা সবাই আছে এখন? কাঁদো কাঁদো গলায় বলে; না! ঠিক তেমন নতুন স্কুলে নতুন বন্ধু হবে। তাছাড়া তোমার বন্ধুদের সাথে আমাদের সবার যোগাযোগ থাকবে। এখন আর না কেঁদে খেয়ে নাও। কাঁকন কোনোভাবে কি ওর ট্রান্সফার রোধ করা যাবে না? বাবা তোমরা সবাই মিলে বিষয়টি নিয়ে বেশি মাতামাতি করছো! সবে মাত্র জিজ্ঞেস করা হয়েছে। ফর্ম জমা হবে, স্কুলের হেড অফিসে স্কুটনি হবে, বিবেচনা হবে, সিদ্ধান্ত হবে, সিট সংখ্যা হিসেব হবে, উল্লেখিত কারণগুলি বিবেচনা করা হবে, আরো বিভিন্ন বিষয় দেখার পর ট্রান্সফার লিস্ট তৈরী হবে। তাহলে তোমরা এতো চিন্তা করছো কেন? ছাড়ো বাবুর ছুটি পড়ে গেলেই আমরা গ্রামের বাড়িতে চলে যাবো। ঋদ্ধিমান সাথে সাথে বলে; কি মজা হবে মা। দাদু আমি কিন্তু প্রতিদিন নদীতে চান করবো। কোনো অজুহাত শুনবো না তোমার। কি মজা হবে। বিষ্ণু বুঝতে পারে কাঁকন কেমন ভাবে বিষয়টিকে ঘুরিয়ে দিল। ঠিক যেন নদীর গতি কৃত্রিমভাবে অন্যপথে ঘুরে যায়।

৪.

গরমের ছুটিতে কাঁকনরা গ্রামের বাড়িতে। ঋদ্ধিমানের মনটা বেজায় খুশি। বেশ কয়েকদিন বাঁধন হারা হয়ে ছিলো। সমস্ত নিয়মের বেড়াজাল টপকে মন যা চেয়েছে সে তাই করেছে। তবে আনন্দ যে দিন বাড়িতে থাকতো সেইদিনগুলো একটু কম মাতামাতি। তবে দাদু ঠাম্মা হাতে থাকত বলে তেমন ভয় ছিল না। ১০ টা পেরোতে না পেরোতে দাদুকে টানাটানি শুরু হয়ে যায় নদীতে চান করাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। গরমকালের পা ছিপছিপে জল কিংবা কোথাও একটু বেশি। তাতেই শুরু হতো ডুব দিয়ে সাঁতার। আসলে একে সাঁতার বলা যায় না। জল ভেদ করে নদীর তলদেশের বালি দেখা য়ায। তাতেই বিষ্ণু পেরে উঠতে পারেনি। কখনো কখনো রেগে বলে সিপটি কনছি দিয়ে লাগাবো?  তুমি একবার তো মেরে দেখাও তারপর দেখছি। এই বলতে বলতে সেপাস। দাদুর গায়ে একমুঠ ভিজে বালি ছিটিয়ে বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে নালিশ জানায়। একটাই উত্তর আসে; ঠিক করেছে। আরো দুই ঘা পড়লে ভাল হতো। বদমাশ মা কোথাকার। তোমার সাথে কথা বলবো না। খাওয়াদাওয়া শেষ। শুরু আবার দুষ্টুমি।  সারা দুপুর বাগানে বাগানে টেঁকো আর সে। মিনিটে মিনিটে দাদুর ডাক; কোচো কোথায় রে?  এই তো দাদু আমতলায়। একটু পরে আসছি। কিন্তু একটু পরে যে কখন তা বোঝা যেতো না। কাঁকনও তেমন কিছু বলতো না। মনে মনে বলতো শুধু; এই বয়স চলে গেলে শান্ত হয়ে যাবে। করুক গে দুষ্টুমি।

