
তাহমিনা শিল্পী :: বহুদিন ভাবনা পালিয়ে বেড়াচ্ছে।গল্প লেখা হয়নি একটাও।ক্রমশই দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে পড়ছে ডায়েরির ভাঁজে ভাঁজে। অতঃপর একদিন মনের খরা কাটাতে অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।সঙ্গে নিলাম ছোট্ট ব্যাগে প্রয়োজনীয় টুকিটাকি।আর নিত্যসঙ্গী কলম, ডায়েরি, চশমা।
কোথায় যাব? দ্বিধায় পড়লাম। অবশেষে স্টেশনে বসে সিদ্ধান্তে স্থির হলাম, বাসে যেতে যেতে মাইলফলক অথবা সাইনবোর্ডে লেখা দেখে যে জায়গাটির নাম ভালো লাগবে সেখানেই নেমে পড়ব। আপাতত ঢাকা থেকে দিনাজপুরের একটি বাসে উঠে বসেছি।
ঘন্টা তিনেক বাস চলার পর শিমুল তুলোর মতো নরম-কোমল একটি নাম পেলাম, শিমুলিয়া। দ্রুত নেমে পড়লাম।
শিমুলিয়া নির্জন একটি গ্রাম। তারউপর সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে। আশেপাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। অগত্যা পিচ রাস্তাটা বাঁয়ে রেখে পাশের কাঁচা রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পর আশ্চর্যজনকভাবে একটি সরকারী ডাকবাংলো পেয়ে গেলাম।
বাংলোতে বিদ্যুৎ নেই।মিটমিট করে হ্যারিকেন জ্বলছে, সদর দরজায়।পলেস্তরা খসে পড়া মলিন দেয়াল। দরজা-জানালার কপাটগুলো নড়বড়ে। একমাত্র টিউবওয়েলটাতে জল পড়ে না।
ডাকবাংলোটি প্রায় পরিত্যক্ত,অনেকদিন কোনও অতিথি আসেনি।একজন বৃদ্ধ কেয়ারটেকার আছেন। আপাতত তাঁর সহানুভূতির দ্বারস্থ হলাম।
কেয়ারটেকার বললেন, বাংলোর পিছনের রাস্তাটা ধরে পূর্ব দিকে একটু হাঁটলেই বাখিয়ার বিল। শুধু বর্ষা নয়, এখানে প্রায় সারা বছরই জল থাকে। চমৎকার সূর্যোদয় দেখা যায়। থরে থরে লাল-শাপলা ফুলগুলি হেসে গড়াগড়ি খায় বাতাসে। খুব ভোরে পানিতে রক্তাভ আকাশের ছবি ভাসে। তারপর একটু-একটু করে মেঘ ভেঙে বিলের জল থেকে জেগে ওঠে কুসুমরাঙা সূর্য।শীতে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসে পরিযায়ী পাখি।
তাই একসময় শিমুলিয়ায় পর্যটকদের খুব ভিড় হত।গমগম করতো এই ডাকবাংলো।
তারপর বিলটা এক মায়াপরীর দখলে চলে গেল।এখন বাখিয়ার বিলের নাম উচ্চারণ করতেও সবাই ভয় পায়।নিতান্ত প্রয়োজনে বিলের ধারের রাস্তা দিয়ে দলবেঁধে স্থানীয় লোক চলাফেরা করলেও মায়াপরী দেখা দেয় বলে ভোরে, দুপুরে আর সন্ধ্যেবেলা ভুল করেও কেউ ওপথ মাড়ায় না।
বিস্তারিত জানতে চাইলে কেয়ারটেকার সাফ জানিয়ে দিলেন, ওসব কথা সে মুখেও আনবে না। আর সাবধান করে দিলেন, আমি যেন কিছুতেই ওমুখো না হই।
নিষেধ আমার কৌতুহলকে উসকে দিল। সারা রাত নির্ঘুম কাটিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই মায়াপরীর দর্শন লাভের সুপ্ত ইচ্ছেয় চুপিচুপি বেরিয়ে পড়লাম বাখিয়ার বিলের উদ্দেশ্যে।
সবে আকাশে লালের আভা ফুটেছে। বিলের পাশ ধরে হাঁটছিলাম। দেখলাম, নির্জন জলে পা ডুবিয়ে একলা বসে আছে একজন মানবী। তার তৈলাক্ত ত্বকে ক্লেদমাখা, বাহু দু’টো যেন সদ্য মাটি ভেদ করে উঠে আসা পদ্মপাতা। খোলা পিঠে ছড়ানো চুলে আলোর ঢেউ। মায়াবী কোমল মুখে বিষাদের ছোঁয়া, আকুলি-বিকুলি চোখে স্বপ্নালোকের ছায়া। হাত দু’টো একসঙ্গে ভাঁজ করে থুতনিতে ঠেকিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে মগ্ন হয়ে কি জানি কি ভাবছে!
আমি স্থির তাকিয়ে আছি তার সম্মোহনী রূপের দিকে। সমস্ত মনোযোগ এক করে সিদ্ধান্ত নিলাম ছুঁয়ে দেখব, এই মায়াপরীকে। কাছে যেতেই সে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো, এক ঝটকায় জলে নেমে গেল। আর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল …
তার হাসির সুর উড়ে উড়ে বেড়াল চারপাশের বাতাসে।টের পেলাম, সঙ্গোপনে সেই হাসির ঢেউয়ে আমি ভেসে যাচ্ছি। প্রচণ্ড ঘোরে, হাবুডুবু খাচ্ছি শ্যাওলার পাঁকে পাঁকে…
অকস্মাৎ বিপরীত দিক থেকে ধেয়ে এলো গাঢ় ধোঁয়া, আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেল। খানিকবাদে এক ঝলক রোদ ছুঁয়ে গেল। চোখ মেললাম।
গভীরতম স্তর থেকে জেগে উঠল মন। স্মৃতি হাতড়ে বিগত দশ মিনিট ছাড়া আমার আর কোনও অতীত-বর্তমান খুঁজে পেলাম না।
এখন মায়াপরী আমার সামনেবসে আছে ,রিডিংরুমের চেয়ারে। ওর সমস্ত দেহে জলের ঢেউ।অনবরত আছড়ে পড়ছে আমার কলমের ঠোঁটে।