টেঁকো আয় বিস্কুট খাবি। নারে কোচো আমি এইমাত্র খেলাম। চল সবাই এসে গেছে অশ্বত্থ তলায়। টেঁকো হলো কোচোর জেঠতুতো দাদার ছেলে। সম্পর্কে ভাইপো। কিন্তু দুই জনেই প্রায় একই বয়সের। যখন গ্রামের বাড়িতে আসে তখন ওরা দুইজনে একেবারে এক জোড় হয়ে থাকে সারাদিন। শুরু হয় নিজেদের মতে করে কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলা। ঋদ্ধিমানের খুব পচ্ছন্দের খেলা এটি। সেইকারণে সে তার দাদুর একটা গামছা সাথে নিয়ে গেছে। প্রথমে কার চোখে বাঁধা হবে সেই নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়। ঠিক হলো পোগোর চোখে বাঁধা হবে। পোগো পাশের বাড়ির জেঠুর ছেলে। ঋদ্ধিমানের থেকে বছর দুইকের বড়। অশ্বত্থ গাছকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে সবাই। কারো সামনে আসে আবার কারো পিছনে এসে যায় পোগো। কিন্তু ছুঁতে পারেনি কারো গায়ে। অর্থাৎ যাকে ছুঁয়ে দিবে তার চোখ বাঁধা হবে। এবং তাকেও একজনকে ছুঁতে হবে। বেশ মজাদার খেলা। সম্মুখে এসে যায় কোচো। পোগো চোখ বাঁধা অবস্থায় তাকে ছুঁয়ে দেয়। ব্যাস তার পর্ব শেষ। কোচোর চোখে ভালো করে গামছা বেঁধে দেয় পোগো। দেখে নেয় সে দেখতে পাচ্ছে কিনা। তারপর তিন পাক ঘুরিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। সে খুঁজে থাকে প্রতিপক্ষকে। কখন অশ্বত্থ গাছে হাত দিয়ে বলে পেয়ে গেছি, কখন পাশের ঝোপে গিয়ে উল্টে যায়, কখন কেউ কানের কাছে এসে বলে; কুকি আমি এখানে, কেউ আবার পিছন দিকে এসে তালি মেরে যায়, কেউ বলে আয় আয় আমি তো এখানে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ভাবেই চলতে থাকে তাদের খেলা। একসময় সন্ধ্যা নামে। সবাই ফিরে যায় বাড়ির পথে। পরস্পর পরস্পরকে বলতে থাকে কাল বিষ্টু দাদুর আমবাগানে ধাপ্পা খেলা হবে বিকেল বেলায় সবাই চলে আসবি সময় মতো।

সন্ধ্যায় ঋদ্ধিমান দাদুর সাথে গল্পে মেতে যায়। দাদু তোমরা যখন ছোট ছিলে তখন কি কি করতে?  আমরা তো অনেক কিছুই করতাম। নদীর ধারে যে জাম গাছগুলো আছে তখন ঐগুলো বেশ ছোট ছিল। জাম যখন পাকতো তখন টুপটাপ করে গাছের তলায় পড়ত। আমরা একটি একটি করে কুড়ি নিয়ে একটি জামবাটিতে রাখতাম। তাতে নুন দিয়ে রোদে রেখে দিতাম। তারপর চান করতে যাওয়ার সময় কলাপাতায় করে নিয়ে যেতাম আর জামতলায় বসে খেয়ে নদীতে সাঁতার কাটতে শুরু করতাম। যতক্ষণ না বাবা ডাক দিত ততক্ষণ নদীতেই থাকতাম। বিকেলে সবাই মিলে নদীর পাড়ে কোড়া ডাঙ খেলতাম। সেটা কি খেলা দাদু? একটা কাঠের ডাঙ এক হাতের মতো লম্বা আর একটা এক কোড়া মাপের ছোট কাঠের টুকরো। লম্বাটির একটি মুখ সূচালো আর ছোটটির দুটি প্রান্তই সূচালো। একটি ছোট গর্ত করা হতো তার আড় বারাবর রাখা হতো ছোটটিকে তারপর ঐ গর্তের মুখে বড় লাঠিটির সরু মুখটি দিয়ে ছোট ডাঙটি একটু উপরে তুলে স্ব জোরে ছোট ডাঙটির উপর আঘাত এনে ঐটিকে অনেক দূরে পাঠানো হয়। বুঝে গেছি দাদু খেলার নিয়ম। কালে সকালেই আমি শুরু করবো। কিন্তু কিভাবে হবে। কাল তোরা তো চলে যাচ্ছিস শহরের বাড়িতে। আমি দুদিন পর যাবো তখন তোকে শিখিয়ে দিবো। দাদু বাদ দাও। তুমি বরঞ্চ ভোরে উঠে দুটো কাঠের ডাঙ তৈরী করে ফেলো। আমি নিয়ে চলে যাবো। আর শোনো আমাকে ভোর ভোর তুলে দিও, আমিও তোমার সাথে থাকবো তুমি কেমন করে তৈরী করো সেটা দেখার জন্য।

৫.

আবার রুটিন মাফিক জীবন শুরু হয় ঋদ্ধিমানের। সকাল থেকে চলে কাজের ব্যস্ততা। ছেলেকে স্কুলে বাসে ছেড়ে এসে মুখে একটু খাবার দিয়েই বেরিয়ে যায় আনন্দ। ট্রাভেলিং করতে করতে দেখে স্কুলের গ্রুপে একটি ট্রান্সফার লিস্ট পাঠিয়েছেন ক্লাস টিচার্স। বেশ লম্বা চাওড়া সে লিস্ট। খুঁজতে থাকে ঋদ্ধিমানের নাম। কিন্তু কোনোভাবেই পাচ্ছে না! বেশ কয়েকবার খুঁজে কিন্তু না, পাচ্ছে না। না কাঁকনকে একটা কল করতে হবে ভাবে আনন্দ। হ্যালো কাঁকন স্কুলের লিস্টটা একবার দেখতো! আমি পোটোর নামটা পাচ্ছি না। আচ্ছা রাখো আমি দেখচ্ছি। খুব উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল আনন্দ। এদিকে দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে বাসটা। জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আনন্দ। আষাঢ়ের মেঘের কোণে একচিলতে কালো মেঘ জমে আছে। কাঁকনের ফোনের অপেক্ষায় আনন্দ। তার বাস ছুটছে, কাঁকনও তার গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর ক্লাস রুমে মেতে আছে ঋদ্ধিমান। চোখের সাথে যেন একটি ত্রিকোণমিতির রূপ ভেসে উঠছে। কাঁকনের ফোন। হ্যালো। কত নম্বরে আছে গো! না আমিও খুঁজে পাচ্ছি না! তার মানে কি ওর নাম সিলেক্টেড হয়নি? কাঁকন বলে বোধহয় হয়নি! ঠিক আছে রাখছি। আমি নামবো এইবার। ফোনটা কেটে যায়। আনন্দের বাস তখনো গন্তব্যের উদ্দেশে ছুটছে।

 

পরের দিন যথা সময়ে স্কুল বাস এসে দাঁড়ায়। বাসের পাদানিতে পা দিয়ে উঠে যাচ্ছে ঋদ্ধিমান। কি দাদা ওর ট্রান্সফার লেটার নেননি? বাসের গার্ড জিজ্ঞেস করে। না দাদা ওর হয়নি। না না আপনার দেখা ভুল হয়েছে ওর নাম আছে। আপনি একবার স্কুলে গিয়ে যোগাযোগ করুন। বাসটা ছেড়ে দেয়। ঋদ্ধিমানে বন্ধুদের সাথে মেতে গেছে। ফিরে এসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে আনন্দ কাঁকনকে সমস্ত কথা বলে। বুঝলে আনন্দ চলো একবার স্কুল থেকে ঘুরে আসি। কাঁকন বলে; নতুন স্কুলে এসে গেলে ওর কি কি সুবিধা হবে। বুঝলে বাবাইকে আর এতো সময়ের বাস জার্নি করতে হবে না। স্কুল ছুটির কুড়ি মিনিটের মধ্যে বাড়িতে চলে আসবে। উফফ কি যে খুশি লাগছে। সমস্ত কিছু সময় মতো হবে। ওর গিটার ক্লাস, কম্পিউটার ক্লাস, আঁকার ক্লাস, কবিতার ক্লাস, ফুটবলের ক্লাস, সুইমিং, অঙ্কের ক্লাস, ইংরেজির ক্লাস সব সব ঠিকঠাক হবে। তাছাড়া সব থেকে বড় কথা হলো মিক্স কালচার থেকে মুক্তি পাওয়া। তবে তোমরা যাই বলো যেটা করছো সেটা ভুল। কেবল মা বাবা হলেই হয় না! সন্তানের মনটা বুঝতে হয়। আর তোমরা তো তা বুঝতেই চাও না। আসলে তোমাদের মন দুটো জড়পদার্থে পরিণত হয়ে গেছে। মা এই কথাগুলো কেন বলছো?  দেখো ওর কি আমরা খারাপ চাইবো? হ্যাঁরে আনন্দ তোরা তোদের অলক্ষ্যে ওর খারাপ করছিস। পারবি এক সপ্তাহ ছুটি নিয়ে ছেলেকে সময় দিতে! পারবি অফিস থেকে ফিরে ওর স্কুলে সারাদিন কি হয়েছে শুনতে! পারবি না। আসলে তোদের মনটা জড়পদার্থে পরিণত হয়ে গেছে! কাঁকন কোনো কথা বলল না। শুনতে থাকল শাশুড়ি আর শশুরের অনুভূতির কথাগুলো।

 

আনন্দ চলো একবার ঘুরে আসি স্কুল থেকে। পুরো বিষয়টি আমাদের জানা দরকার আছে। মা আসছি। তোমরা টিফিন করে নাও। আমরা ফিরে এসে খাবো। মা বাবার মুখে কোনো উত্তর নেই। স্কুলের দিকে এগিয়ে যায় ওরা। স্কুলের নোটিশ বোর্ডে চোখ রাখে। হঠাৎ চোখে পড়ল ঋদ্ধিমানের নাম। এই দেখো এইতো ওর নাম আছে। ভালো করে দেখো; আনন্দ বলে। হঠাৎ চোখে পড়ল Not Recommended শব্দটি লেখা ঋদ্ধিমানের নামের পাশে। মনটা দুমড়ে যায়। অফিসে গিয়ে কথা বলে। অফিস থেকে জানানো হয়; আপনারা যে ইসু নিয়ে আবেদন করেছিলেন সেই ইসুটি ছাত্রের প্রাথমিক রিভিউতে কোনো সমস্যা দেখতে পাননি ছাত্র পরিদর্শক টিম ম্যানেজমেন্ট। সেই কারণে ও এইখানেই থাকবে। মুখ নিচু করে অফিস থেকে বেরিয়ে ক্লাস রুমে যায় আনন্দ আর কাঁকন। ক্লাস টিচার্স দেখা মাত্রই বলেন; ও এখানেই কমফোর্ট। সেই কারণে ও এইখানেই থাকবে। মা বাবাকে দেখতে পেয়ে কাছে আসে ঋদ্ধিমান। শুকিয়ে আছে তার মুখটা। যেন একটা ঝড় তার উপর দিয়ে বয়ে গেছে! কাঁকনের মনের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। স্কুল পরিবর্তনের বিষয়টি এতোটাই প্রভাবিত করেছে তাদের সন্তানকে!’সে কল্পনা করতে পারেনি বাবাই এতোটা মর্মাহত হয়ে পড়বে বলে। ঋদ্ধিমান যাও তোমার সিটে গিয়ে বসো। তুমি এখানেই থাকছো তোমার বন্ধুদের সাথে। ঝড়ের গতিতে শুকিয়ে যাওয়া মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। যেমন দীর্ঘ অনাবৃষ্টি হওয়ার পর বৃষ্টি পড়লে গাছগুলি উজ্জ্বল হয়ে উঠে ঠিক তেমনি ঋদ্ধিমানের মনে খুশির জোয়ার।  দেবদান আর অনুপ্রভাকে জড়িয়ে বলতে থাকে স্যার বললেন আমি এখানেই থাকছি। কি আনন্দ হচ্ছে আমার। একে একে বলতে থাকে সে এই স্কুলেই থাকছে। আনন্দ তাকিয়ে থাকে ক্লাস রুমের দিকে। ছুটির পর ছুটে গিয়ে বাসের গার্ড আঙ্কেলকে বলতে থাকে; আমি এই স্কুলেই থাকছি আর এই বাসেই দুষ্টুমি করবো। ও হো কি আনন্দ আমার। বলতে বলতে বাসের চারপাশে ছুটতে থাকে। বাস থেকে নেমেই ছুটে গিয়ে বলতে থাকে; ও বিল্টু জেঠু আমি কোথাও যাচ্ছি না। আমি আমার স্কুলেই থাকচ্ছি আর তুমিই প্রতিদিন আমাকে নিয়ে যাবে। চলো চলো দাদু ঠাম্মাকে সুখবরটা দিতে হবে। ও ঠাম্মা ঠাম্মা!  তাড়াতাড়ি এসো একটা কথা আছে!  কি কথা রে?  ঠাম্মা আজ স্যার মা বাবাকে বলে দিয়েছেন ঋদ্ধিমান কোথায় যাচ্ছে না। ও এই স্কুলেই থাকবে। ঠাম্মার চোখে ভেসে উঠে ঋদিমানের খুশি। ছুটে গিয়ে দাদুকে জড়িয়ে বলে; দাদু ঐ স্কুলেই আমি থাকছি। ঋদ্ধিমান আনন্দে আত্মাহারা হয়ে মাকে জড়িয়ে চুমু দিতে থাকে। গমগম করতে থাকে আনন্দের ছোট পরিবার।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here